Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিশুটির বাবা কে? ধর্ষকের স্বীকারোক্তির পরও ডিএনএ টেস্টে অমিল

কামরুল ইসলাম ফকির, স্টাফ করেসপডেন্ট
৩০ জুলাই ২০২২ ২২:১০

ঢাকা: কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার বিনাইপাড় গ্রাম। কয়েক মাস আগে এই গ্রামেরই এক কিশোরী (১৬) ধর্ষণের শিকার হয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। মামলার পর এক যুবককে (২১) গ্রেফতার করা হয়। এরপর ওই কিশোরী এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। এ ঘটনায় ‘অভিযুক্ত’ যুবক ধর্ষণের বিষয়টি স্বীকার করে কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। পরবর্তী সময়ে ওই যুবক কিশোরীকে বিয়ের ইচ্ছে পোষণ করে হাইকোর্টে জামিন আবেদন করলে, আদালত জামিন প্রশ্নে রুল জারির পাশাপাশি কুমিল্লা জেল কর্তৃপক্ষকে কারাগারে বিয়ের ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেন। পরে কিশোরীর অসংলগ্ন কথাবার্তা ও তার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে মত পার্থক্য দেখা দিলে যুবক বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে সেই বিয়ে আর হয়নি।

বিজ্ঞাপন

এরপর, কিশোরীর গর্ভজাত সন্তানের জৈবিক পিতা কে? তা জানতে চেয়ে ডিএনএ টেস্টের আবেদন করে যুবক। আদালত আবেদন মঞ্জুর করে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগকে ডিএনএ টেস্ট করে রিপোর্ট দাখিলের নির্দেশ দেন। পরবর্তী সময়ে আদালতে দাখিল করা সিআইডির ডিএনএ টেস্টের রিপোর্টে দেখা যায়, যুবকের সঙ্গে শিশুটির ডিএনএ টেস্টের ফলাফলে মিল নেই।

গত ২৬ জুলাই হাইকোর্টে ডিএনএ টেস্টের ফলাফল তুলে ধরে যুবকের পক্ষে জামিন আবেদন করা হয়। হাইকোর্ট শিশুর পিতৃ পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে ওই কিশোরীর সঙ্গে কথা বলতে সংশ্লিষ্ট আদালতের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে নির্দেশ দেন। আগামী ৪ আগস্ট এ বিষয়ে আদেশের জন্য দিন ধার্য করেছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার (২৮ জুলাই) এ আদেশ দেন। আদালতে যুবকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. একরামুল হক বাকি আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুদ্দিন খালেদ।

আদেশের বিষয়টি সরাবাংলাকে নিশ্চিত করে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুদ্দিন খালেদ বলেন, ‘কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার বিনাইপাড় গ্রামের এক যুবকের বিরুদ্ধে এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনার পর কিশোরী গর্ভবতী হয়ে পড়ে এবং পরবর্তী সময়ে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। পরে তারা দুজনই আদালতে নিজেদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কের কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। তবে ওই যুবকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শিশুর ডিএনএ টেস্ট করা হয়। ডিএনএ টেস্টের ফলাফলে দেখা যায়, ওই ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত যুবকের সঙ্গে ওই শিশুর ডিএনএ মিলছে না। এখন ওই কিশোরীর সঙ্গে আমাকে কথা বলতে বলেছেন আদালত। আমি মামলার তদন্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে ওই কিশোরীকে ডেকে বিষয়টি বিস্তারিত জেনে আদালতকে জানিয়ে দেব। আগামী বৃহস্পতিবার (৪ আগস্ট) এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য দিন ধার্য রেখেছেন আদালত।’

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে যুবকের পক্ষের আইনজীবী মো. একরামুল হক বাকি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ধর্ষণের অভিযোগ যার বিরুদ্ধে সেই যুবক দরিদ্র ঘরের ছেলে, পেশায় ফল বিক্রেতা। ছেলেটি পুলিশ হেফাজতে ছিল। সেখান থেকে আদালতে পাঠানো হলে ধর্ষণের কথা স্বীকার করে ওই যুবক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি (ফৌজদারি কার্য বিধির ১৬৪ ধারায়) দেয়। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবাববন্দিতে ওই যুবক দু’বার ধর্ষণের কথা স্বীকার করলেও কিশোরী মেয়েটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২২ ধারায় একবার ধর্ষিত হওয়া কথা আদালতকে জানিয়েছে। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদে মেয়েটি অসংলগ্ন কথা বার্তা বলেছে। এ কারণে অভিযুক্ত যুবক কিশোরীকে প্রথমে বিয়ে করতে রাজি হলেও পরে বিয়েতে অস্বীকৃতি জানায়। পাশাপাশি নবজাতক শিশুর পিতৃ পরিচয় নির্ধারণে ডিএনএ টেস্টের আবেদন করে। এরপর আদালতের নির্দেশে ডিএনএ টেস্ট করা হয়। টেস্টের ফলাফলে দেখা যায়, ওই যুবক শিশুটির জৈবিক পিতা নন।’

বৃহস্পতিবার (২৮ জুলাই) আদালতে ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট তুলে ধরে যুবকের পক্ষে সম্পূরক জামিন আবেদন করা হয়। পরে হাইকোর্ট ওই কিশোরীকে ডেকে শিশুর জৈবিক পিতা কে সেটা খুঁজে বের করতে রাষ্ট্রপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন।

মামলার বিবরণে জানা যায়, কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার বিনাইপাড় গ্রামের ২০২১ সালের ২ জুলাই রাত ১১টায় ১৬ বছর বয়সী কিশোরী একই বাড়ির পাশাপাশি ঘরের ‘অভিযুক্ত’ যুবকের সন্তান সম্ভবা বোনকে দেখাশুনার জন্য রাত্রিযাপন করেন। সেই সুযোগে ওই যুবক কৌশলে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে কিশোরীকে ধর্ষণ করে। পরবর্তী সময়ে বিষয়টি না জানানোর জন্য ওই যুবক কিশোরীকে বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি ও হুমকি দেওয়ায় সে কাউকে কিছু জানায়নি। ওই ঘটনার পরও ভয় দেখিয়ে পরবর্তী সময়ে কিশোরীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে ওই যুবক। এক পর্যায়ে কিশোরী অসুস্থ হয়ে পড়লে বিষয়টি তার পরিবারকে জানায়। তখন জানা যায়, কিশোরী তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এরপর কিশোরীর মা বাদী হয়ে দেবিদ্বার থানায় ওই যুবককে একমাত্র আসামি করে ২০২১ সালের ৪ অক্টোবর এজাহার দায়ের করে। এরপর ওই যুবককে একই দিন ভোর পৌনে ৩টায় গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে ওইদিন দুপুর ১টায় ‘অভিযুক্ত’ যুবক ধর্ষণের বিষয়টি স্বীকার করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্টেট ফারহানা সুলতানার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।

১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে যুবক যা বলেন— ‘কিশোরীর (প্রকৃত নাম উহ্য রাখা হয়েছে) মা আমাদের প্রতিবেশী। তাকে খালা ডাকি। তার মেয়ের নাম…। আমার বোনের বাচ্চা হয়েছে। এরপর আমার বোনের বাচ্চার দেখাশোনার জন্য আমাদের বাড়িতে ওই কিশোরী মাঝে মধ্যে এসে থাকতো। ৪/৫ মাস আগে ওই কিশোরী রাত ১১টার দিকে আমার ঘরে আসে। আমি নিচে বিছানা পেতে শুয়েছিলাম। ওই দিন রাতে কিশোরীর সম্মতিক্রমেই তার সঙ্গে আমার শারীরিক সম্পর্ক হয়। আমার ছোট বোনও একই ঘরে ঘুমাচ্ছিল। সে কিছু টের পায়নি। এর পরে আবার আরেক দিন রাতে তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক হয়। এ দুবারই। আর হয়নি। এখন কিশোরীর মা মামলা করেছে, টাকা চাচ্ছে। এত টাকা দেওয়ার সামর্থ আমার নাই।’

কিশোরী জবানবন্দিতে যা বলেন— ওইদিন একই আদালতে বিকেল সোয়া ৪টায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমনের আইনের ২২ ধারায় জবানবন্দি দেয় ওই কিশোরী। কিশোরী তার জবানবন্দিতে বলেন, ‘যুবকের (প্রকৃত নাম উহ্য রাখা হলো) বোনের বাচ্চা হওয়ায় আমি তার দেখাশোনার জন্য তাদের বাড়িতে থাকতাম। তাদের দুইটা ঘর। একটা ঘরে যুবকের বোন ও বোন জামাই থাকতো। আরেকটা ঘরে যুবকের আরেক বোনের সাথে আমি খাটে ঘুমাতাম। যুবক ওই ঘরেই মাটিতে ঘুমাতো। ৪/৫ মাস আগে যুবকের বোন আর আমি ঘুমিয়েছিলাম। এক পর্যায়ে ওই যুবক আমার মুখ চেপে ধরে জোর করে খারাপ কাজ করে। একবারই করে। আর করে নাই। আমাকে বলে কাউকে বললে মেরে ফেলবে। মেরে নদীতে ভাসিয়ে দেবে। তাই কাউকে কিছু বলি নাই।’

এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কয়েক দফা সময় নিয়েও আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. নাজমুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখনো মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারিনি। অভিযুক্ত যুবক কিশোরীকে বিয়ে করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিশোরী ও তার পরিবার বিয়েতে রাজি হলেও পরবর্তী সময়ে সে বিয়ে আর অনুষ্ঠিত হয়নি। ধর্ষণের ঘটনায় ভূমিষ্ঠ শিশুটি বর্তমানে ওই কিশোরীর কাছেই রয়েছে।’

এদিকে, ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে ওই যুবক জামিন চেয়ে বিচারিক আদালতে আবেদন করলে তা নামঞ্জুর হয়। অতঃপর কিশোরীকে বিয়ে করার আগ্রহ প্রকাশ করে গত ৩ নভেম্বর হাইকোর্টে আবেদন করে ওই যুবক। সেই আবেদনে জামিনও চাওয়া হয়। এরপর গত ১২ ডিসেম্বর শুনানি নিয়ে আদালত জামিন প্রশ্নে রুল জারির পাশাপাশি যুবকের সঙ্গে কিশোরীর বিয়ে আয়োজন করতে কুমিল্লার জেল সুপারকে নির্দেশ দেন। এরপর বিয়ের বিষয়ে দু’পক্ষের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেওয়ায় সে বিয়ে আর হয়নি।

পরবর্তী সময়ে ওই কিশোরীর গর্ভজাত পুত্র সন্তানের জৈবিক পিতা কে- তা জানতে চেয়ে যুবকের পক্ষে কুমিল্লার আদালতে আবেদন করা হয়। আদালত শুনানি নিয়ে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগকে ডিএনএ টেস্ট করে রিপোর্ট দাখিলের নির্দেশ দেন। এরপর গত ৪ জুলাই কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে (আমলী আদালত-৪) ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট দাখিল করা হয়। আর ২৬ জুলাই হাইকোর্টে ডিএনএ রিপোর্ট তুলে ধরে ওই যুবকের পক্ষে সম্পূরক আরেকটি আবেদন করা হয়। গত ২৮ জুলাই শুনানি নিয়ে আদালত আগামী ৪ আগস্ট এ বিষয়ে আদেশের জন্য দিন ধার্য করেন।

সারাবাংলা/কেআইএফ/পিটিএম

অমিল টেস্ট ডিএনএ ধর্ষক শিশুটির বাবা কে? স্বীকারোক্তি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর