Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বদলে গেছে ‘বঞ্চিত’ জনপদ, বিলুপ্ত ছিটমহলের সর্বত্র উন্নয়ন

হাসানুজ্জামান হাসান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
২ আগস্ট ২০২২ ০৮:৪৩

লালমনিরহাট: বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোর উন্নয়নে গত সাত বছরে সরকারের বিশেষ নজরে বদলে গেছে বিলুপ্ত ছিটমহলের চিত্র। দীর্ঘ ৬৮ বছর পিছিয়ে থাকা বিলুপ্ত ছিটমহলে এখন সন্ধ্যায় হলেই জ্বলে উঠছে বৈদ্যুতিক বাতি। এখানকার বাসিন্দারা পাচ্ছেন বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতাসহ সরকারি অনেক সুযোগ। তৈরি হয়েছে নতুন রাস্তা-ঘাট। এগিয়ে চলছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ নানা উন্নয়নমূলক কাজ। স্বাস্থ্যসেবায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিলুপ্ত ছিটমহলে তৈরি করা হয়েছে ক্লিনিক। এখন বিলুপ্ত ছিটমহলের সর্বত্রই লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া।

বিজ্ঞাপন

গত রোববার (৩১ জুলাই) দুপুরে লালমনিরহাটের বিলুপ্ত ৫৯টি ছিটমহলে সপ্তম বর্ষপূর্তিতে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে উৎসব মুখর পরিবেশে ছিটমহল বিনিময়ের লালমনিরহাটের ভিতরকুটি বাঁশপচাই, হাতীবান্ধা উপজেলার গোতামারী ও পাটগ্রাম উপজেলার বাঁশকাটা বিলুপ্ত ছিটমহলে ৭ম বর্ষপূর্তি উদযাপন হয়।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার ভিতরকুটি ছিটমহলের বাসিন্দা ৬৫ বছর বয়সী এসহাক আলী জানান, জীবনের শেষ বয়সে ভোটার হয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে ইচ্ছে অনুযায়ী পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। বেঁচে থাকতে নতুন পরিচয়ে জীবনের এক অন্যরকম আনন্দ।

পাটগ্রাম উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহল বাঁশকাটার বাসিন্দা ওমর আলী দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছিটমহলের চিত্রও পাল্টে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘নিজেদের পরিচয়টাও দিতে পারতাম না আমরা। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নানা সমস্যায় ভোগান্তির শেষ ছিলো না। কিন্তু ছিটমহল বিলুপ্ত ও প্রধানমন্ত্রীর নজরেই ভোগান্তির দিন ইতিহাস হয়ে গেছে। উন্নয়নের ছোঁয়া এখানকার বাসিন্দাদের জীবনমান পাল্টে দিয়েছে।’

লালমনিরহাটের ভিতরকুটি বাঁশপচাই ছিটমহলের সাবেক সভাপতি হারুন অর রশিদ বলেন, ‘সাত বছরে আমাদের ছিটমহল ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। বিদ্যুৎ, মসজিদ, মন্দির, রাস্তা-ব্রিজ কালভার্ট ব্যাপক উন্নত হয়েছে। তবে ছিটমহলবাসী বিশেষ কোটায় চাকরি এবং কৃষকরা কৃষি ঋণ থেকে বঞ্চিত। এই সুযোগ-সুবিধাগুলো পেলে ছিটমহলবাসী আরও উন্নত হতো।’

জানা গেছে, ভারত-বাংলাদেশ সরকার যৌথ ঘোষণায় ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই ছিটমহলের নামে নিজ নিজ দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে থাকা ভূখণ্ডগুলো দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে একীভূত হয়। ফলে ওইদিন থেকে ব্রিটিশদের করে রাখা ছিটমহলের বিলুপ্তি ঘটে।

বিজ্ঞাপন

জেলার পাটগ্রাম উপজেলায় বিলুপ্ত ছিটমহলের সংখ্যা বেশি। এ উপজেলায় ৫৫টি বিলুপ্ত ছিটমহলের মধ্যে জনবসতি রয়েছে ৩৮টি। বিলুপ্ত ছিটমহলগুলো ঘুরে দেখা গেছে, এখানকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বাসিন্দাদের জীবনমান উন্নয়নে প্রতি বছরে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে সরকার। সরকারি উদ্যোগে বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে পাকা রাস্তা, ডিজিটাল সেন্টার, কমিউনিটি ক্লিনিক, পুলিশ ফাঁড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির, কবরস্থান, শ্মশান, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মিত হয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ, স্যানিটেশন, সুপেয় পানির জন্য টিউবওয়েল, কমিউনিটি সেন্টার, সোলার দেওয়া হয়েছে।

বয়স্ক, বিধবা, স্বামী পরিত্যাক্তা নারী, প্রতিবন্ধিদের জন্য করে দেওয়া হয়েছে ভাতার কার্ড। তাছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ৩৬টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে জমিসহ গৃহ নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে।

১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা স্থলসীমান্ত চুক্তি মোতাবেক বর্তমান প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাত থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ১১১টি ও ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের বিলুপ্তি ঘটে। সেই সুবাদে উভয় দেশের অভ্যন্তরে থাকা ছিটমহলগুলো দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগ হয়। এতে ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দারা বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশি ছিটমহলের বাসিন্দারা ভারতীয় নাগরিকত্ব লাভ করে।

চুক্তির সফল বাস্তবায়নের পর বাংলাদেশের মানচিত্রে যোগ হয় ১৭১৬০.৬৩ একর জমি।

পাটগ্রাম উপজেলা প্রকৌশল অধিদফতরের প্রকৌশলী মাহবুব আলম বলেন, ‘গত ৭ বছরে বিলুপ্ত ছিটমহলে প্রায় ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা, ৩টি ব্রিজ, ২টি মসজিদ, ১টি মন্দির, ১টি শ্মশান, কবরস্থানের বাউন্ডারি ওয়াল, কমিউনিটি সেন্টার, প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে ৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় নর্মাণ করা হয়েছে।’

পাটগ্রাম স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পাটগ্রাম উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহলসমূহে প্রায় ১ হাজার নলকূপ, দুই শত রিংওয়েল নলকূপ, ৮০০ স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন স্থাপন করা হয়েছে।

শিক্ষা অধিদফতর জানায়, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষায়িত ১৫০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের আওতায় বিলুপ্ত ছিটমহলে চারটি বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।

বিলুপ্ত ছিটমহলের ৮নং ভোটবাড়ী, ১৪নং লতামারী, ২১নং পানিশালা ও ১১৯নং বাঁশকাটা বিদ্যালয়বিহীন এলাকায় চার কক্ষ বিশিষ্ট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। স্থানীয় উদ্যোগে তিনটি নিম্ন মাধ্যমিক ও দুইটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বাশঁকাটা দয়ালটারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মোমিনপুর বাশঁকাটা মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবারেই এমপিওভূক্ত হয়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যমতে, ইতিমধ্যে ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৪০ কিলোমিটার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। প্রায় সব বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে ৬৮ বছরের বন্দি জীবনের অবসান ঘটে ভারত-বাংলাদেশের ১৬২টি ছিটমহলের কয়েক হাজার মানুষের। এর মধ্যে ১১১টি বাংলাদেশের এবং ৫১টি ভারতের ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়। বাংলাদেশের ১১১টির মধ্যে কুড়িগ্রাম জেলায় ১২টি, লালমনিরহাটে ৫৯টি, পঞ্চগ্রাম জেলায় ৩৬টি এবং নীলফামারী জেলায় রয়েছে ৪টি বিলুপ্ত ছিটমহল। লালমনিরহাট জেলার ৫৯টি বিলুপ্ত ছিটমহলের মধ্যে সদর উপজেলায় ২টি, হাতিবান্ধা উপজেলায় ২টি ও বাকি ৫৫টির অবস্থান পাটগ্রাম উপজেলায়।

সারাবাংলা/এমও

ছিটমহল জনপদ লালমনিরহাট সর্বত্রই উন্নয়ন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর