প্যাকেট পার্সেল নিতে পারবে না কুরিয়ার, আসছে আইন
২ আগস্ট ২০২২ ২৩:২৬
ঢাকা: বন্ধ প্যাকেট বা পার্সেল গ্রহণ করা যাবে না— এমন বিধান রেখে ‘মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ’ নামে একটি আইন করতে যাচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে আইনটির চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশ করেছে সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। তবে খসড়া এই আইনটি নিয়ে আপত্তি তুলেছে কুরিয়ার সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (সিএসএবি)।
সংগঠনটি বলছে, খসড়া তৈরির সময় তাদের মতামত নেওয়া হয়নি। আইনটির প্রায় প্রতিটি ধারায় আপত্তি রয়েছে তাদের। আইনটির বেশকিছু ধারা অগণতান্ত্রিক বলেও মনে করছে তারা। দেশের ব্যবসায়ীদের বেশ কিছু সংগঠনও আইনটির খসড়া নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। বন্ধ প্যাকেট বা পার্সেল গ্রহণ করা যাবে না— এমন বিধানের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের ব্যাক্তিগত গোপনীয়তাকে ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
কুরিয়ার সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (সিএসএবি)’র তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ১৫৩টি কুরিয়ার সার্ভিস রয়েছে। এর মধ্যে লাইসেন্সপ্রাপ্ত কুরিয়ার ৭৮টি ও লাইসেন্সবিহীন ৭৫টি। সবগুলো প্রতিষ্ঠানই কুরিয়ার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। বর্তমানে অনলাইন কেনাবেচায় ই-কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কুরিয়ার সার্ভিস আইন হলেও নতুন এই আইনে ই-কুরিয়ারের বিষয়টি অন্তভুর্ক্ত হয়নি।
জানতে চাইলে কুরিয়ার সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (সিএসএবি)’র সভাপতি ও সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস প্রাইভেট লিমিটেডের সত্ত্বাধিকারী হাফিজুর রহমান পুলক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আইনটি করার আগে সরকার আমাদের সঙ্গে বসেনি। তবে খসড়া প্রকাশের পর ৩১ জুলাই বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছে। খসড়া এই আইনের প্রতিটি জায়গায় গড়মিল রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আইনে লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। প্রচলিত আইনে কিছু করা যাবে না। এটি অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত। আমরা এর বিরোধিতা করেছি। প্রতিটি ধারা উপধারায় জেল-জরিমানার কথা বলা হয়েছে, যা অযৌক্তিক। এছাড়া পরিদর্শক নিয়োগের কথা বলা হয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে হয়রানি বাড়বে। খসড়ার ওপর সিদ্ধান্ত জানাতে আমাদের এক মাস সময় দেওয়া হয়েছে।’
বন্ধ পার্সেল গ্রহণ করা না হলে কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহারে গ্রাহকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও অধিকার ক্ষুন্ন হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে চাইলে সিএসএবি’র সভাপতি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা কারও ব্যক্তিগত চিঠি খুলে দেখি না। তবে কুরিয়ারের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে দাফনের কাপড় পাঠানোর মতো ঘটনাও ঘটেছে। সেক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে চিঠি বা পার্সেল পাঠানো হলে তা খুলে দেখা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘কুরিয়ার ব্যবহার করে মাদক, অস্ত্র পরিবহনের ঘটনাওতো বাংলাদেশে ঘটেছে। সেজন্য পার্সেলগুলো আমাদের কুরিয়ার সার্ভিস বুথে প্যাকেট করতে বলা হয়। কুরিয়ার সার্ভিস কাউন্টারে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কথা বলা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে। আমরা তাও মেনে চলছি।’ কুরিয়ার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের এই নেতা এমন কথা বললেও সাধারণ গ্রাহকদের আশঙ্কা নিরাপত্তার নামে আইনে এমন ধারা রাখা হলে তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ক্ষুণ্ন হবে।
বিদেশি কসমেটিস ও প্রসাধনী বিক্রির ফেসবুক পেইজ ‘মেকআপ চারি’র সত্ত্বাধিকারী আতিফ খান। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘কুরিয়ার ব্যবহার করে আমরা যখন কোনো পার্সেল পাঠাই তা প্যাকেটেই থাকে। বরং কোনোভাবেই যাতে ভেতরের পণ্যটি নষ্ট না হয় সেজন্য কয়েকটি স্তরে প্যাকেট করা হয়। কুরিয়ার সার্ভিসের বুথে গিয়ে প্যাকেট করতে হবে এমন বিধান রাখলে কুরিয়ার সার্ভিসগুলো সেবাই দিতে পারবে না। কারণ অনলাইন ব্যবসা করে এমন প্রতিষ্ঠানগুলো দিনে ৭০০ থেকে ১ হাজার পার্সেল করে থাকে। কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর পক্ষে এটি সামাল দেওয়া কঠিন হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যারা অনলাইনে পণ্য কেনাবেচা করি তাদের অফিস থেকে পার্সেলগুলো নিয়ে যায় পাঠাওয়ের মতো অনলাইন কুরিয়ারগুলো। আইনে অনেকগুলো বিষয় স্পষ্ট নয়। হয়তো ধীরে ধীরে তা স্পষ্ট হবে।’
এ প্রসঙ্গে পাঠাওয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফাহিম আহমেদ বলেন, ‘পাঠাও তার গ্রাহকদের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে ও দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবসা পরিচালনা করে। কুরিয়ারের মাধ্যমে যাতে কোনো অপরাধ ও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারেও পাঠাও তৎপর থাকে।’ কুরিয়ার সেবা সংক্রান্ত যেকোনো যুগোপযোগী আইন বা সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে তারা সরকারের পাশে থাকবেন বলেও জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব খুলিলুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এখন মানুষের মতামত চাচ্ছি। খসড়া করার আগে তো কোনো পক্ষের সঙ্গে বসার কথা নয়।’ এই আইনের অধীনে সবধরনের কুরিয়ার সার্ভিসই অন্তভুর্ক্ত হবে বলে মত দেন তিনি। প্রয়োজনে আইনের নামটিও পরিবর্তন হতে পারে বলে ইঙ্গিত দেন সচিব।
জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটি একটি খসড়া। এখন মানুষ মতামত দেবে। খসড়া আইনটি চূড়ান্ত হলে এর ধারা-উপধারা নিয়ে মন্তব্য করা যাবে। খসড়ায় যা ইচ্ছা তা থাকতে পারে, আবার মানুষের মতামতের ভিত্তিতে সেটি পরিবর্তনও হতে পারে।’
খসড়া আইনে যা রয়েছে
আইনে বলা হয়েছে, এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণে মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠিত হবে। এই কর্তৃপক্ষের একজন চেয়ারম্যান থাকবেন, যিনি যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদার হবেন। প্রতিষ্ঠানটি মেইলিং অপারেট ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুমতি দেবে। গ্রাহকের অভিযোগ নিষ্পত্তি এবং অধিকারও সংরক্ষণ করবে প্রতিষ্ঠানটি।
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, কোনো মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধ দ্রব্য, অস্ত্র, মাদকদ্রব্য ইত্যাদি পরিবহন করতে পারবে না। কোনো মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান ছাড়া বা মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স ব্যবহার করে ব্যবসা পরিচালনা করলে ন্যূনতম ৫০হাজার টাকা ও সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা অনূর্ধ্ব তিন মাস কারাদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবে। সেবার মূল্য তালিকা এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়সহ সকল শাখা কার্যালয়ে সহজে দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শন করতে হবে। অন্যথায় অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা অনূর্ধ্ব এক মাসের কারাদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবে। এছাড়া নির্ধারিত মূল্যের অধিক দাম রাখলে ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা অনূর্ধ্ব এক মাসের কারাদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
এই আইনের অধীনে লাইসেন্স ব্যবহার করে কোনো পার্সেল বা প্যাকেটের ভেতর কোনো ধরনের নগদ অর্থ বা বৈদেশিক মুদ্রা গ্রহণ বা পরিবহন করা যাবে না। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান এই শর্ত ভঙ্গ করে তাহলে ন্যূনতম ৫০হাজার টাকা ও সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা অনূর্ধ্ব তিন মাস কারাদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবে। নির্ধারিত সময়ে সরকারের অনুকূলে প্রাপ্য সার্ভিস চার্জ জমা না দিলে ন্যূনতম ২০ হাজার টাকা ও সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা অনূর্ধ্ব এক মাস কারাদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবে। এছাড়া সার্ভিস চার্জ ফাঁকি দিলে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে এই আইনে।
আইনে আরও বলা হয়েছে, কোনো মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান যদি বুকিংকালে বন্ধ প্যাকেট বা পার্সেল গ্রহণ করে সেক্ষত্রে ন্যূনতম ২০ হাজার টাকা ও সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা অনূর্ধ্ব দুই মাসের কারাদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম