শেখ হাসিনার কাছ থেকে পাকিস্তানকে শেখার পরামর্শ
৩ আগস্ট ২০২২ ২০:৩০
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে দেশটির ‘দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন’ পত্রিকায় তুলনামূলক আলোচনা করেছেন পাকিস্তানের খাইবার পাখতুন প্রদেশের সাবেক মুখ্য সচিব সাহিবজাদা রিয়াজ নূর। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করা এই লেখক একজন কবিও। তার লেখা সমসাময়িক এই নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন সারাবাংলার নিউজরুম এডিটর আতিকুল ইসলাম ইমন।
বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, যার কৃতিত্ব দেশটির নেতৃত্বকে দেওয়া যেতে পারে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু উদ্বোধন করে এটিকে ‘গর্ব ও সামর্থ্যের প্রতীক’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। নব্বইয়ের দশকে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সেসময় তিনি রাজনৈতিক প্রভাবের সঙ্গে অর্থনৈতিক নীতির ভারসাম্য তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা তার বাবার সমাজতান্ত্রিক এজেন্ডা থেকে বাজারভিত্তিক পুঁজিবাদী প্রবৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করেন। এশিয়ার অন্যান্যে দেশের অর্থনৈতিক সাফল্য চারটি স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে। সেগুলো হলো— রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক উন্নয়ন, বাণিজ্য উদারীকরণ ও আর্থিক সংযম। শেখ হাসিনা সেইসব দেশের অভিজ্ঞতা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন।
একটি সম্মেলন একজন অর্থনীতিবিদ শেখ হাসিনাকে বাণিজ্য উদারীকরণের সুবিধা সম্পর্কে জানাতে শুরু করেন, তখন তিনি বলেন, ‘আমাকে বাণিজ্য উদারীকরণের বিষয়ে বোঝাতে হবে না। আমি যখন যুগোস্লাভিয়ান সীমান্তের ইতালীয় শহর ট্রিয়েস্টে আমার পদার্থবিদ স্বামীর সঙ্গে থাকতাম, তখন দেখেছি সীমান্ত সপ্তাহে তিন বার খোলা হচ্ছে। এবং দুপাশ থেকে মানুষ যাতায়াত করছে, পণ্য ক্রয় করছে এবং ফিরে যাচ্ছে।— এটি প্রমাণ করে যে শেখ হাসিনা রাজনীতিবিদদের আকৃষ্ট করে এমন অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে অর্থনীতিতে বেশি মনোযোগী।
যদিও ১৯৭১ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে জবাবদিহিতামূলক রাজনীতি এবং সামরিক শাসনের মধ্যে টানপোড়েন চলছিল। তবে ২০০৯ সাল থেকে দেশটির সেনাবাহিনী আর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেনি। এমনকি বাংলাদেশে বেসামরিক সরকার ঘন ঘন পরিবর্তন হয়নি। ফলে সরকারগুলোর বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠে। যদিও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাস অজানা নয়। তবে বাংলাদেশের সরকার দুর্নীতি ও অদক্ষতার বিষয়ে জনসাধারণের সমালোচনা এড়িয়ে গেছে। শাসন ব্যবস্থায় স্বল্প অভিজ্ঞতা থাকার পরও প্রধানমন্ত্রীর তীক্ষ্ণ দূরদর্শিতা এবং দৃঢ় প্রত্যয় থেকে তিনি জানতেন, অর্থনৈতিক অগ্রগতিই দেশের দারিদ্র্য বিমোচনের একমাত্র উপায়।
বল প্রয়োগের জন্য বিরোধীদের অভিযোগের পরও ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে অব্যাহত প্রবৃদ্ধির পর বাংলাদেশ বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তানের তুলনায় ৭৫ শতাংশ বেশি দরিদ্র ছিল। কিন্তু এখন দেশটিতে পাকিস্তানের চেয়ে ৪৫ শতাংশ বেশি ধনী। ২০২১ সালে বাংলাদেশের রফতানি ছিল ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর একই বছর পাকিস্তানের রফতানি ছিল ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় যেখানে ১ হাজার ৫৪৩ মার্কিন ডলার, সেখানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার। ২০২২ সালে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৪১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। একই বছর পাকিস্তানের জিডিপি ৩৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার বাংলাদেশে ৬ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ, যা এখন ২১ শতাংশে পৌঁছেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে পাকিস্তানের বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার আরও বাড়বে। এছাড়াও পাকিস্তানি রুপির তুলনায় বাংলাদেশি টাকা অনেক বেশি শক্তিশালী। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বেশি।
পাকিস্তানে রাজনৈতিক দলগুলো ব্যক্তিগত লাভের জন্য মরিয়া। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বারবার হস্তক্ষেপের কারণে শক্তিশালী, গণতান্ত্রিক দলগুলোর বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এটা স্বীকার করতেই হবে যে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইনের শাসন, শক্তিশালী বেসামরিক প্রতিষ্ঠান এবং অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। পাকিস্তান উত্তরাধিকারসূত্রে একটি অতি-উন্নত রাষ্ট্র পেয়েছিল। একটি দুর্বল বুর্জোয়া রাষ্ট্র হয়ে আরেকটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের সঙ্গে প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্কে যুক্ত ছিল পাকিস্তান। দেশটি অনিবার্যভাবে বিশেষাধিকার এবং পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে। কৃষি এবং ব্যবসায়িক আয় প্রাথমিকভাবে করজাল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। প্রগতিশীল সম্পদ কর ছাড় এবং বিশাল শিল্প ও এস্টেট কমপ্লেক্সগুলোকে শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। পাকিস্তানের পার্লামেন্টে জমিদারদের আধিপত্যের কারণে প্রাদেশিক সরকারগুলো কৃষি আয়কর বিষয়টি বরাবরই প্রত্যাখ্যান করেছিল। ফলে দেশটির করজাল অনেক ছোট।
১৯৫৮ সাল থেকে সরকারি নীতি নিয়ে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেবল সামন্ত শক্তির ক্ষমতা বাড়িয়েছে। এতে জনসাধারণের কোনো লাভ হয়নি। পাকিস্তানে যে উন্নয়নের পথ অনুসরণ করা হয়েছে তা সুবিধাভোগী, ধনী এবং অভিজাতদের পক্ষে ছিল। এখন সেই সামন্ত শক্তিকেই দেশের জন্য অবদান রাখতে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশের উদাহরণ অনুসরণ করে পাকিস্তানি নেতৃত্বকে অবশ্যই জাতীয় এজেন্ডা হিসাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সামনে রাখতে হবে এবং আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে সাংবিধানিক সরকার পরিচালনা নীতি গ্রহণ করতে হবে। কার্যকর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে আপস না করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ বাড়াতে হবে। প্রবৃদ্ধির জন্য বাণিজ্য উদারীকরণের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে ভারত, ইরান, চীন, আফগানিস্তান এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক অংশীদারদের সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়াতে হবে। এছাড়াও রফতানি বৃদ্ধির মডেল অনুসরণ করে উচ্চ-মূল্যের পণ্য রফতানির উপর পুনরায় দৃষ্টি দিতে হবে।
পাকিস্তান বরাবরই সস্তা শ্রমের সুবিধা ভোগ করে থাকে। তবে দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এতে পরিবর্তন আনতে হবে। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য নারীদের জন্য শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ ও প্রচার করতে হবে। এছাড়াও বিদেশি বিনিয়োগের জন্য একটি নিরাপদ এবং আইনগতভাবে অনুকূল পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কৃষি আয়ের উপর ন্যায্য কর আরোপের জন্য নতুন প্রচেষ্টা প্রয়োজন। ধনী শিল্পগোষ্ঠীগুলোকে অবশ্যই জাতীয় সম্পদ বাড়াতে যথাযথ অবদান রাখতে হবে। বৃহৎ করপোরেট ও এস্টেট খাতগুলোকে করজালের আওতায় আনতে হবে। পাকিস্তানের নেতৃত্বকে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছু শিখতে হবে। তবে প্রধান পদক্ষেপটি হওয়া উচিত শেখ হাসিনা যেভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন সে পথ অনুসরণ। প্রতিরক্ষা এবং গণতন্ত্রের জন্যই এটি গুরুত্বপূর্ণ।
সারাবাংলা/আইই/পিটিএম