রাজধানীতে একমাসে শতাধিক ছিনতাই, অভয়ারণ্য কারওয়ানবাজার-ফার্মগেট
৫ আগস্ট ২০২২ ২০:০৩
ঢাকা: গত মাসে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্ট শতাধিক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের কাছে জমা পড়া বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ, ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকার ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য থেকে এ সব জানা গেছে। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে— ছিনতাইকারীদের সবচেয়ে অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে কারওয়ান বাজার সার্ক ফোয়ারা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত দুই দিকের সড়ক আর অলিগলি।
ছিনতাইয়ের তথ্য পর্যালোচনা করে জানা গেছে—রাজধানীর কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, তেজগাঁও, সাতরাস্তার মোড়, তেজকুনি পাড়া, ইন্দিরা রোড, পান্থপথ, বাংলামোটর, মগবাজার, মালিবাগ, খিলগাঁও, দয়াগঞ্জ, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, তাঁতী বাজার, গুলিস্তান, মতিঝিল, গোলাপ শাহ মাজার, ফুলবাড়ীয়া, চাঁনখার পুল মোড়, বকশীবাজার, নীলক্ষেত, ধানমন্ডি, মহাখালী, গুলশান বাড্ডা লিঙ্ক রোড, বাড্ডা, সুবাস্তু টাওয়ারের সামনের সড়ক, রামপুরা ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, বাসাবো, বনশ্রী, মিরপুর-১, চিড়িয়াখানা সড়ক, রূপনগর, মিরপুর-১০, মিরপুর-১১, পল্লবী, উত্তরা, দক্ষিণ খান ও কামার পাড়া এলাকায় চলছে ছিনতাইকারী চক্রের অবাধ বিচরণ। গত এক মাসে এ সব এলাকায় অন্তত শতাধিক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।
গুলশান থানা, রামপুরা থানা, যাত্রাবাড়ী থানা, তেজগাঁও থানা, শেরেবাংলা নগর থানা, শাহবাগ থানা, মতিঝিল থানা, উত্তরা পশ্চিম থানা, মিরপুর মডেল থানা, পল্লবী থানা, ওয়ারী থানা ও পল্টন থানাসহ বেশ কয়েকটি থানায় ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া ভুক্তভোগীদের করা মামলা ও জিডির কপি সারাবাংলার হাতে এসেছে।
ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া ভুক্তভোগীদের অভিযোগ— রাজধানীর প্রতিটি স্থানে এই মুহূর্তে বড় আতঙ্কের নাম ছিনতাইকারী। বেপরোয়া ছিনতাইকারীদের ভয়ে পথচারীদের তটস্থ হয়ে চলাফেরা করতে হয়। শুধু সন্ধ্যা বা রাত নয় ভোর কিংবা সকাল নয় বরং দিনের বেলায়ও প্রকাশ্যে ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা।
তথ্য বলছে বৃহস্পতিবার (৪ আগস্ট) দিবাগত রাত ১০ টার দিকে রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের সামনে ছিনতাইয়ের শিকার হন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সভাপতি, দৈনিক ইত্তেফাকের বিশেষ প্রতিবেদক জামাল উদ্দিন। এ সময় ছিনতাইকারীরা অস্ত্র ঠেকিয়ে জামাল উদ্দিনের ল্যাপটপ, মোবাইল, মানিব্যাগসহ মূল্যবান কাগজপত্র নিয়ে যায়। এ বিষয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলাও করেছেন ভুক্তভোগী জামাল উদ্দিন।
একই রাতে (৪ আগস্ট) মতিঝিলে বর্ষ হাবিব লিপি নামে একজন আইনজীবী ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। তিনি মোবাইল ফোন, টাকা-পয়সা খুঁইয়েছেন। এ বিষয়ে থানায় জিডিও করেছেন ভুক্তভোগী আইনজীবী।
একইদিন উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায় মোটরসাইকেলযোগে এসে ছিনতাইকারী হাঁটতে থাকা এক শিক্ষার্থীর মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। পরে ওই শিক্ষার্থী দৌড়ে মোটরসাইকেলটি ধরে ফেলেন। এ সময় ছিনতাইকারী তাকে টেনে হেঁচড়ে অনেক দূর নিয়ে যায়। পরে তার চিৎকারে আশেপাশের লোকজন এসে ছিনতাইকারীকে পাকড়াও করেন।
পুলিশ জানিয়েছে, ওই ছিনতাইকারীর নাম পায়েল। সে তুরাগ থানায় দায়ের করা একটি গণধর্ষণ মামলার আসামি। জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে পেশা হিসেবে ছিনতাইকে বেছে নিয়েছিল।
গত ২১ জুলাই সন্ধ্যার পর সার্ক ফোয়ারা থেকে ফার্মগেটের দিকে বাসে করে বাসায় ফিরছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী পারিশা আক্তার। এ সময় জানালা দিয়ে একজন ছিনতাইকারী তার হাতে থাকা মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়।
পরে চোখের সামনে অন্য একটি ছিনতাই হতে দেখে পারিশা আরেক ছিনতাইকারীকে ধরে কিল-ঘুষি দিতে থাকে। তার বুকের ওপর বসে গলা টিপে ধরেন। তার সাহসিকতার সেই দৃশ্য নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়।
পারিশার ফোন ছিনতাইয়ের ঘটনায় থানায় মামলা হয়। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। মাত্র কয়েকদিনেই পুলিশ পারিশার ফোনটি উদ্ধার করে। একইঙ্গে সেই ছিনতাইকারীকেও গ্রেফতার করে পুলিশ।
গত ৩ আগস্ট তেজগাঁও থানা পুলিশ সাংবাদিকদের জানায়, গত এক মাসে তেজগাঁও পুলিশ অন্তত দেড়শর মতো মোবাইল ফোন উদ্ধার করেছে। প্রায় প্রতিদিনই ছিনতাইকারীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। জামিনে বেরিয়ে তারা একই কাজ করছে। পারিশার ফোনটি যে নিয়েছিল সে ১৬ জুলাই জামিনে বের হয়ে ২১ জুলাই পারিশার ফোন ছিনতাই করে। আবার ২৯ জুলাই আরেক মামলায় কারাগারে যায়। অন্য এক ছিনতাইকারী জানায় পারিশার ফোনটি যে টান দিয়েছিল সে কারাগারে। পরে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে তাকে রিমান্ডে নিয়ে ফোন উদ্ধার করা হয়।
পারিশা শুক্রবার (৫ আগস্ট) সারাবাংলাকে বলেন, ‘সার্ক ফোয়ারা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত সড়কের দুপাশে বড় বড় অট্টালিকা। দুই দিকেই অসংখ্য অন্ধকার গলি, পুরো সড়কের ওপরে মেট্রোরেলের নির্মাণযজ্ঞ এবং মেট্রোরেল স্টেশন। সড়কের কোথাও পুলিশ ছিল না। এত অন্ধকার আর নীরব সড়কে পুলিশ কেন একটু পরপর টহল দেয় না সেটি বুঝে আসে না।’
পারিশা বলেন, ‘পুলিশের টহল না থাকার কারণেই ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ছিনতাই বন্ধে সবার আগে পুলিশি তৎপরতা জরুরি হয়ে পড়েছে।’
গত ২৫ জুলাই গুলশানের বেসরকারি একটি কোম্পানিতে কর্মরত এক নারী বাসায় ফেরার সময় রামপুরা ব্রিজের পাশ থেকে তার হাতে থাকা আইফোনটি ছিনিয়ে নেয় এক ছিনতাইকারী। থানায় গেলে তাকে একটি জিডি করিয়ে নেয় পুলিশ। তবে এখনও তার ফোনটি উদ্ধার হয়নি।
গত ২৯ জুলাই বাড্ডা সুবাস্তু টাওয়ারের সামনে থেকে দেশীয় অস্ত্র ঠেকিয়ে তিতুমীর কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রাতুলের কাছে থাকা দামি ফোনটি নিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। পরে তিনি গুলশান থানায় একটি জিডি করেছেন। তার ফোনটি এখনো উদ্ধার হয়নি।
অধিকাংশ ভুক্তভোগীর অভিযোগ, কোনো রাজনৈতিক সমাবেশ উপলক্ষে যত পুলিশ মোতায়েন থাকে তার একভাগ পুলিশও অন্য সময় থাকে না। দিনে বা রাতে টহল পুলিশ চোখে পড়ে না। সড়কে পুলিশের টহল বাড়ানো হলে ছিনতাইকারীদের প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছিনতাই হচ্ছে অস্বীকার করার কিছু নেই। পুলিশও কাজ করছে। আসামিও ধরা পড়ছে। হারানো দ্রব্যাদি উদ্ধার হচ্ছে। গত কয়েক মাসে শত শত ফোন উদ্ধার করা হয়েছে।’
ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘এলাকায় টহল পুলিশ কাজ করছে। এরপরও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।’ ছিনতাই প্রতিরোধে পুলিশের পাশাপাশি জনগণকেও সতর্ক থাকতে হবে বলে মনে করে ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম।
সারাবাংলা/ইউজে/একে