তেলের দাম বাড়ার পেছনে যে যুক্তি দেখালো জ্বালানি বিভাগ
৬ আগস্ট ২০২২ ১৭:২৪
ঢাকা: লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর আট মাসের মাথায় এসে ডিজেলে আরও ৩৪ টাকা বাড়ানো হলো। শুধু ডিজেলই না অকটেন, পেট্রল, কেরোসিন কোনোটির দামই লিটারে ৩০ টাকার নিচে রাখা হয়নি। শুক্রবার (৫ আগস্ট) মাঝ রাতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এই তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসার পর থেকেই এক রকম উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের জনগণ। পরিবহনখাত সংশ্লিষ্ট থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত গাড়ি চালকরাও ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন। সমালোচনা করছেন দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাও, ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।
এই পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা তুলে ধরেছে সরকার। সেখানে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যের উর্ধ্বগতিকেই দায়ী করা হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, এই পরিস্থিতিতে তেলের দাম বাড়ানোর বিকল্প কোনো পথ ছিল না।
জ্বালানির সবশেষ দাম বাড়ানো হয় গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর। প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে কেবল ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়। জ্বালানি বিভাগ এই দাম বাড়ানোর যুক্তি দেখাতে গিয়ে বলছে, ওই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির প্রবনতা থাকার পরও অকটেন প্রেটোলের দাম বাড়ানো হয়নি। সেখানে বলা হয় ২০২১-২২ অর্থ বছরের শুরুর দিকে কোভিড-১৯ কিছুটা কমে এলে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়তে থাকে। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর পরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। যা এখনও বাড়ছেই।
গত বছরের ডিসেম্বরে ডিজেলের দাম ৮৩.৩৫ ডলার ছিল প্রতি ব্যারেল। আর অকটেন ছিল ব্যারেল ৮৫.২৫ ডলার। চলতি বছরের জানুয়ারিতে এই দাম ৯৬.৯৫ ডলারে পৌঁছায় আর অকটেনে বেড়ে হয় ৯৩.৪৩ ডলার। ফেব্রুয়ারিতে ডিজেল ১০৮.৫৫, অকটেন ১০৮.৪ ডলার। মার্চে ডিজেল ১৩৭.৫৪, অকটেন ১২৭.৩৬ ডলার। এপ্রিলে ডিজেল ১৪৪.৬৮ , অকটেন ১২২.৬১ ডলার। মে মাসে ডিজেল প্রতি ব্যারেল ১৪৭.৭০, অকটেন ১৪০.৯৬ ডলার। জুন মাসে ডিজেল ১৭০.৭৭ ডলার আর অকটেন ১৪৮.৪৪ ডলার এবং সবশেষ জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের দাম প্রতি ব্যারেল কিছুটা কমে ১৩৯.৪৩ এবং অকটেনে ১১৪.৪৪ ডলারে দাঁড়ায়।
জ্বালানি বিভাগ বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৭৪.৪ মার্কিন ডলার এবং অকটেন প্রতি ব্যারেল ৮৪.৮৪ ডলারে নেমে এলে এই দুই ধরনের জ্বালানি যথাক্রমে ৮০ এবং ৮৯ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব। যা বর্তমান মূল্যে কোনোভাবেই সম্ভব না। জ্বালানি বিভাগ বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রুড অয়েলের মূল্যও জুন মাসে ব্যারেল প্রতি ১১৭ মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায় যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
দেশের জ্বালানি তেল সরবরাহ করে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসি। জ্বালানি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, জ্বালানি তেল আমদানিতে গত জুলাই মাসে গড় প্লাটস রেট অনুযায়ী বিপিসির দৈনিক লোকসানের পরিমাণ ডিজেলে প্রায় ৭৪৯ কোটি ৪৯ লাখ ২ হাজার ৭০০ টাকা এবং অকটেনে প্রায় ২ কোটি ৯২ লাখ ২৩ হাজার ২১৬ টাকা। সবমিলিয়ে ৭৭৮ কোটি ৭১ লাখ ৫ হাজার ৯১৬ টাকা।
গত মে ও জুন মাসেও লোকসানের পরিমাণ ছিল ১শ কোটি টাকার ওপরে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত লোকসানের পরিমাণ ৮ হাজার ১৪ কোটি টাকার ওপরে। বর্তমানে ডিজেলে যে মূল্য বাড়ানো হয়েছে তারপরেও প্রতি লিটারে লোকসান গুনতে হবে ৮ টাকা ১৩ পয়সা।
আরও বলা হয়, আন্তজার্তিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বিপিসির আর্থিক সক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে। জ্বালানি পণ্যের বর্তমান হারে তেল বিক্রিয় ও অন্যান্য আয় খাতে গড়ে বিপিসির মাসিক আয় প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে ঋণপত্র পেমেন্টসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় জুলাই মাসে ১০ হাজার ৩১২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। বিপিসির জ্বালানি তেলের অর্থায়নের জন্য ২ মাসের আমদানি মূল্যের সমান হিসেবে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা চলতি মূলধন হিসেবে সংস্থান রাখা জরুরি। বর্তমানে মূলধন কমে যাওয়ায় গত মার্চ মাস থেকে এখন পর্যন্ত উন্নয়ন প্রকল্প ও বিবিধ খাত থেকে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা তুলে ভর্তুকিসহ জ্বালানি তেলের মূল্য পরিশোধ করা হয়।
আরও বলা হয় বর্তমান পরিস্থিতিতে যে অর্থ রয়েছে তা দিয়ে জ্বালানি আমদানি করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপিসির জন্য জাতীয় বাজেটে কোনো অর্থ সংস্থান রাখা হয় না বলে জানায় জ্বালানি বিভাগ। এই পরিস্থিতিতে জ্বালানির মূল্য সমন্বয়ের মাধ্যমে বিপিসির আর্থিক অবস্থা স্থিতিশীল রাখা জরুরি বলে উল্লেখ করা হয়।
সারাবাংলা/জেআর/একে