সংবিধানে ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতির দাবি পাহাড়িদের
৯ আগস্ট ২০২২ ০৭:৫৯
রাঙ্গামাটি: আজ ৯ আগস্ট, আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি উদযাপিত হয়ে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ অন্যান্য ভাষাভাষি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ দিবসটি পালন করে আসছেন। এবারও পাহাড়ি জেলা রাঙামাটিতে দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস-২০২২ রাঙামাটি জেলা উদযাপন কমিটি।
এদিকে, সংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের বাঙালি জনগোষ্ঠী ব্যতিত অন্য জাতিগোষ্ঠীকে সংবিধানে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃগোষ্ঠী উল্লেখ করা হলেও ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি চান চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ অন্যান্য জাতির মানুষ। যাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে। তবে আধুনিকতার ভিড়ে নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে হারাতে বসেছে অনেক জাতিগোষ্ঠী। বিশেষত বিবাহ, বিভিন্ন প্রাচীন খেলাধূলাসহ রীতিনীতি বিলুপ্তপ্রায়। তবে এসব সংরক্ষণের জন্য নিজেদের চর্চা বাড়াতে হবে মনে করেন জাতিসত্তার মানুষ। একইসঙ্গে তারা সংবিধানে সম্মানজনক হিসেবে ‘আদিবাসী’ হিসেবে নিজেদের স্বীকৃতি চান।
রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী রিকোর্স চাকমা বলেন, ‘আমাদের বাপ-দাদারা দীর্ঘকাল ধরে পাহাড়ে বসবাস করে আসছেন। আমাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে। জাতি হিসেবে আমরা সমৃদ্ধ। কিন্তু আমাদের সংবিধানে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা উল্লেখ করে অপমান করা হয়েছে।’
উন্নয়ন ও নারী অধিকারকর্মী নুকু চাকমা বলেন, ‘আধুনিকতার ছোঁয়ার ছাপ চাকমা কালচারেও লেগেছে। বিশেষত গ্রামের বিবাহ রীতিতে যে নিয়মগুলো মানা হতো, এখন শহর অঞ্চলের বিবাহ অনুষ্ঠানগুলো কমিউনিটি সেন্টারে হওয়ার কারণে অনেক নিয়মনীতিই সঠিকভাবে মানা হচ্ছে না। আবার ঘিলাখেলাসহ চাকমাদের অনেক প্রাচীন খেলা রয়েছে। যেগুলো দিনদিন কমছে, অনেক ছেলেমেয়েরা তো এখন ঘিলা কী? সেটাই চিনেন না। বন উজাড়ের কারণে ঘিলাও পাওয়া যায় সবখানে।’
স্থানীয় বাসিন্দা ক্যামেলিয়া দেওয়ান জানান, বাংলাদেশের সংবিধানে আমাদের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বলা হয়েছে, যা আমাদের জন্য অপমানজনক। আমরা আদিবাসী মানুষ, আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতি রয়েছে। এগুলো আমাদের ঐতিহ্যকে বহন করে। আমরা সংবিধানে আমাদেরকে আদিবাসী স্বীকৃতির দাবি জানাই। কাউকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলে বৃহৎ জাতগোষ্ঠীর মানুষ নিজেকে বীরত্ব প্রমাণের সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক ইন্টুমনি তালুকদার বলেন, “এবারের আদিবাসী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘ঐতিহ্যগত বিদ্যা সংরক্ষণ ও বিকাশে আদিবাসী নারী সমাজের ভূমিকা’। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে আদিবাসী দিবস উপলক্ষে র্যালিসহ নানান আয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশে মোট ৫৪টি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করে আসছেন, আমরা তাদের মৌলিক ও সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য দাবি জানিয়ে আসছি। সরকার আদিবাসীদের নিয়ে ‘সংবিধানসম্মত শব্দ চয়ন প্রসঙ্গে’ যে আদেশ জারি করেছে আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।”
এদিকে, সম্প্রতি গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান বলেন, “বাংলাদশ একটি বহুজাতি, ধর্ম ও সংস্কৃতির দেশ। পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনীর সময় এ বিষয় যথাযথভাব মীমাংসার সুযাগ থাকলেও ‘আদিবাসী’দের দাবি উপক্ষা কর উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায় শব্দগুছ সন্নিবেশ করা হয়েছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী একটি অপমানজনক শব্দ। ‘ক্ষুদ্র’ বলার মধ্য দিয়ে সেই জাতিগোষ্ঠীর লোকজনকে চরমভাবে হেয় করার সামিল যা সংবিধান পরিপন্থী। সংখ্যায় কম হোক কিংবা বেশি হোক, কোন জাতিগাষ্ঠী কখনো ক্ষুদ্র বা বৃহৎ হিসেবে পরিচিত হতো পারে না। কোন জাতিগাষ্ঠী কী নাম পরিচিত হতে চায়, সেটা আইন দিয়ে নির্ধারণ করা যায় না। আত্মপরিচিতিই যে কোন জাতিগাষ্ঠী পরিচিতি নির্ধারণর মানদণ্ড।”
পাহাড়ের চাকমা জাতিগোষ্ঠীর সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় মনে করেন, সংবিধানে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা উল্লেখ থাকলেও আদিবাসী স্বীকৃতির দাবি পাহাড়িদের এবং এটি যৌক্তিক। তবে গণমাধ্যমে তথ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া আদেশে ‘সংবিধানসম্মত শব্দ চয়নের’ যে কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেটিই সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে করে করেন চাকমা প্রধান।
রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, ‘সংবিধানে কিছু বাধা নিষেধের কথা উল্লেখ রয়েছে, এই বাধা নিষেধগুলো আপনি দিতে পারেন আইনের ধারায়। কিন্তু কোথায় তো আমরা দেখিনি ওমুক শব্দ ব্যবহার করতে পারবেন না, ওমুক শব্দ ব্যবহার করতে আপনি বাধ্য। সাধারণ কথায় যদি বলি, সংবিধানে তো ধর্মীয় কিংবা জাতিগত সংখ্যালঘু শব্দটিও নেই। তার মানে সংবিধানে নেই বলে সংখ্যালঘু শব্দ ব্যবহার করলে কেউ রাষ্ট্রবিরোধী হয়ে যাচ্ছে?’
সারাবাংলা/এমও