সুন্দরবনে ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলতে পারবে না
৯ আগস্ট ২০২২ ০৯:২৫
ঢাকা: কোনো অবস্থাতেই সুন্দরবনের অভ্যন্তরে সংরক্ষিত ও সুসংরক্ষিত এলাকার খালের ভেতরে কোনো প্রকার ইঞ্জিন চালিত নৌকা বা ট্রলার চলাচল করতে পারবে না বলে নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে জেলেরা বৈঠা চালিত নৌকা এবং ‘দোন দড়ি’র মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণ ওজনের কাঁকড়া সুন্দরবনের ভেতর থেকে আহরণ করতে পারবেন।
মো. জাহান আলী গাজী এবং অন্যান্য বনাম বাংলাদেশ সরকার গং মামলার রায়ে হাইকোর্ট এমন নির্দেশনা দিয়েছেন। গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে।
বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ১৪ পৃষ্ঠার ওই রায় ঘোষণা করেন।
আদালতে রিটের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আল-ফয়সাল সিদ্দিক। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সেলিম আজাদ, মো. সিরাজুল আলম ভূঁইয়া ও মো. দেলোয়ার হোসেন।
রায়ে কিছু অভিমতসহ ৭ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এর আগে ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় সুন্দরবন এলাকার কয়েকজন জেলে ও ইঞ্জিনচালিত নৌকার মালিক রিটটি দায়ের করেন। রিটে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রধান বন সংরক্ষক, খুলনা বিভাগীয় বন সংরক্ষক, বাগেরহাট জেলাধীন সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়।
হাইকোর্টের রায়ের সাত দফা নির্দেশনাগুলো হলো:
(ক) রিটকারীরাসহ জেলেরা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য সুন্দরবনের সংশ্লিষ্ট স্টেশন অফিসে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব প্রদান করে পাস (অনুমতি) সংগ্রহ করে কেবলমাত্র বৈঠা চালিত নৌকা এবং ‘দোন দড়ির’ মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণ ওজনের কাঁকড়া আহরণ করতে পারবেন।
(খ) কোনো অবস্থাতেই সুন্দরবনের অভ্যন্তরে সংরক্ষিত ও সুরক্ষিত এলাকার খালের ভেতরে কোনো প্রকার ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলার চলাচল করা যাবে না। এজন্য বন বিভাগসহ সুন্দরবনের অভ্যন্তরে চলাচলকারী আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে।
(গ) পাস নিয়ে কাঁকড়া আহরণের জন্য সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবেশের সময় বন বিভাগের স্টেশন অফিস থেকে কঠোরভাবে সংশ্লিষ্ট নৌকা ও নৌকার লোকদের পরীক্ষা করতে হবে। যাতে কোনো প্রকার ‘চারু (কাঁকড়া ধরার জন্য বাঁশের শলা দ্বারা নির্মিত চাই, যা স্থানীয়ভাবে চারু নামে পরিচিত) এবং ‘বিষ’ কিংবা অন্য কোনো বেআইনি জিনিস বনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করাতে না পারে। এ ক্ষেত্রে দিনেরবেলায় তাদের নৌকা পরীক্ষা করে সুন্দরবনের প্রবেশের অনুমতি প্রদান সমীচিন হবে।
(ঘ) প্রতিটি নৌকা পাস নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশকালে তাদের জন্য কী কী করণীয় এবং কী করা দণ্ডনীয় সে সম্পর্কিত হ্যান্ডবিল/পোস্টার সরবরাহ করা যেতে পারে।
(ঙ) যেহেতু সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবাহিত নদী ও খালগুলো থেকে মাছ আহরণ করে তা জেলে পল্লী দুবলা থেকে সংগ্রহ করে ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলারের মাধ্যমে পরিবহন করে বাজারজাতকরণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সেহেতু অনুরুপভাবে বৈঠাচালিত নৌকা দ্বারা কেবলমাত্র ‘দোন দড়ি’ পদ্ধতিতে কাঁকড়া আহরণ করে তা দুবলা জেলে পল্লীসহ সুন্দরবনের অভ্যন্তরে অন্য যেকোনো স্বীকৃত স্থানে যেখানে ইঞ্জিনচালিত নৌকার/ট্রলারের যাতায়াতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, সেখান থেকে সংগ্রহ করে দ্রুত বাজারজাতকরণের জন্য ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলারে পরিবহনের অনুমতি দিতে হবে। সেক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত ইঞ্জিনচালিত নৌকার/ ট্রলারের কাঁকড়া পরিবহনের জন্য সুনির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করতে হবে এবং ওই সকল ইঞ্জিনচালিত নৌকা/ট্রলার সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবেশকালে স্থানীয় স্টেশন অফিস কর্তৃপক্ষ উক্ত নৌকা/ট্রলার কঠোরভাবে পরীক্ষা করে সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতি দেবে, যাতে কোনো প্রকার বেআইনি জিনিস যা সুন্দরবনের জীববৈচিত্র ও উদ্ভিদ বৈচিত্র ধ্বংস করতে পারে, তা যেন সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করাতে না পারে।
(চ) সুন্দরবন সংলগ্ন স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, কৃষি বিভাগ, মৎস্য বিভাগ ও বন বিভাগের কর্মকর্তাবৃন্দের নিয়মিতভাবে সুন্দরবন সংলগ্ন স্থানীয় বাজার, ঔষধের দোকানসহ কৃষির জন্য সার, ঔষধ ও বীজ বিক্রির দোকানগুলিতে অনুসন্ধান করতে হবে যাতে ওই এলাকায় অননুমোদিত কোন বিষ বিক্রি করা না হয়।
(ছ) পাস সংগ্রহ করে সুন্দরবন অভ্যন্তরে প্রবেশকালে কিংবা সুন্দরবনে অবস্থানকালে কাঁকড়া জেলেসহ মৎস্য জেলে এবং অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাছে কোনোরুপ বেআইনি দ্রব্য পাওয়া গেলে তাদের কঠোরভাবে আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
এ ছাড়া বিষ নিয়ে মাছ শিকার করলে কিংবা চারু পদ্ধতির মাধ্যমে কাঁকড়া শিকার করলে ওই নৌকার সকল আরোহীকে প্রয়োজনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সুন্দরবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, সুন্দরবন বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট (Mangrove Forest) যা বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাংশের জনগোষ্ঠীকে ঝড় জলোচ্ছাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে স্মরণাতীতকাল থেকে ঢাল হিসেবে নিজেকে ব্যবহার করে জনজীবনকে স্বাভাবিক রাখছে। সুন্দরবন প্রকৃতির এক অপরুপ সৃষ্টি। এ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এক বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার একমাত্র মাধ্যম সুন্দরবন এবং এই বন থেকে আহরিত বনজ ও জলজ সম্পদ বাজারজাত করে তাদের জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে।
আদালত বলেন, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র এবং উদ্ভিদ বৈচিত্র রক্ষা সুন্দরবন রক্ষার জন্য কারো কোনো অন্যায় দাবির সঙ্গে কোনোভাবেই আপস করা যাবে না। সুন্দরবন বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের এক বিরাট জনগোষ্ঠীর জীবন রক্ষা ও জীবিকা নির্বাহের একমাত্র মাধ্যম এবং জাতীয় সম্পদ। সুন্দরবন অক্ষুণ্ণ থাকলে ওই বিরাট জনগোষ্ঠী বেঁচে থাকবে এবং সর্বোপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকেও ওই অঞ্চল রক্ষা পাবে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত আরও বলেন, সুন্দরবন আমাদের জাতীয় সম্পদ। সুন্দরবন আমাদের গর্ব ও অহংকার। সুন্দরবন আমাদের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনপথকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে প্রতিনিয়ত বাঁচিয়ে রাখছে। সুন্দরবনকে স্ব মহিমায় বাঁচিয়ে রাখার জন্য যা কিছু করা দরকার, তা আমাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে করতে হবে এবং একে আমাদের জাতীয় স্বার্থ হিসাবে দেখতে হবে। সুন্দরবন রক্ষার জন্য তথা সুন্দরবনের জীববৈচিত্র এবং উদ্ভিদ বৈচিত্র রক্ষার জন্য সরকারি বেসরকারিভাবে ব্যাপক প্রচারণার দরকার।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়, এক্ষেত্রে আমাদের অভিমত হলো সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীকে সরাসরি সম্পৃক্ত করে তাদের বুঝাতে হবে কোন কাজ সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর এবং কোন কাজ সুন্দরবনের জন্য কল্যাণকর। সেজন্য সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার জনপ্রতিনিধি, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সুশীল সমাজ, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, স্থানীয় স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার ছাত্র/ছাত্রী ও শিক্ষকদের এবং মসজিদের ইমামসহ প্রত্যেক ধর্মের ধর্মীয় নেতাদের তথ্য বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনকে সম্পৃক্ত করে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে পারলে এর সুফল পাওয়া যাবে। এ দেশের সাধারণ মানুষকে যে কোনো বিষয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে বুঝালে তারা তা বুঝেন।
মামলার বিবরণে জানা যায়, সুন্দরবন অঞ্চলে পেশায় মৎস্যজীবী ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা মালিক এবং যারা সুন্দরবনের ভেতরে কাঁকরা সংগ্রহ করার জন্য খুলনা বনবিভাগের অনুমোদনক্রমে ডাইংমারি স্টেশন অফিস থেকে অনুমতিপত্র নিয়ে কাঁকড়া সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে। সেখানকার ইঞ্জিনচালিত নৌকার এক মালিক সংগ্রহকৃত কাঁকরা সংরক্ষিত বনের বাইরে থেকে তার নৌকায় পরিবহনের জন্য বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ থেকে ২০১০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর অনুমতি গ্রহণ করেন। সেখানকার মৎস্যজীবীরা আহরিত কাকঁড়া সুন্দরবনের অভ্যন্তরে একটি নির্দিষ্ট স্থানে সংগ্রহ করে রাখে এবং ইঞ্জিনচালিত নৌকার মালিকরা সেখান থেকে কাঁকড়া পরিবহন করে খুলনায় বাজারজাত করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে।
তবে বাগেরহাট জেলাধীন সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ধৃত মাছ সংরক্ষিত বনের বাইরে থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকার মাধ্যমে পরিবহনের জন্য অনুমতি দিলেও আহরিত কাঁকড়া পরিবহনের অনুরূপ অনুমতি প্রদান না করায় ইঞ্জিন বিহীন সাধারণ নৌকায় এসব কাঁকড়া দীর্ঘসময় ধরে পরিবহন করে খুলনায় বাজারজাত করায় এসব কাকড়া মারা যায়। এ কারণে আর্থিকভাবে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হতে থাকেন জেলে ও নৌকার মালিকেরা। এরপর তারা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে ইঞ্জিনচালিত নৌকার মাধ্যমে সুন্দরবনের ভেতর থেকে কাঁকড়া পরিবহনের জন্য ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট আবেদন করে। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় কাঁকড়া পরিবহনের অনুমতি না পেয়ে ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কয়েকজন জেলে এবং নৌকার মালিক হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট দায়ের করেন। এরপর গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর আদালত কিছু পর্যবেক্ষণসহ সাত দফা নির্দেশনা দিয়ে মামলাটি নিষ্পত্তি করে দেন।
সারাবাংলা/কেআইএফ/এএম