নির্দেশ উপেক্ষা করে সড়ক প্রকল্পে যুক্ত হচ্ছে ১৮ নতুন অঙ্গ
১১ আগস্ট ২০২২ ১১:৩৩
ঢাকা: সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে শেষ সময়ে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন অঙ্গ, বাড়ছে ব্যয়ও। এ ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা। এর আগে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে প্রকল্পের মাঝ পথে নতুন অঙ্গ যুক্ত না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু সেটি না মেনে কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু হতে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনীতে এসে ১৮টি নতুন অঙ্গ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্পটির ক্রমপুঞ্জিত আর্থিক অগ্রগতি মোট ১ হাজার ১৫৫ কোটি ৩৮ লাখ ৩২ হাজার টাকা (৫০ শতাংশ) এবং বাস্তব অগ্রতি ৬২ শতাংশ।
এ বিষয়ে প্রকল্পটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সাবেক সদস্য ও বর্তমান পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ সারাবাংলাকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বিবেচনা করা হয়েছে। কিন্তু এ প্রকল্পের ক্ষেত্রে এমন কিছু কম্পোনেন্ট আছে যেগুলো আলাদা প্রকল্পের মাধ্যমে করা সম্ভব নয়। যেমন, রাস্তায় যদি সুইচ গেট প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে সেটি বাদ দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে সুফল পাওয়া যাবে না। তাই অত্যাবশকীয় হওয়ায় কম্পোনেন্ট অঙ্গ হওয়া প্রকল্পটি সংশোধনী প্রস্তাব সুপারিশ দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস থেকে চট্টগ্রাম শহরের বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষা, সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে যাতায়াতের সুবিধা বৃদ্ধি এবং শহরের অভ্যন্তরে যানজট নিরসন করা সম্ভব হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পর চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা। ওই সভায় দেওয়া সুপারিশগুলো প্রতিপালন করায় প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) আগামী বৈঠকে উপস্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে। অনুমোদন পেলে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম মহানগরীর মাস্টার প্ল্যানে চট্টগ্রামকে একটি পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সুপরিকল্পিত প্রাইমারি ও ডিসট্রিবিউট্রাই রোড নেটওয়ার্ক সৃষ্টির নির্দেশনা রয়েছে। প্রাইমারি রোড নেটওয়ার্ক উন্নয়নের মাধ্যমে দূরপাল্লার যানবাহনগুলো শহরের অভ্যন্তরে প্রবেশ ছাড়া গন্তব্যে চলাচল করে। কালুরঘাট ব্রিজ হতে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত বাঁধ ও স্লুইস গেইট, রেগুলেটর না থাকায় জোয়ার এবং অতিবৃষ্টিতে নদীর তীর ডুবে আশেপাশের এলাকাগুলো যেমন, বাকলিয়া, কল্পলোক আবাসিক এলাকা, কালামিয়া বাজার, কালুরঘাট শিল্প এলাকা, বহদ্দার হাট, চাঁন্দগাও এলাকাগুলো প্লাবিত হয়। এ সমস্ত এলাকাগুলোকে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করা এবং যাতায়াত সুবিধা বৃদ্ধির জন্য প্রকল্পটি ২ হাজার ২৭৫ কোটি ৫২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা প্রাক্কালিত ব্যয়ে ২০১৭ সালের জুলাই হতে ২০২০ সালের জুনে বাস্তবায়নের জন্য ২০১৭ সালের ২৫ এপ্রিলে একনেকে অনুমোদিত হয়। পরবর্তীতে ২ হাজার ৩১০ কোটি ২৪ লাখ ২০ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ২০১৭ সালের জুলাই হতে ২০২০ সালের জুনে বাস্তবায়নের জন্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী প্রকল্পটির প্রথম সংশোধন অনুমোদিত হয়। এরপর কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে ভৌত কাজ কাঙ্খিত গতিতে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি তাই দুইবার ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া বাস্তবায়ন মেয়াদ বৃদ্ধি করে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে নতুন কিছু কাজ সংযোজন, অনুমোদিত প্রকল্পের কিছু অঙ্গের পরিমাণ ও ব্যয় হ্রাস বৃদ্ধি বাস্তবায়ন মেয়াদ এক বছর বৃদ্ধির কারণে প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধন প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত দ্বিতীয় সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুযায়ী এই প্রকল্পের আওতায় ৯ কিলোমিটার ৪ লেন বিশিষ্ট বাঁধ কাম সড়ক এবং ৩৫৩ মিটার ২ লেন বিশিষ্ট সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হবে।
প্রস্তাবিত দ্বিতীয় সংশোধিত প্রকল্পের উপর চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভৌত অবকাঠামো বিভাগের নেতৃত্বে ৮ সদস্য বিশিষ্ট আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা সরেজমিন প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন এবং আলোচনার মাধ্যমে প্রকল্প ব্যয় যৌক্তিকভাবে কমার নির্দেশ দেন। পুনর্গঠিত আরডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্প ২ হাজার ৭৪৬ কোটি ৩৯ লাখ ৪৭ হাজার টাকা যা পিইসি সভায় উপস্থাপিত প্রকল্প ব্যয় ( ২ হাজার ৯৪৯ কোটি ১৮ লাখ ৯৪ হাজার টাকা) থেকে ২০২ কোটি ৭৯ লাখ ৪৭ হাজার টাকা কম।
প্রকল্প সংশোধনের কারণ হিসাবে বলা হয়েছে-
রোড পেভমেন্ট নির্মাণ: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি শীর্ষক প্রকল্পটি এই প্রকল্প নেওয়ার পরে অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের ডিপিপিতে অনুমোদিত অ্যালাইনমেন্টের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি অবস্থিত হওয়ায় ইউনিভাসিটি কর্তৃপক্ষের অনুরোধে অ্যালাইমেন্ট সংশোধনের প্রয়োজন হয়। সংশোধিত অ্যালাইনমেন্ট অনুযায়ী রাস্তার দৈর্ঘ্য ৪৮৪ মিটার বৃদ্ধি পায়। এছাড়া সাইটের বাস্তব অবস্থার জন্য প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডিজাইন, প্লানিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কন্সসারটেন্ট লিমিটেড দাখিল করা ডিজাইন ড্রয়িং এবং ভেটিং প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) ভেটিং করা নকশা অনুযায়ী রাস্তার পেভমেন্ট অংশের পুরুত্ব বৃদ্ধির কারণে ২৫ কোটি ৮ লাখ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।
রোড আনুষঙ্গিক কাজ: রোড আনুষঙ্গিক কাজের অংশ হিসেবে ব্লক পেভমেন্ট, গ্রাস টার্ফিং, আর্মকো গার্ড রেইল ইত্যাদি অঙ্গের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া আরসিসি কিলোমিটার পোস্ট, আরসিসি পেলাসাইডিং, বাস-বে, ফুট ওভার ব্রিজ, যাত্রী ছাউনি ইত্যাদি নির্মাণ অঙ্গ অন্তভুক্ত করায় সড়ক নির্মাণের আনুষঙ্গিক কাজে ১০ কোটি ৯ লাখ টাকা ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।
রিজিড পেভমেন্ট নির্মাণ: প্রস্তাবিত বাস-বে অংশগুলো রাস্তার পেভমেন্ট অংশের স্থায়ীত্বেও বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ফ্লেক্সিবল পেভমেন্টের পরিবর্তে রিজিড পেভমেন্ট বাবদ ৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে।
নিউ জার্সি বেরিয়ার: মূল সড়কটি চার লেনের হওয়ায় লেন সেপারেশনের জন্য সড়কের মাঝখানে ডিভাইডার হিসাবে ৯ হাজার ১৬৫ মিটার নিউ জার্সি বেরিয়ার অন্তর্ভুক্ত করায় এ কাজে ৭ কোটি ১৪ লাখ টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে।
সংযোগ সড়ক নির্মাণ: প্রকল্প এলাকায় পাশে স্থিত কল্পলোক আবাসিক এলাকা, বিসিক শিল্প এলাকা এবং লোকালয়গুলোকে এই সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য মোট ২টি সংযোগ সড়ক অন্তর্ভুক্ত করায় এ অঙ্গে ৪ কোটি ৬১ লাখ টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে।
সেতু নির্মাণ: প্রকল্প এলাকায় পাশে অবস্থি বিসিক শিল্প এলাকাকে এই সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য পাশের খালের উপর ২৫০ বর্গ মিটারের একটি ব্রিজ নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত করে এ অঙ্গে ৫ কোটি ৯০ লাখ ৮৬ হাজার টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে।
প্রকল্পটি সংশোনীর আরও যেসব কারণ দেখানো হয়েছে সেগুলো হলো, রেগুলেটর নির্মাণ, ড্রেন নির্মাণ, স্লোপ প্রোটেকশান, রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ, ওয়াকওয়ে নির্মাণ, এমব্যাংকমেন্ট ফিলিং, অন্যান্য মাটির কাজ, প্রি-ফেব্রিকেটেড ভ্যাটিক্যাল ড্রেইন, বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন, সংযোগ, লোড অনুমোদন, এলইডি স্ট্রিট লাইট, পানির পাম্প সরবরাহ এবং স্থাপন, বিল সমন্বয় এবং প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।
সারাবাংলা/জেজে/এসএসএ