বঙ্গবন্ধুর শেষ বজ্র কণ্ঠ— তোরা কী চাস, তোদের এত বড় সাহস?
১৪ আগস্ট ২০২২ ২৩:৪৯
ঢাকা: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ধানমন্ডি ৩২। খুনিরা যখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার উদ্দেশ্যে বাড়ির গেইটে গুলি চালিয়ে বাসভবনে প্রবেশ করে তখন বঙ্গবন্ধু দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নেমে মেজার হুদাকে দেখতে পান। এ সময় তিনি চিৎকার দিয়ে ধমকের সুরে বজ্রকণ্ঠে বলে ওঠেন ‘তোরা কী চাস, তোদের এত বড় সাহস?’
বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের এই আওয়াজ শুনে মেজার হুদা থমকে দাঁড়ায়। হঠাৎ এমন বজ্রকণ্ঠের হুঙ্কারে সে অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ঠিক তখনই পেছন থেকে মেজার নূর স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ওপর গুলি চালায়। এতে তার দেহ সিঁড়ির ওপর লুটিযে পড়ে। এ সময় অপর এক সৈনিক বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দোতলার কামরায় জানালার ধারে পৌঁছে গ্রেনেড চার্জ করে।
১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কাজ চলার সময় কর্নেল (অব.) হামিদের সাক্ষ্য থেকে এসব তথ্য জানা যায়। কর্নেল (অব.) হামিদ বাংলাদেশের কিংবদন্তি ফুটবলার কায়সার হামিদের পিতা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কর্নেল হামিদ ঢাকা ক্যান্টমেন্টের স্টেশন কমান্ডার ছিলেন।
জেরার সময় কর্নেল (অব.) হামিদ আদালতেকে জানান, লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল রশিদ, শাহরিয়ার রশিদসহ অন্যান্য জুনিয়র অফিসাররা ক্যান্টনমেন্ট লং টেনিস কোটের কাছে যেতেন। ওই সময় মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ বিষয়টি নিয়ে কর্নেল হামিদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন। শাহরিয়ার রশিদ, কর্নেল ফারুক রহমান ও মেজর ডালিমের কাছে কর্নেল হামিদ জানতে চান, তারা কেন এখানে আসেন? তখন তারা কর্নেল হামিদকে জানান, তারা জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে আসেন। জেনারেল জিয়াউর রহমান তাদের আসতে বলেছেন। জেনারেল শফিউল্লাহ ওই সব অফিসারদের ওখানে যেতে নিষেধ করে দিতে কর্নেল হামিদকে নির্দেশ দেন।
কর্নেল (অব.) হামিদ বলেন, ‘কর্নেল শাফায়েত জামিল তার স্টাফ অফিসার হাফিজকে সঙ্গে নিয়ে ডিপুটি চিফ জেনারেল হাফিজের বাসায় যান। যেহেতু তাদের বাসা ছিল কাছাকছি। জিয়া তখন হাফ সেভ অবস্থায় বেরিয়ে আসে। শাফায়েত তাকে ঘটনা জানালে জিয়াউর রহমান বলল- প্রেসিডেন্ট ডেথ, সো হোয়াট। ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার। আপহোল্ড দ্য কনস্টিটিউশন।’
এছাড়া ১৯৭৫ সালে সেনাবাহিনীর পোশাক সর্ম্পকে আদলতের জেরার মুখে একজন সাক্ষী জানান, বিপথগামী চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তাদের পোশাক লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের মাধ্যমে সরবরাহ করেন জিয়াউর রহমান।
রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিল আদালতে সাক্ষ্য দেন, ১৫ আগস্ট সকাল আনুমানিক ৬টায় মেজর রশিদ তাকে বলেন, We have captured state power under Khandakar Mustaque, Sheikh is killed, do not try to take any action against us. এ কথা শুনে শাফায়াত জামিল হতচকিত হন। দ্রুত ইউনিফর্ম পরে হেড কোয়ার্টারের দিকে রওয়ানা দেন।
খুনি লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ১৯৯৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, “এ ব্যাপারে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত হয় এবং সে মতে এপ্রিল মাসের এক রাতে তার বাসায় আমি যাই। আলোচনা হয় এবং সাজেশন চাইলে জিয়াউর রহমান বলেন, ‘তোমরা করতে পারলে কিছু কর।’ পরে আমি রশিদের বাসায় গিয়ে জিয়ার মতামত তাকে জানাই। রশিদ তখন বলেন, ‘এ বিষয় নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না, আমি ডিল করব।’ রশিদ পরে জিয়া ও খন্দকার মোশতাক আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সবচেয়ে বড় বেনিফিসিয়ারি জিয়াউর রহমান।”
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী এএফএম মহিতুল ইসলাম আদালতে বলেছেন, ‘আমার ধারণা ছিল ঘাতকরা অন্তত শিশু রাসেলকে হত্যা করবে না, সেই ধারণাতেই আমি রাসেলকে বলি, না ভাইয়া তোমাকে মারবে না।’
বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার আমৃত্যু ত্যাগ নির্ভীকতার সঙ্গে মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সময় বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউ খুনিদের কাছে প্রাণভিক্ষা চাননি। বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ পড়ে থাকতে দেখে খুনিদের বলেছেন, ‘তোমরা এখানেই আমাকে মেরে ফেল।’
বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনায় জিয়াউর রহমানের ভূমিকা সাক্ষী ও আসামিদের জবানবন্দিতে স্পষ্ট হয়েছে এভাবে— বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, পরে নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। জিয়াউর রহমান ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্সকে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করেন। ফলে খুনিরা সুরক্ষা পান। খুনিদের বিচারে সোপর্দ না করে পুরস্কৃত করেন, বিদেশি দূতাবাসে চাকরি দেন ও খুনিরা দম্ভভরে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার কথা স্বীকার করে সাক্ষাত্কার দেন।
১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার পর সংসদে আইন পাস করে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ রহিত করা হয়— যাত্রা শুরু হয় কলঙ্ক মোচনের। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটির বিচার সম্পন্ন করার জন্য ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুলের আদালত ১৯৯৭ সালের ৩ মার্চ মামলার নথিপ্রাপ্ত হন। দায়রা মামলা নম্বর-৩১৯/১৯৯৭ শিরোনাম ‘রাষ্ট্র বনাম লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান (অব.) এবং অন্য ১৯ জন’। তদন্তকারী অফিসার আবদুল কাহার আকন্দ দণ্ডবিধির ১২০-বি/৩০২/১৪৯/৩২৪/৩৪/৩০৭/২০১/৩৮০/১০৯ ধারায় নিম্নলিখিত ২০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র নম্বর-০৭, তাং- ১৫.০১.১৯৯৭ আদালতে দাখিল করেন।
১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায়ে বিচারক কাজী গোলাম রসুল ১৫ সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। অন্যদিকে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চ ২৪ দিনের শুনানি শেষে বিভক্ত রায় দেন। বিচারক এম রুহুল আমিন অভিযুক্ত ১৫ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বজায় রাখেন। কিন্তু অপর বিচারক এ বি এম খায়রুল হক অভিযুক্ত ১৫ জনকেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। পরে হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চে ১২ আসামির মৃত্যদণ্ড বহাল থাকে। পরবর্তীতে সময়ে ২০০১ সালের অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বিচার কাজ বন্ধ থাকে। দীর্ঘ ছয় বছর পর ২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের মুখ্য আইনজীবী বর্তমান সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সুপ্রিম কোর্টে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দেন। এবং ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ ২৭ দিনের শুনানি শেষে ৫ আসামিকে নিয়মিত আপিল করার অনুমতি দানের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন।
২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর- ২৯ দিনের শুনানির পর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন। ওইদিন (১৯ নভেম্বর) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টেও দেওয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামির দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করা হয়। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/এজেড/পিটিএম