কামানের গোলায় ১৩ জন নিহত: ২৬ বছরেও শেষ হয়নি বিচার
১৪ আগস্ট ২০২২ ২৩:৪৭
ঢাকা: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে ৫ টার দিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের সময় সেনা সদস্যরা কামানের গোলা ছুঁড়লে মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডে গিয়ে পড়লে শিশু ও নারীসহ সহ ১৩ জনের মৃত্যু হয়। এ সময় প্রায় ৪০ জনের মতো আহত হন। ওই ঘটনার ২১ বছর পরে ১৯৯৬ সালে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়।
একই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিচার শেষ হয়েছে। কিন্তু একইদিন কামানের গোলায় ১৩ জন নিহতের মামলা ২৬ বছরেও শেষ হয়নি। দীর্ঘ সময় ধরে আদালতে সাক্ষী না আসায় অনেকটা থমকে ছিল মামলার বিচার কাজ। তবে সাক্ষী হাজির করে মামলাটির বিচার দ্রুত শেষ করার কথা জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।
বর্তমানে মামলাটি ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলাটি এখন সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। ২০০৬ সালের ১ নভেম্বর এ মামলায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত। ২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি আতিকুল রহমানের এক ব্যক্তি সাক্ষ্য দেন। এরপর থেকে আদালতে আর কোনো সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়নি। এর মধ্যে সাক্ষ্যগ্রহণের কয়েকটি তারিখ ধার্য থাকলেও আদালতে আর কোনো সাক্ষী উপস্থিত হয়নি। এরপরে মহামারি করোনার কারণে আদালতের সাধারণ ছুটিতে থাকায় আর কোনো কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়নি।
আদালত সূত্রে জানা যায়, এই মামলার পলাতক আসামিদের মধ্য থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত কোনো কোনো আসামির দণ্ড কার্যকর হয়েছে। সেই বিষয়ে একটি প্রতিবেদনের আবেদন করেন রাষ্ট্রপক্ষ। আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার এবং মোহাম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জকে (ওসি) কোন কোন আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে এবং কেউ মৃত্যুবরণ করেছে কি না প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। পরে এক আসামির বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। কিন্তু তথ্যবিভ্রাট থাকায় পুনরায় প্রতিবেদন দাখিলের আদেশ দেন আদালত। প্রতিবেদন দাখিল না হওয়ায় মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ হচ্ছে না। আগামী ২৩ আগস্ট প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ ধার্য রয়েছে।
জানতে চাইলে মামলা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর মোহাম্মাদ মাহফুজুর রহমান চৌধুরী সারাবাংলা জানান, সাক্ষীদের হাজির করার দায়িত্ব পুলিশের। আমরা আদালত থেকে যথাযথভাবে সাক্ষী হাজির করতে পুলিশের কাছে সমন পাঠানোর পরও তারা তা করছে না। মামলাটিতে সাক্ষী হাজিরের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আইজিপিসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মাধ্যমেও আদালতের আদেশ পাঠানো হয়েছে। তাতেও কাজ হচ্ছে না। মামলাটিতে দুই তদন্ত কর্মকর্তাসহ আরও কমপক্ষে ১২-১৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা প্রয়োজন। সাক্ষীরা আদালতে উপস্থিত হলেও দ্রুত বিচার শেষ করে রায় ঘোষণা করা সম্ভব। রায়ের মধ্যে দিয়ে প্রকৃত আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা দাবি করেন তিনি।
এদিকে, মামলার বাদী মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী অসুস্থ হয়ে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বছর ১৫ আগস্ট মারা গেছেন।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের সময় সেনা সদস্যরা কামানের গোলা ছুঁড়লে তা গিয়ে মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডর ৮ ও ৯ এবং ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়ির (টিনশেড বস্তি) ওপর পড়ে। ছোঁড়া কামানের গোলার বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। মুহূর্তের মধ্যেই ধুলায় মিশে যায় ওই বস্তিটি। ওই ঘটনায় নারী ও শিশুসহ ১৩ জন মারা যায়। প্রায় ৪০ জন আহতের মধ্যে কয়েকজন পুরুষ সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করে।
১৯৯৬ সালের ২৯ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় ওই ঘটনায় ৮ নম্বর বাড়ির মালিক মোহাম্মদ আলী বাদী হয়ে এ মামলাটি দায়ের করেন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতে ২০০১ সালের এপ্রিলে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এরপর ২০০৬ সালের ১ নভেম্বর এ মামলায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।
২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারিতে ১৭ আসামির মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এরা হলেন- লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুহিউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ। এরপর ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদেরও ফাঁসিও কার্যকর হয়।
পলাতক ১২ আসামিরা মধ্যে যারা রয়েছে তারা হলেন- লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) শরিফুল হক ডালিম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) এসএইচএমবি নূর চৌধুরী ইবি, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এএম রাশেদ চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) আহমদ শরিফুল হোসেন ওরফে শরিফুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) মো. কিসমত হাসেম, ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার, রিসালদার (অবসরপ্রাপ্ত) মোসলেম উদ্দিন ওরফে মোসলেহ উদ্দিন, এলভি মো. আলী হোসেন মৃধা ও দফাদার মারফত আলী। আসামিরা সবাই পলাতক। গত বছর ১২ এপ্রিল ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদেরও ফাঁসি কার্যকর হয়।
পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্র থেকে নিযুক্ত আইনজীবী মাহফুজুর রহমান চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে। সাক্ষীও হয়েছে। তবে ওখানে কোনো প্রত্যেক্ষ সাক্ষী নেই। এই মামলার ফৌজদারি কার্যবিধি আইনে ১৬৪ ধারায় কোনো জবানবন্দি নেই। কোনো কিছুই নেই। মামলাটি অনেক সেনসেটিভ। আশা করি মামলার রায়ে আসামিরা ন্যায় বিচার পাবে।’
সারাবাংলা/এআই/পিটিএম