সিআরবি রক্ষার অনুরোধ নিয়ে রেলমন্ত্রীর কাছে মোশাররফ-হাছান-নওফেল
১৬ আগস্ট ২০২২ ২০:১৩
চট্টগ্রাম ব্যুরো: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ না করার অনুরোধ জানিয়ে রেলমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন চট্টগ্রামের সরকার দলীয় নয় সংসদ সদস্য, যাদের মধ্যে তিনজন পৃথক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও রয়েছেন। তাদের পক্ষে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেকমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং সংশ্লিষ্ট চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি-বাকলিয়া) আসনের সংসদ সদস্য শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল রেলমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে চিঠি তুলে দেন। রেলমন্ত্রী তাদের নীতিগত অবস্থানের সঙ্গে দ্বি-মত করেননি এবং এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) দুপুরে রেল মন্ত্রণালয়ে গিয়ে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন মোশাররফ, হাছান মাহমুদ ও নওফেল। এসময় চট্টগ্রামের নয় জনপ্রতিনিধির সই করা একটি অনুরোধ পত্র রেলমন্ত্রীকে হস্তান্তর করা হয় বলে জানান উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।
মোশাররফ-হাছান মাহমুদ ও নওফেল ছাড়াও চিঠিতে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, জাতীয় সংসদের হুইপ শামসুল হক চৌধুরী, মোছলেম উদ্দিন আহমেদ, মোস্তাফিজুর রহমান, মাহফুজুর রহমান মিতা এবং খাদিজাতুল আনোয়ার সনি সই করেছেন।
এর আগে, গত মে মাসে রেলপথ সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ২০তম সভায় সিআরবির বিকল্প হিসেবে সীতাকুণ্ড উপজেলার কুমিরায় হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছিল। এরপর চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ তিন সরকার দলীয় নেতা ও জনপ্রতিনিধির এ অবস্থান নিয়ে জোরালো আশার সঞ্চার হয়েছে সিআরবি রক্ষার আন্দোলনে জড়িতদের মধ্যে।
জানতে চাইলে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাননীয় রেলমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। আমাদের শ্রদ্ধেয় নেতা মোশাররফ হোসেন সাহেবসহ আমরা তিনজন গিয়েছিলাম। মন্ত্রীকে বলেছি, আমরা হাসপাতালের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ হোক, এটা চট্টগ্রামের সিংহভাগ মানুষ চায় না। আমরা জনপ্রতিনিধি। জনগণের সেন্টিমেন্টের বাইরে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই হাসপাতালটি সিআরবির বাইরে অন্য কোথাও নির্মাণের অনুরোধ করে আমরা একটি পত্র উনার হাতে দিয়েছি।’
‘আমরা বলেছি যে, ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল যেটা হয়েছে সেটাও কিন্তু রেলওয়ের জায়গায়। সিআরবির বাইরে রেলওয়ের অব্যবহৃত এমন অনেক জায়গা আছে। প্রয়োজনে সেখানে হাসপাতাল হোক, আমাদের কোনো আপত্তি নেই। রেলমন্ত্রী আমাদের নীতিগত অবস্থানের সঙ্গে দ্বি-মত করেননি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছেন।’
চিঠিতে সিআরবিকে ‘চট্টগ্রামের ফুসফুস’ ও ‘কালচারাল হেরিটেজ’ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সম্প্রতি এক গবেষণায় সিআরবিতে প্রায় ২২৫টি দুর্লভ প্রজাতির উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া গেছে। শতবর্ষী বৃক্ষরাজি, পাহাড়, টিলা ও উপত্যকায় ঘেরা বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থান হিসেবে সিআরবি চট্টগ্রামের মানুষের মনে আলাদা স্থান করে নিয়েছে। এখানে বৃক্ষরাজির শীতল ছায়াতলে বিশেষ করে অনিন্দ্য সুন্দর শিরীষতলায় আয়োজন করা হয় বাংলা নববর্ষ, বসন্ত উৎসব, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীসহ বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রউফসহ ১১ জনের সমাধি রয়েছে সিআরবিতে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে প্রণীত ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) এটিকে কালচারাল হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়েছে। ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি এটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়েছে, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সিআরবির কোনো অংশ ব্যবহার করা যাবে না এবং এখানে কোনো বহুতল ভবন নির্মাণ করা যাবে না। শুধু পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পাখির অভয়ারণ্য, জাদুঘর, প্রজাপ্রতি উদ্যান প্রতিষ্ঠা করা যাবে। সব কিছু মিলিয়ে সিআরবি এখন চট্টগ্রামের সব মানুষের আবেগ ও ভালোবাসার জায়গায় পরিণত হয়েছে। এখানে হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগটি সংশ্লিষ্ট গেজেটের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। বিষয়টিতে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ ভীষণভাবে কষ্ট পেয়েছেন।
চিঠিতে আরও বলা হয়, চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজের ব্যানারে হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্প অন্যত্র স্থানান্তরের দাবিতে সভা-সমাবেশ হচ্ছে। ২০২১ সালের ২৬ আগস্ট তারা প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি আবেদনও পাঠান করেন। ২০২১ সালের ৬ আগস্ট আপনার বরাবরেও একটি আবেদন করা হয়েছে। এ অবস্থায় চট্টগ্রামের সকল জনসাধারণের পক্ষ থেকে আমরা মন্ত্রী-এমপিরা সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ স্থগিত করে অন্য কোথাও রেলওয়ের জায়গায় হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ করছি।
উল্লেখ্য, সরকারি-বেসরকারি যৌথ অংশীদারিত্বের আওতায় সিআরবিতে হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউট বাস্তবায়ন ও পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ কোম্পানি লিমিটেড। ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে এই প্রকল্পের জন্য। প্রকল্পের মেয়াদ ১২ বছর।
দুই বছর আগে প্রকল্পটি অনুমোদনের বিষয়টি প্রকাশ পেলে চট্টগ্রামে বিভিন্ন নাগরিক ও পেশাজীবী সংগঠন আন্দোলনে নেমেছিল। ২০২১ সালের জুলাইয়ে গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাসপাতাল নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়টি উঠে এলে আবারও সোচ্চার হন চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন এবং ১৭ জন বিশিষ্ট নাগরিক বিবৃতি দিয়ে সিআরবির প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসের এই প্রক্রিয়া রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানালে রাস্তায় নামে মানুষ।
এরপর ‘নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রাম’ গঠন করে ধারাবাহিকভাবে গত এক বছর ধরে সিআরবি এলাকায় নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। শুরুর দিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ সিআরবিতে হাসপাতালের বিরোধিতা করেন, পরে অবশ্য তারা নিশ্চুপ হয়ে যান। এছাড়া হাসপাতাল নির্মাণের বিষয়ে এতদিন নিশ্চুপ ছিলেন চট্টগ্রামের প্রায় সব এমপি-মন্ত্রীরাও। তাদের এই ভূমিকায় হতাশ ছিলেন আন্দোলনকারীরা।
সিআরবি এলাকা চট্টগ্রাম-৮ সংসদীয় আসনের মধ্যে। সংশ্লিষ্ট আসনের সাংসদ মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় আচারের কারণে আমরা অনেকেই সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের বিষয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিতে অসম্মত ছিলাম। তার মানে এই নয় যে, আমরা জনসাধারণের সেন্টিমেন্টের বাইরে গিয়ে হাসপাতালের পক্ষে ছিলাম। আন্দোলন যারা শুরু করেছেন এবং যারা সেটাকে ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে নিচ্ছেন তাদের অধিকাংশই আমাদের দলের নেতাকর্মী। আমরা জনপ্রতিনিধি, আমরা যে কোনো পরিস্থিতিতে জনগণের পক্ষেই আছি এবং থাকব।’
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম