‘বেঁচে থাকলে সবাই থাকে, মরে গেলে থাকে না’
১৬ আগস্ট ২০২২ ২২:০৮
ঢাকা: ‘জাতির পিতা তো অনেককে ফোনও করেছিলেন? কি করেছিলেন তারা? বেঁচে থাকলে সবাই থাকে, মরে গেলে থাকে না। এটা তার জীবন্ত প্রমাণ। এজন্য আমি কিছু আশা করি না’— এভাবেই ফের আক্ষেপ করলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘১৫ আগস্ট ৩২ নম্বরের ধানমন্ডিতে লাশগুলো তো পড়ে ছিল। কত স্লোগান। বঙ্গবন্ধু, তুমি আছো যেখানে, আমরা আছি সেখানে। অনেক স্লোগানই তো ছিল! কোথায় ছিল সেই মানুষগুলো। একটি মানুষও ছিল না সাহস করে এগিয়ে আসার; একটি মানুষও ছিল না প্রতিবাদ করার? কেন করতে পারেনি?’
মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় শোক দিবসের স্মরণ সভায় সূচনা বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। আওয়ামী লীগ আয়োজিত স্মরণ সভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সশরীরে উপস্থিত ছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার একটাই প্রচেষ্টা ছিল। সব সহ্য করে, নীলকণ্ঠ হয়ে শুধু অপেক্ষা করেছি, কবে ক্ষমতায় যেতে পারব। এই দেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের দেশ হিসাবে গড়ে তুলতে পারব। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারব। তাহলেই এই হত্যার প্রকৃত প্রতিশোধ নেওয়া হবে।’
১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডে জড়িত খুনিদের রক্ষা করতে ইমডেমনিটি দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘চারদিকে যখন সোচ্চার হয়, মানবাধিকারের প্রশ্ন আছে? আমাদের সরকারকে মানবাধিকারের প্রশ্ন করে। যারা প্রশ্ন করে তাদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা, ১৫ আগস্ট আমরা যারা আপনজন হারিয়েছি তখন মানবাধিকার কোথায় ছিল?
তিনি বলেন, ‘আমাদের তো বিচার চাওয়ার অধিকার ছিল না। আমি আমার বাবা-মা হারিয়েছি। আমি মামলা করতে পারব না। আমি বিচার চাইতে পারব না। কেন? আমরা দেশের নাগরিক না? আমি আর আমার ছোট বোন রেহানা বিদেশে ছিলাম বলে বেঁচে গেছিলাম। ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাত থেকে বাঁচার চেয়ে এই বাঁচা কত নির্মম যন্ত্রণা- যারা এভাবে বাঁচে তারা জানে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাধা এসেছে। এমনকি বক্তৃতায় বিচার চাইতে গিয়ে বাধা পেয়েছি। এই কথা বললে নাকি কোনোদিন ক্ষমতায় যেতে পারব না। এরকমও আমাকে শুনতে হয়েছে। আমি বাধা মানিনি। আমি এই দাবিতে সোচ্চার হয়েছি। দেশে-বিদেশে জনমত সৃষ্টির চেষ্টা করেছি। সর্বপ্রথম এই হত্যার প্রতিবাদ করে বক্তৃতা দিয়েছে রেহানা, ১৯৭৯ সালে সুইডেনে।’
তিনি বলেন, ‘এরপর আমি ৮০ সালে বিদেশে গেছি। একটা কমিশন গঠন করেছি। চেষ্টা করেছি আন্তর্জাতিকভাবে। তখন তো দেশে আসতে পারিনি। আমাকে আসতে দেওয়া হবে না। ১৯৮১ সালে দেশে আসার পর থেকে জনমত সৃষ্টি করেছি। কত অপপ্রচার চালানো হয়েছে। আমার বাবার নামে, ভাইয়ের নামে, মায়ের নামে কত মিথ্যা অপপ্রচার। কোথায় সেগুলো? কত রকমের মিথ্যা অপপ্রচার দিয়ে দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে।’
স্বাধীনতার পর পর পাবনার মোহাম্মদ রফিক, খুলনার মমতাজ হোসেনসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এত বাধা। পাটের খুদামে আগুন, থানা লুট- নানাভাবে ব্যতিব্যস্ত করা। তারপর খাদ্যের জাহাজ, নগদ অর্থ দিয়ে কেনা, সেই জাহাজ ঘুরিয়ে দিয়ে ৭৪’র দুর্ভিক্ষ ঘটানো, সবইতো চক্রান্ত ছিল। এতকিছু করেও যখন পারেনি, ঠিক তখনই এই হত্যাকাণ্ড ঘটাল, বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে জাতির পিতার নাম মুছে দিল। ৭ই মার্চের ভাষণ নিষিদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত।’
শেখ হাসিনা অশ্রুসিক্ত চোখে আবারও আক্ষেপ করে বলেন, ‘১৫ আগস্ট থেকে ১৬ আগস্ট ওই লাশ পড়েছিল। ১৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে গেল টুঙ্গিপাড়ায়। কারণ দুর্গম পথ। যেতে ২২ থেকে ২৪ ঘণ্টা লাগবে। কেউ যেতে পারবে না। তাই সেখানে নিয়ে যেয়ে মা-বাবার কবরের পাশে মাটি দিয়ে আসলো।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘কিছু নিয়ে যাননি। শুধু দিয়ে গেছেন। একটা দেশ দিয়ে গেছেন। একটা জাতি দিয়ে গেছেন। আত্মপরিচয় দিয়ে গেছেন। বিধস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তুলে উন্নয়নের পথে যাত্রা শুরু করে দিয়ে গেছেন। কিছুই নিয়ে যাননি বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে। বাংলাদেশের গরিব মানুষকে যে রিলিফের কাপড় তিনি দিতে পারতেন, সেই রিলিফের কাপড়ের পাড় ছিঁড়ে সেটা দিয়েই তাকে কাফন দেওয়া হয়েছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার বাবা-মা-ভাই কেউ কিছু নিয়ে যায়নি। ১৬ তারিখে সমস্ত লাশ নিয়ে বনানীতে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। মুসলমান হিসাবে যে এতটুকু দাবি থাকে জানাজা পড়ার, সেটাও তো পড়েনি। একটু কাপনের কাপড় সেটাও দেয়নি। ৭৫’র ঘাতকরা হত্যার পর বাংলাদেশকে ইসলামিক রাষ্ট্র বানানোর ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু ইসলামিক কোনো বিধি তারা মানেনি।’
বিচারের বাণী তো নিভৃতে কাঁদে আক্ষেপ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘আমি ফিরে এসেও তো বিচার করতে পারিনি। আমি ১৯৮১ সালে ফিরে এসেছি, ৯৬ সালে সরকারে গিয়েছি। এই সময়ে কতবার হাইকোর্টে গিয়েছি, বক্তৃতা দিয়েছি। বিচারের আদালতে গিয়েছি। আমাদের তো মামলা করারও অধিকার ছিল না। কারণ ইমডেনিটি দিয়ে তাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। পুরস্কৃত করে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়েছে। খুনিদের রাজনৈতিক দল গঠনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জিয়াউর রহমান তাদের নিজে উদ্যোগী হয়ে লিবিয়াতে তাদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টোকে অনুরোধ করে তার মাধ্যমে লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফির সাথে কথা বলে এই খুনিদেরকে রাজনৈতিক আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে এদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে জিয়াউর রহমান পুরস্কৃত করেছে। সে যদি খুনি না হবে, ষড়যন্ত্রকারী না হবে, তাহলে খুনি মোশতাক তাকে সেনাপ্রধান করবে কেন? আর সে এই খুনিদের কেন আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেবে?’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘শুধু সেখানেই থামে নাই। ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন অনেক কথা বলেন। আইনজীবী, সুশীল সমাজ, সুধীবাবু। তিনি কি করেছিলেন; ওই খুনি পাশা এবং হুদাকে দিয়ে তিনি একটি রাজনৈতিক দল করেছিলেন। প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি (প্রগস) নামে একটি রাজনৈতিক দল। আর জেনারেল এরশাদ এসে ওই খুনি ফারুককে দিয়ে ফ্রিডম পার্টি গঠন করায়। আর খালেদা জিয়া তো আরও এক ধাপ উপরে। খুনি ফারুক, রশিদ এবং হুদাকে নির্বাচনে প্রার্থী করেন।’
সভার শুরুতে ১৫ আগস্ট নিহত সকল শহিদ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নিহত সকলের স্মরণে শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভাটি সঞ্চালনা করেন দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ। সভায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, কামরুল ইসলাম, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তরের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান এবং দক্ষিণের সভাপতি আবু আহমেদ মান্নাফী বক্তৃতা করেন।
সারাবাংলা/এনআর/পিটিএম
১৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ ধানমন্ডি ৩২ ফোন বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনা সভাপতি হত্যাকাণ্ড