৪ বছর ধরে ডেথ রেফারেন্স শুনানির অপেক্ষায়
২১ আগস্ট ২০২২ ১০:৪৫
ঢাকা: ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) চার বছর ধরে হাইকোর্টে শুনানির জন্য অপেক্ষায় রয়েছে। এ সংক্রান্ত দু’টি মামলা উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির জন্য দুই বছর আগেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। তবে মামলা দু’টির আপিল শুনানির জন্য হাইকোর্টে কোনো বেঞ্চ নির্ধারণ করা হয়নি। আর এজন্য বেঞ্চ গঠন করতে প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। এ হামলায় ২৪ জন নিহত ও কয়েকশ মানুষ আহত হন। এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দায়ের হওয়া দুই মামলায় বিচারিক আদালত রায় দিয়েছেন। রায়ে ৪৯ আসামির মধ্যে ১৯ জনকে ফাঁসি, ১৯ জনকে যাবজ্জীবন এবং ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এসব আসামির মধ্যে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় ১৯ জনকে ফাঁসি এবং ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর মামলার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আসামিদের জেল আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
কোনো মামলায় আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে, যা ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) মামলা হিসেবে পরিচিত। এ অনুসারে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য বিচারিক আদালতের রায় ও নথিপত্র হাইকোর্টে পাঠানো হয়। ডেথ রেফারেন্স, আসামিদের জেল আপিল, আপিল ও বিবিধ আবেদনের ওপর সাধারণত একসঙ্গে শুনানি হয়ে থাকে। তবে শুনানির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে পেপারবুক প্রস্তুত করতে হয়।
এ মামলার পেপারবুক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। ২০২০ সালের ১৬ আগস্ট প্রায় ২০ হাজার ৫০০ পৃষ্ঠার ১ হাজার ৮০টি পেপারবুক সরকারি ছাপাখানায় তৈরির পর সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা করা হয়। পেপারবুক জমা করার পর বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেওয়ার জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা রাষ্ট্রীয় জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মামলা। নজিরবিহীন ওই হামলার মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে স্থবির ও ধ্বংসের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। সে কারণে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমরা মামলাটি শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি বরাবর দরখাস্ত করেছি। প্রধান বিচারপতি মামলাটি শুনানির জন্য একটি বেঞ্চ ঠিক করে দেবেন।’
অ্যাটর্নি জেনারেল এ ব্যাপারে আরও বলেন, ‘মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিশ্চিত করার জন্য বিচারিক আদালত থেকে যে রেফারেন্সগুলো হাইকোর্টে আসে তা শুনানির জন্য প্রস্তুত হলে প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ ঠিক করে দেন। সে অনুযায়ী শুনানি হয়।’
অ্যাটর্নি জেনারেল আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল এখন শুনানির অপেক্ষায়। পেপারবুকসহ যাবতীয় নথি প্রস্তুত। প্রধান বিচারপতি একটি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দিলেই হাইকোর্টে শুনানি শুরু হবে।’
আপিল শুনানির আগে দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আসামিদের করা জেল আপিল ও আপিলের গ্রহণযোগ্যতার ওপর শুনানি হয়ে থাকে। এই মামলায় সে প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। পলাতক আসামিদের পক্ষে লড়তে রাষ্ট্রনিযুক্ত হিসেবে আইনজীবীও (স্টেট ডিফেন্স) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালের অক্টোবরে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হিসেবে মো. হাফিজুর রহমান খানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় করা মামলায় পৃথক দু’টি অভিযোগপত্র দাখিল হয়। একটি হত্যা এবং অন্যটি বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে। এরপর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর হত্যা এবং বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের হওয়া দুই মামলায় রায় দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১।
বিচারিক আদালতের রায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট আমলের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন দুই শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। এ ছাড়া রায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন এবং অপর ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৯ আসামি হলেন—বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, ডিজিএফআইর সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআইর সাবেক ডিজি ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুর রহিম, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ (পলাতক), মাওলানা মো. তাজউদ্দীন (পলাতক), মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মো. আবদুল মাজেদ ভাট ওরফে মো. ইউসুফ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ, মাওলানা শওকত ওসমান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান, মাওলানা আবু সাঈদ, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহমেদ তামিম, মঈন উদ্দিন শেখ, রফিকুল ইসলাম ও উজ্জ্বল ওরফে রতন। এদের মধ্যে ১৪ জন জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি-বি) সদস্য।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম ও হুজি-বির সাবেক আমির শেখ আবদুস সালাম গত বছর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ১৯ আসামি হলেন— তারেক রহমান ওরফে তারেক জিয়া (পলাতক), হারিছ চৌধুরী (পলাতক), শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ ওরফের আবু ওমর আবু হোমাইরা ওরফে পীরসাহেব (কারাগারে মৃত্যু), মাওলানা সাব্বির আহমদ ওরফে আবদুল হান্নান সাব্বির, আরিফ হাসান ওরফে সুজন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, আবুবকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মো. আরিফুল ইসলাম ওরফে আরিফ, মহিবুল মোত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন (পলাতক), আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন (পলাতক), মো. খলিল (পলাতক), জাহাঙ্গীর আলম বদর (পলাতক), মো. ইকবাল (পলাতক), লিটন ওরফে মাওলানা লিটন (পলাতক), কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ (পলাতক), মুফতি শফিকুর রহমান (পলাতক), মুফতি আবদুল হাই (পলাতক) ও রাতুল আহম্মেদ বাবু (পলাতক)।
তিন আইজিপিসহ ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা
এছাড়া আরও ১১ জন আসামীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। তারা হলেনপুলিশের সাবেক আইজিপি খোদা বক্স চৌধুরী, সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (অব.) রুহুল আমিন, এএসপি (অব.) আবদুর রশিদ ও এএসপি (অব.) মুন্সি আতিকুর রহমানকে তিন বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তাদের ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক (কারাগারে), সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা (কারাগারে), সাবেক আইজিপি শহুদুল হক (কারাগারে), ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন (পলাতক), লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার (পলাতক), ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক উপকমিশনার ওবায়দুর রহমান (পলাতক) ও ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার খান সাঈদ হাসানকে (পলাতক) দুই বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তাদের ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
নথিপত্র অনুযায়ী, তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ ১৬ জন পলাতক। তবে হারিছ চৌধুরীর মেয়ে যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সামিরা চৌধুরী চলতি বছরের জানুয়ারিতে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তার বাবা ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা গেছেন। ভিন্ন পরিচয়ে এত বছর তিনি ঢাকাতেই ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন পর্যন্ত এ খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেনি।
সারাবাংলা/কেআইএফ/আইই