রানা প্লাজা ধস, বিচার ও কিছু বিবেচনা
২৪ এপ্রিল ২০১৮ ১৫:৫২
।। গোলাম মুর্শেদ।।
রানা প্লাজা ধসের পাঁচ বছর হলো। এতবড় দুর্ঘটনা বিশ্বের আর কোনো কর্মস্থলে ঘটেনি। একটি ঘটনায় পাঁচটি কারখানার অন্তত ১ হাজার ১৩৮ জন শ্রমিকের মৃত্যু ও ২ হাজার ৫০০ জনের বেশি শ্রমিকের জখম হওয়ার ঘটনাটি কোনো প্রাকৃতিক বা দৈব কারণে সংঘটিত হয়নি। শ্রমিকরাও স্বেচ্ছায় ভবনটিতে প্রবেশ করেননি। একটি নড়বড়ে ভঙ্গুর ফাটল ধরা ভবনে হাজার হাজার শ্রমিককে সেদিন ঢুকতে বাধ্য করেছিল মালিকপক্ষের ভাড়া করা গুণ্ডাবাহিনী।
দুর্ঘটনার সম্ভাবনা রয়েছে এমন কর্মপরিবেশে শ্রমিকদের কাজ করে যেতে বাধ্য করার পর যদি কোনো শ্রমিক সেখানে দুর্ঘটনায় মারা যায়, তবে সে মৃত্যু আইনী পরিভাষায় ‘নিমখুন’ বা ‘ম্যানস্লটার’ হিসেবে পরিগণিত হয়। দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু নয়। রানা প্লাজা ধসের ঘটনা প্রকৃতপক্ষে হাজারো নিমখুনের ঘটনা, যার দায় পোশাককারখানাটির মালিক এড়াতে পারেন না।
এত মৃত্যু আর জখমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ কম হয়নি। পোশাক কারখানার অবকাঠামো ও কাজের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে দেশী-বিদেশী নানা উদ্যোগও দেখা গেল। আহত বা পঙ্গুত্ব বরণ করা শ্রমিকদের পুনর্বাসনের জন্যও বেশকিছু সফল প্রকল্পও বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু এসব ঘটনা মৃত্যু, ভয় আর জখমের বেদনাকে যেমন পুরোপুরি ভুলিয়ে দিতে পারে নি, তেমনি বিভিন্ন প্রতিবাদ-বিক্ষোভও শ্রমিকদের ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে যথেষ্ট বলে বিবেচিত হয়নি।
বিচারের মাধ্যমে আদালত কাউকে শাস্তি দেয়, কাউকে নির্দোষ বলে ঘোষণা করে। রায় ঘোষণার মধ্যে বিচারকের তিন ধরনের উদ্দেশ্য থাকে- কৃতকর্মের শাস্তি দান, দৃষ্টান্ত স্থাপন এবং চিহ্নিতকরণ। একটি ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত, কিভাবে জড়িত, কতটুকু জড়িত তা যাচাই করার পর বিচারক দোষী সাব্যস্ত করেন। শাস্তি দেওয়া হয় অপরাধ বা অন্যের ক্ষতি করার কারণে। আরেকটি উদ্দেশ্য হলো সংশোধনের সুযোগ করে দেওয়া। ধরা যাক, একজন একটি মুরগি চুরি করেছেন এবং আদালতে তা প্রমাণিত হয়েছে। বিচারক তাকে এক সপ্তাহ কারাগারে থাকার শাস্তি দিলেন। প্রচলিত বিচারব্যবস্থার ধারণা, এতে চোরের অনুতাপ হবে এবং কারাগারে থেকে কষ্ট ভোগ করার কারণে তিনি আর চুরি করতে চাইবেন না। তিনি সংশোধিত হবেন এবং ভবিষ্যত এ ধরনের অপরাধ কাজে আর জড়াবেন না।
রায়ের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বিচারক সম্ভাব্য অপরাধীদের সাবধান করে দেন। যারা অপরাধ করতে চান, তাদের তিনি সতর্ক করেন কঠোর শাস্তি দিয়ে অথবা ধিক্কার দেওয়ার মধ্যদিয়ে।
তৃতীয়ত, বিচারের মাধ্যমে ওই কাজটি অপরাধ কি না সেটি চিহ্নিত করা হয়। এমন অনেক অপরাধই থাকে, যা সচরাচর সংঘটিত হয় না। এমনও হয় যে, সেটি জগতে প্রথমবারের মতো সংঘটিত হয়েছে। এতে অনেক সময় এটা স্থির করা জরুরি হয় যে, সেটি আসলে অপরাধ কি না।
বিচারক যখন যাচাই-বাছাই করে কোনো কাজকে অপরাধ বলে চিহ্নিত করেন, সেটি নিষিদ্ধ ও মন্দ বলে বিবেচিত হয়। এমন কাজ করা শাস্তিযোগ্য বলে প্রচলিতভাবে ধরে নেওয়া হয়।
অপরাধের বিচার না হলে কেবল অপরাধীই পার পেয়ে যায় তা নয়। এতে অপরাধ বেড়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়, যা ব্যক্তি ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর। অপরাধীদের শাস্তি না দেওয়া অপরাধকে উৎসাহিত করারই নামান্তর।
রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় দায়ী মালিক ও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের বিচার তাই ইতিহাসের দায়। পাঁচ বছরেও যে বিচার হয়নি, সেটি বড় অন্যায়। আরো বড় অন্যায় হলো আমাদের দেশ-জাতির জন্য। একটি রাষ্ট্র যখন এত বড় আকারের হত্যার ঘটনার বিচার করতে ব্যর্থ হয়, তা জাতীয় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
রানা প্লাজা ভবনে কারখানা ছিল পাঁচটি। দ্বিতীয় তলায় নিউ ওয়েভ বটমস্ লিমিটেড, তৃতীয় তলায় ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেড, চতুর্থ তলায় ইথার টেক্সটাইল লিমিটেড, পঞ্চম তলায় ফ্যান্টম টেক লিমিটেড, এবং ষষ্ঠও সপ্তম তলায় নিউ ওয়েভ স্টাইল লিমিটেড। এসব কারখানার মধ্যে নিউ ওয়েব বটমস লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী হলেন বজলুস সামাদ আদনান, মাহবুবুর রহমান তাপস, দেলোয়ার আহমেদ, এ আর আইয়ুব হোসেন ও মোহম্মদ দেলোয়ার হোসেন।
ফ্যান্টম অ্যাপারেলসের মালিক ছিলেন আমিনুল ইসলাম, সুরাইয়া বেগম, নাজিম উদ্দিন, এবিএম সিদ্দিকী ও আলেয়া বেগম।
ইথার টেক্সটাইল লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী ছিলেন আনিসুর রহমান, মাহবুবুল আলম, জেসমিন আলম, মোহম্মদ নজরুল ইসলাম, মোসাম্মৎ মরিয়ম, জান্নাতুল ফেরদৌস, শফিকুল ইসলাম ভুঁইয়া, রকিবুল হাসান ও মনোয়ার হোসেন।
ফ্যান্টম টেক লিমিটেডের মালিক ছিলেন ডেভিড মায়ার রিকো, আমিনুল ইসলাম, সুরাইয়া বেগম, এবিএম সিদ্দিকী ও আমিরুল ইসলাম মাহমুদ। আর নিউ ওয়েভ স্টাইল লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী ছিলেন বজলুস সামাদ আদনান।
পাঁচটি কারখানার মোট মালিক ছিলেন ২১ জন। অথচ সংবাদমাধ্যমে এদের নাম খুব কমই এসেছে। রানা প্লাজা ভবনের মালিক সোহেল রানাকে আমরা যেভাবে চিনি, তার খবর আমরা যেভাবে পাই, এসব নিয়োজকদের খোঁজ আমরা সেভাবে পাই না। কারণ কি এটা যে, নিয়োজকেরা সমাজের যে শ্রেণিতে অবস্থান করেন, সোহেল রানা তার চেয়ে নিচের শ্রেণিতে অবস্থান করেন? যা হোক, তার বিহিত পরে হবে।
রানা প্লাজার ভবন ধসের পর সরকার, মালিকদের সংগঠন ও নীতি নির্ধারণী মহল থেকে বলা হয়েছিল প্রতি কারখানা ও কর্মস্থলে সেফটি বা নিরাপত্তা কমিটি গঠিত হবে। শ্রমিকদের নাম, পরিচয়, ঠিকানা, চাকরির তথ্যাদি নিয়ে সমন্বিত তথ্যভান্ডার তৈরি হবে। কিন্তু তার কোনোটিই এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।
দুর্ঘটনার পর শ্রমিক আন্দোলনের মুখে শ্রম আইন সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ইউনিয়ন করার সুযোগ অবাধ করা হবে এমন ঘোষণাও আসে। কিন্তু ইউনিয়ন করার সুযোগ বাড়লেও, তা অবাধ হয়নি। নানা শর্তে তাকে যথাসম্ভব জটিল করার উদ্যোগ আজো আছে। ইউনিয়ন সংগঠকদের ওপরে অত্যাচার অবিচার ইত্যাদির অবসান হয়নি।
রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর, আরো একটি বিষয় সামনে আসে- ক্ষতিপূরণ। শ্রমিকদের কী পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত, তা নিয়ে সরকারী উদ্যোগে কমিটি করা হয়েছিল। সে কমিটির সুপারিশ আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। বিচার্য বলে মনে হয়েছিল কিনা, সেটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই ভালো বলতে পারবেন। ক্ষতিপূরণের আইন সংস্কার করে সেটিকে যুগোপযোগী করার উদ্যোগও থেমে আছে। এ পুরো পরিস্থিতি শ্রমিক স্বার্থের বিরোধী।
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের বিচার করাই এখন সময়ের দাবি। ন্যায়বিচার পাওয়া শ্রমিকদের অধিকার। প্রতিটি নাগরিকের ন্যায়বিচার পাওয়ার সংবিধান স্বীকৃত অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের আশু দায়িত্ব। রানা প্লাজা ধসের মতো এত বড় একটি ঘটনার জন্য কারা দায়ী, কতটুকু দায়ী, কিভাবে দায়ী সেটি চিহ্নিত করা না গেলে ভবিষ্যত দুর্ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে কী হবে?
রানা প্লাজার দুর্ঘটনার আগে পরে বিভিন্ন কারখানায় দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাতে প্রাণহানিও হয়েছে বহু। কিন্তু কোনোটিরই বিচার হয়নি। এই বিচারহীনতার চর্চা একটি অন্যায়, একটি জঘণ্য ব্যাপার, যা পুরো জাতির জন্য অসম্মানের বিষয়।
বিচারহীনতা শ্রমিকদের আরো বেশি করে অসহায় করে তুলেছে। অনিরাপদ কর্মপরিবেশে কাজ করিয়ে কাউকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া আর দোষের বিষয় বলে বিবেচিত হচ্ছে না। কারণ এজন্য দায়ীদের কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয় নি। এ ধরনের অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হবে, এমন ভয়ও সম্ভাব্য অপরাধীদের মধ্যে কাজ করছে না। এভাবে কার্যত অপরাধীদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা ও খুন-ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ীদের বিচার করে আমরা যেমন ইতিহাসের দায় মিটিয়েছি, দেশে যেভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং সারা বিশ্বের সামনে ন্যায়বিচারে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে তাতে পুরো জাতির সম্মান রক্ষা হয়েছে। রানা প্লাজার দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের শাস্তি দিয়ে আমরা একই রকম দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হব, এটাই প্রত্যাশিত।
বিচারহীনতার আরেকটি দিক আছে, যা বিবেচনার দাবি রাখে। একের পর এক কারখানা দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে, তাতে শ্রমিকদের প্রাণহানি হচ্ছে, তারা শারীরিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অথচ ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না।
এর মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের কাছে পরোক্ষভাবে যে বার্তাটি যাচ্ছে তা হলো, তারা ন্যায়বিচার পাওয়ার যোগ্য নয় অথবা রাষ্ট্র তাদের সুরক্ষা ও ইনসাফ দিতে ব্যর্থ। এমন ঘটনা শ্রমিকদের, দেশের অধিকাংশ মানুষকে, আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীন করে তুলতে পারে। যা আখেরে বাংলাদেশ নামের এ রাষ্ট্রকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
লেখক : গোলাম মুর্শেদ, ট্রাস্টি, বাংলাদেশ শ্রম ইনস্টিটিউট
সারাবাংলা/ এসবি