‘সাড়ে ৩ লাখ টাকায় আম্মু আমাকে বিক্রি করে দিচ্ছিল’
২৪ আগস্ট ২০২২ ১৫:১৫
ঢাকা: গত ২৩ জুন নিখোঁজ হওয়ার দুই মাস পর দেখা মিলেছে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের শিক্ষার্থী ইয়াসা মৃধা সুকন্যার। মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) দিবাগত মধ্যরাতে বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলে হাজির হয়ে মায়ের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ তুলে ধরেছেন তিনি। এ সময় মায়ের নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে গত দুই মাস নিখোঁজ ছিলেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
ইয়াসা এখন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কাছে রয়েছেন। সেখানে আনু্ষ্ঠানিকতা শেষে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে ডিবি পুলিশ। যেহেতু তাকে নিয়ে একটি অপহরণ মামলা রয়েছে। তার সহযোগিতাকারী বন্ধু সেই মামলার আসামি। তাই এসব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করবে ডিবি পুলিশ।
ইয়াসা বলেন, ‘গত ২৩ জুন নিখোঁজ হওয়ার আগে আমার ওপর অনেক মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন হয়েছে। আমি আর টিকতে পারছিলাম না। আমার বন্ধু চিশতির কোনো দোষ নেই, সে পুরোই নির্দোষ। ওকে আমি গত ২২ জুন বলি, আমি বের হব। সে বলেছে কই যাবা? আমি বলেছি, জানি না কই যাব, কিন্তু আমি বের হব।’
তিনি বলেন, ‘পরদিন ২৩ জুন দুপুর ১টায় কলেজে অমার মডেল টেস্ট ছিল। আর বৃহস্পতিবার উচ্চতর গণিত পরীক্ষা ছিল। আম্মু আমাকে সোয়া ১২টার দিকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে থাকে। আমি ক্লাসে না গিয়ে ওইদিক দিয়েই বের হয়ে আসি। বের হয়ে দেখি বন্ধু অপেক্ষা করছে, তখন পৌনে ১টা বাজে। সে বলে, কলেজে যাবা? আমি বলি, না যাব না। সে বলে, কেন যাবা না? আমি বলি, তুমি তো জানো? আমাকে মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। তখন সে বলে, ঠিক আছে আজ তাহলে কলেজে যাওয়ার দরকার নাই। চলো আজ তাহলে আমরা ঘুরি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আম্মুর বয়ান মতে, আমি ডমিনোজে গেছি, এটা করছি সেটা করছি— এরকম কিছুই না। প্রথমে আমরা সিদ্ধেশ্বরী থেকে খিলগাঁও যাই। খিলগাঁও থেকে টিএসসিতে আমরা খাই। সেখান থেকে বের হয়ে কই যাব সেটা নিয়ে ভাবছিলাম। তারপর বন্ধুর পরামর্শে কার্জন হলে যাই। কার্জন হলে যাওয়ার পরে ৬টা বেজে যায়। এরপর সেখান থেকে গেন্ডারিয়া যাই, ওর এক বন্ধু থাকে— সেখানে। ওকে বিশ্বাস করে গেছি। গেন্ডারিয়ায় যাওয়ার পরে অনেক্ষণ বসেছিলাম। অনেক্ষণ আড্ডা দিই। সেখান থেকে বের হয়ে রিকশা ভাড়া করি। রিকশাওয়ালার ফোন নিয়ে আমি যাকে ভালোবাসি তাকে ফোন করে বলি, তুমি কই? সে বলে, আমি মাত্র অফিস থেকে বের হয়েছি। আমি বলি, তুমি কি খিলগাঁও তালতলাতে আসতে পারবা? সে বলে মিরপুর থেকে যেতে কমপক্ষে চার বা পাঁচ ঘণ্টা লাগবে। বরং এক কাজ কর, তুমি মিরপুর বৈশাখী মার্কেটের সামনে আসো।’
‘মিরপুর যাওয়ার পর দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে। ও ভাড়া দেয়। এরপর ও আমার হাত ধরে বলে, দেখ ঝুঁকি নেওয়ার দরকার নাই। আমি তোমার বাবা-মায়ের মন জয় করার চেষ্টা করছি। দেখি কি হয়। বাসায় ফিরে যাও। সে আমাকে বার বার বাসায় ফিরতে বলে। ওর কোনো দোষ নেই। তখন আমি তাকে বলি, দেখ তুমি আমাকে বাসায় যেতে বলছ; আজ আমি বের হলে তোমার কাছেও আসব না। তখন সুইসাইড করা ছাড়া আমার কিছুই করার থাকবে না। এছাড়া আমি সারাদিন যেহেতু বাসায় ছিলাম না, আমাকে পেলে মেরেও ফেলতে পারে। আর তুমি আমার সবকিছুই জানো’— বলেন ইয়াসা।
তিনি বলেন, ‘সে ভয় পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তার এক বন্ধুকে ফোন দেয়। তিনি উকিল ম্যানেজ করেছেন। ওইদিন রাতেই অর্ধেক কাগজপত্র তৈরি করা হয়। পরদিন গত ২৪ জুন জুম্মার নামাজের পরে কাজী আসে। এরপর আমরা শরীয়ত মোতাবেক বিয়ে করি।’
ইয়াসা মৃধা সুকন্যা আরও বলেন, ‘মা বলেছেন, আমার নাকি ফেসবুকে অ্যাকটিভ। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমি ফেসবুক ওপেন করতে পারিনি। আমার পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে দেওয়া হইছে। উনি (মা) আমার আইডিতে ঢুকে পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করেছেন। উনি নিজেই ম্যাসেজ দিয়ে কারসাজি করতেছেন। আমি জানি না কেন করতেছেন।’
বলতে থাকেন ইয়াসা, ‘এর কিছুদিন পর শুনি উনি একটা সংবাদ সম্মেলন করবেন। উনি যা মন চায় করুক। আমি বাসায় যাচ্ছি না, এটা নিশ্চিত। আশায় ছিলাম কখন আমি এই টিভি চ্যানেলে আসব। সবকিছু খুলে বলব।’
আরও পড়ুন:
‘মায়ের নির্যাতন’ থেকে বাঁচতে ২ মাস নিখোঁজ ছিলেন ইয়াসা
মায়ের দ্বারা নির্যাতিত হওয়ার বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘মায়ের কান্না, কান্না ঠিকই; উনি বোরকা পড়ে ঠিকই, ইসলামী নিয়ম মেনে চলছেন। তবে বোরকার পেছনে উনার কি আছে, সেটা কেউ জানে না। আমার বন্ধুরা ওখানে ছিল। ওরাও বলেছে, আসলে তোর মায়ের মতো মা হয় না। আসলেই আমার মায়ের মতো মা হয় না। এমন নির্যাতনকারী মা আসলেই কারও হয় না। আমাকে বালিশ চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি। বিষ খাওয়ানোর চেষ্টা করছিলেন। আমার হাতে এখনো নির্যাতনের দাগ রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একদিন প্রেমিকের নাম নিয়ে বলেছিলাম, ওকেই আমি বিয়ে করতে চাই। ওকেই আমি ভালোবাসি। আমার জীবনে ওকেই চাই। তখন মা কয়েল জ্বালাচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে সে আমার হাতে জ্বলন্ত কয়েল লাগিয়ে দেন। আমার হাত পুড়ে যায়। তখন আমি বলি, যতই যা কর না কেন, আমি ওর নাম ভুলব না।’
‘এর পর একদিন একটা লোককে বাসায় নিয়ে এসে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আমি ওই লোকটাকে কোনোদিন দেখিনি। কোনো আত্মীয়ও না। তাকে চিনিও না। আম্মু বলেন, এই লোকটি তোমাকে দু’বছরের জন্য বিয়ে করবে। বিনিময়ে তোমাকে সাড়ে তিন লাখ টাকা দেবে। ওই সময় আমার বলার মতো ভাষা ছিল না। মাত্র সাড়ে তিন লাখ টাকার জন্য আম্মু আমাকে বিক্রি করে দিচ্ছিল’— বলেন ইয়াসা।
মেয়েটি কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, ‘ওই লোকটাকে আমার রুমে পর্যন্ত পাঠায়। আম্মু বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দেয়। আমি কোনোমতে দরজা ধাক্কাই। মা গেটটা খোলো। আমি এসব নির্যাতন মেনে নিতে পারছিলাম না। আম্মু বাইরে থেকে বলেন, মেয়েরা নাকি আয় করতে পারে না। এই দেখ আয়ের রাস্তা তো এটাই। এখন দুই বছরের জন্য আপাতত থাক। ডিভোর্স হওয়ার পরে আরও নতুন কন্ট্রাক আসবে।’
তিনি বলেন, ‘আমি এসব মেনে নিতে পারছিলাম না। আমি রাতে ঘুমাতে পারতাম না। আমাকে ভয়ে বালিশ চাপা দেওয়া হতো। আমি নানু বাসায় গেলেও নানুও আমাকে একই কথা বলত। বিয়েটা করা ফেল। সাড়ে তিন লাখ টাকা পাবি। সাড়ে তিন লাখ টাকা কম নাকি এখনকার যুগে। বিয়ে কর, বিয়ে কর। লাগলে আরও টাকা দেবে।’
এ সময় ইয়াসা অক্ষেপ করে বলেন, ‘আম্মু আমাকে বিক্রি করে দিচ্ছে। অথচ আমি তার পেটের সন্তান। বললে সবাই মনে করবে আমার সৎ মা। কিন্তু না তিনি আমার আপন মা। তিনি দুই দিন ধরে আমাকে রুমে আটক করে রেখেছে, খেতে দেয়নি। আমি ওয়াশরুমের পানি খেয়ে নিজের জান বাঁচাইছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার হাতে কোনো ফোন দিত না। কারণ ফোন দিলেই আমি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে কল দিতাম। স্কুলে থাকা অবস্থায় ও আসত। দারোয়ানকে প্রতি মাসে টাকা দিয়ে যেত। একটা মিনিট হলেও সে আমার সঙ্গে কথা বলেছে। সেদিনও যখন আমার হাত ধরেছে, একটা কথাই বলেছে, সামনে অনেক বড় প্রবলেম হতে যাচ্ছে, তবুও তোমাকে আমি ছাড়ব না। কারণ, আমি তোমার আম্মুর মতো না।’
নির্যাতনের বর্ণনায় ইয়াসা বলেন, ‘আম্মু প্রচণ্ডভাবে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করতে পারে। সেটা আমার বাবাকে হোক, বা অন্য কাওকে হোক। আমি নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে একবার বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছিলাম। ওকে ফোন করেছিলাম। সে গ্রামের বাড়িতে থাকায় আসতে পারেনি। তখন পেছন থেকে আমার আঙ্কেল দেখে আমাকে ধরে ফেলেন। ধরে বাসায় নিয়ে যায়। বাসায় নেওয়ার পর বেল্ট দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছিল। আমার পিঠ লাল হয়ে যায়। মা হয়ে একটু মলমও লাগিয়ে দেয়নি।’
‘এসব ঘটনা আমার চাচা-চাচি কাউকে কিছু বলতে পারতাম না। আমাদের আট তলা বাড়ি। সবাই ইউনিটে ইউনিটে থাকতো। বের হলেই কারও না কারও কাছে পড়তে হবে। তাই আম্মু সবসময় সঙ্গে থাকত। আর আম্মু যখন থাকতে পারত না তখন আমাকে ফোন হাতে দিয়ে কলে থাকত। আমি কাকে কী বলি তা ফোন কলে শুনতো। যতটুকু জানি, মা এগুলো করছে তার পাবলিসিটি বাড়ানোর জন্য। তার ভাই মানে আমার মামা একজন ইউটিউবার।’
মামা ও চাচাতো ভাইয়ের দ্বারাও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেন ইয়াসা। তিনি বলেন, ‘আমার মামা দিদারুল ইসলাম বিপুলের মাধ্যমেও আমি নির্যাতিত হয়েছি। আমি ওই বাসার কোথাও নিরাপদ না। এমনকি আমার চাচাতো ভাইদের কাছেও আমি নিরাপদ না। আমি কোথাও নিরাপদ না। আমি ওই বাসায় যাব না। ওই বাসায় পাঠালেও আমি যাব না। প্রয়োজনে আমি রাস্তায় আত্মহত্যা করব। আমি জানি আমি গেলে আর ফেরত আসব না।’
এ সময় দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার একটাই কথা। উনি (মা) যা করছেন তা বন্ধ করুক। আমার বন্ধুর নামে যে মামলা দেওয়া হয়েছে তা তুলে নিক। কারণ, তার কোনো দোষ নেই। আমাকে যে নির্যাতন করা হতো, সেজন্য আমি বের হয়েছি। এখানে আমার স্বামী বা বন্ধু কারও কোনো দোষ নেই।‘
ইয়াসা বলতে থাকেন, ‘আমাকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হতো। আমি দিনের পর দিন ঘুমাতে পারতাম না। আমাকে খেতে দিত না। বলতো, তুই মরতে পারিস না। তুই মর। বাবাকে অনেকভাবে ইঙ্গিত দিতাম। বাবা পেটে কিছু রাখতে পারত না। আমি ফোন রাখলেই বাবা আম্মুকে জিজ্ঞেস করতো। তাই বাবাকে বলেও শান্তিতে থাকতে পারতাম না। উনি (মা) নিজের দোষের দিকে আগে তাকাক। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দেওয়া উচিত।’
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম