সেচনির্ভর হয়ে উঠছে আমন চাষ, বাড়ছে উৎপাদন খরচ
২৫ আগস্ট ২০২২ ২৩:০৪
ঢাকা: বর্ষা মানেই তুমুল বৃষ্টি। জল থৈ থৈ চারিদিক। সাধারণত জমি-জমা ও মাঠ-ঘাট ডুবে থাকে পুরো বর্ষায়। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়েই আমন চাষে ব্যস্ত হয়ে পড়েন কৃষক। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বর্ষা তার ছন্দ হারিয়েছে। এখনকার বর্ষায় চিরাচরিত সেই বৃষ্টির দেখা মেলা ভার। এবার তো দেশে স্মরণকালের অনাবৃষ্টিও দেখা দিয়েছে। ফলে চলতি আমন মৌসুমে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষক। যদিও এখন পর্যন্ত সেচযন্ত্রের মাধ্যমে লক্ষ্যমাত্রার ৭৬ শতাংশ জমিতে আমন আবাদ হয়েছে। এবং ২০ শতাংশের বেশি জমি এখনও পতিত।
প্রাকৃতিক উৎসের পানি না মেলায় চলতি আমন মৌসুমে এখন পর্যন্ত ৬ লাখ ৬৯ হাজার সেচযন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। আর এই যন্ত্র ব্যবহার করে ১৩ লাখ হেক্টর জমিতে আমন ধান রোপন করা হয়েছে। আবার যেসব জমিতে ইতোমধ্যে আমনের চারা রোপন করা হয়েছে, কিন্তু সেচ দেওয়া সম্ভব হয়নি, সেসব মাঠ ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। ফলে কৃষক বাধ্য হয়েই আমন ধানেও সেচ দিচ্ছেন। এতে ধান উৎপাদন খরচ বাড়ছে। অনাবৃষ্টির ফলে এবার আমনের উৎপাদন কম হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভরা বর্ষার আমন চাষ এখন সেচনির্ভর হয়ে উঠছে!
জানা গেছে, দেশের অধিকাংশ এলাকায় আমনের মাঠ এখন ফেটে চৌচির। সেসব জমিতে কেউ কেউ সেচ দিচ্ছেন। আবার বৃষ্টি না হওয়ায় দেশের অনেক জায়গায় এখনো ধান রোপন করা সম্ভব হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ আমনের সেচ কাজ নির্বিঘ্ন করতে গ্রামাঞ্চলে রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সংযোগ নিরবচ্ছিন্ন রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের তথ্য মতে, চলতি বছর আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৫৬ লাখ ২০ হাজার ৭২৫ হেক্টর। কিন্তু এখন পর্যন্ত আবাদ হয়েছে ৪২ লাখ ৬৩ হাজার ৫৭৮ হেক্টর জমিতে। আবাদে অগ্রগতির হার ৭৬ শতাংশ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, আরও প্রায় এক মাস পর্যন্ত আমন লাগানো যাবে। শেষ দিকে যেসব আমন লাগানো হয় সেগুলো মূলত লেট রোপা আমন। যার উৎপাদন তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম।
জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে প্রায় ১৪ লাখ সেচযন্ত্র রয়েছে। এবার আমন মৌসুমে এখন পর্যন্ত ৬ লাখ ৬৯ হাজার সেচযন্ত্র ব্যবহার হয়েছে। আর সেচযন্ত্র ব্যবহার করে ১৩ লাখ হেক্টর জমিতে আমন ধান রোপন করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এবারের মতো অনাবৃষ্টি আর দেখা যায় না। দেশের কোথাও এক টানা আধা ঘণ্টাও বৃষ্টি হচ্ছে না। কৃষক তো আর জমি ফেলে রাখবে না। তাই বাধ্য হয়ে সেচযন্ত্র ব্যবহার করেই আমন রোপন করেছে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে মহাপরিচালক বলেন, ‘অনাবৃষ্টির কারণে ধান উৎপাদনে কিছুটাতো প্রভাব পড়বেই। ২০ আগস্টের পরে যারা ধান লাগিয়েছে সেখানে উৎপাদন একটু কম হবে। ৩০ তারিখের পরে লাগালে ক্ষতি আরেকটু বেশি হবে।’
কৃষকরা যা বলছেন
জানতে চাইলে ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার কৃষক মোস্তফা সারাবাংলাকে বলেন, ‘নিচু জমি থেকে কোনোরকমে শ্যালো (সেচযন্ত্র) দিয়ে পানি সেচে ধান লাগিয়েছি। কিন্তু বৃষ্টি নেই। মাঠ ফেটে চৌচির। ক্ষেতে পানি না থাকায় এখন ঘাস (আগাছা) হয়ে যাচ্ছে। জমি শুকনো থাকায় প্রচুর ঘাস হচ্ছে। এক সপ্তাহের মধ্যে বৃষ্টি না হলে জমি থেকে ফসল পাওয়া যাবে না। আর এখন শ্রমিকের যে দাম তাতে জমির ঘাসও পরিষ্কার করাও যাচ্ছে না।’
কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার হরশি গ্রামের কৃষক হিমেল কবির। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমার তিন কানি জমি আছে। বৃষ্টি না হওয়াই এবার কোনো জমিতেই আমন লাগাতে পারিনি। বৃষ্টির জন্য এলাকায় নামাজ পাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এখনও বৃষ্টি হচ্ছে না।’
নরসিংদীর চন্দনপুর গ্রামের কৃষক শহীদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমনের অবস্থা খুবই খারাপ। বৃষ্টি নেই। আমরা শ্যালো মেশিন দিয়ে সেচ দিয়ে জমিতে ধান লাগিয়েছি। তবে সব জমিতে লাগাতে পারিনি। এখনও অনেক জমি পতিত আছে।’
এই কৃষক জানান, শ্যালো মেশিন দিয়ে সেচ দিতে প্রতি লিটার তেলে ১৫০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ এক লিটার তেলে যতক্ষণ মেশিন চলে সেই পরিমাণ পানি কৃষক পেয়ে থাকেন। এতে আমন ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ অনেক বেড়ে গেছে।
এই কৃষক আরও জানান, চার কানি ( প্রতি কানি ৩০ শতাংশ) জমিতে ধান লাগাতে তার এরই মধ্যে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কেবলমাত্র সেচ দিতেই তার ১ হাজার ২০০ টাকার বেশি খরচ হয়েছে।
আমন চাষ কি সেচনির্ভর হয়ে উঠছে?
চলতি মৌসুমে আমন চাষ অনেকটাই সেচ নির্ভর হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টি তার আগের রূপ পাল্টিয়েছে। আষাঢ়-শ্রাবণে বৃষ্টি নেই। ভাদ্রেও বৃষ্টির দেখা মিলছে না। সব মিলিয়ে এবার আমন মৌসুমে দিশেহারা কৃষক।
জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক আসাদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমনে সেচ লাগে না। যে বছর বৃষ্টি কম হয়, সেবছর হয়তো শ্যালো মেশিন দিয়ে সামান্য পরিমাণে পানি দিলেই চলে। এবার বৃষ্টি কম হয়েছে। জুন-জুলাই-আগস্টে বৃষ্টি নেই। এত দীর্ঘ খরা আর হয় না। এবার খর দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। দুই/তিন বছর আগে একবার সেচ লেগেছিল, তবে এতটা বেশি নয়। এবার বৃষ্টি আগে হওয়ায় ও আগাম বন্যা হওয়ায় এখন আর বৃষ্টি নেই। ফলে কৃষক বাধ্য হয়ে সেচে আমন চাষ করছে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক মো. হামিদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আষাঢ়-শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে এমন অনাবৃষ্টি আর দেখা যায়নি। আমন মূলত বর্ষাকালের ফসল। কৃষক মনের আনন্দে বৃষ্টিতে ভিজে ধান রোপন করে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেচ লাগে না। এবার স্মরণকালের অনাবৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন ৪০ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে এমন অনাবৃষ্টি দেখা যায়নি। যার ফলে এবার সেচযন্ত্র ব্যবহার করতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘কৃষক আমনে সেচযন্ত্র ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত থাকে না। এবার ধান রোপনের সময়ই বৃষ্টি নেই। প্রায় ৫২ লাখ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ হয়। এটি অন্যতম প্রধান মৌসুম। কৃষক তার অস্তিত্বের কারণেই ঋণ করে হলেও সেচ দিয়ে ধান লাগাচ্ছে। এতে ধানের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। যেসব এলাকায় ধান লাগাতে দেরি হয়েছে সেখানেও উৎপাদন কমে যাবে। দক্ষিণাঞ্চলে বৃষ্টি হলে লবণাক্ততার পরিমাণ কমে। তখন কৃষক আমন চাষ করতে পারে। এবার বৃষ্টি না হওয়ায় সেখানকার কৃষকও দুঃশ্চিন্তায় রয়েছে।’
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. এম আসাদুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমন রোপনে কখনও সেচের প্রয়োজন হতো না। ফ্লাওয়ারিং স্টেজে (ধানের শীষ) কখনও কখনও সেচের প্রয়োজন হতো। কিন্তু এবার তো প্রথম থেকেই সেচ লাগছে। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। আমন কখনও সেচ নির্ভর ছিল না। এবার কৃষককে সেচের খরচও বহন করতে হচ্ছে। এতে ধানের ধামও বাড়তে পারে।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমনে এ বছর সেচ লাগছে বলে আগামী বছর যে লাগবে তা কিন্তু বলা যাচ্ছে না। তবে চলতি বছরের আমন চাষ সেচনির্ভর হয়ে উঠেছে।’
সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম