জলবায়ু পরিবর্তনে ৪০ বছরে বাংলাদেশের ক্ষতি ১২ বিলিয়ন ডলার
২৮ আগস্ট ২০২২ ২২:৩৫
ঢাকা: জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ৪০ বছরে বাংলাদেশ ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। এতে প্রতি বছর ০.৫ শতাংশ থেকে এক শতাংশ পর্যন্ত জিডিপি হ্রাস পাচ্ছে যা ২০৫০ সাল নাগাদ ২ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার আশঙ্কা। জলবায়ু পরিবর্তনের এই ব্যপক ঝুঁকি মোকাবেলায় ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়ন করা জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রোববার (২৮ আগস্ট) রাজধানীর আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (এইউএসটি) ‘জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশের অবক্ষয়: রূপান্তরমূলক পরিবর্তনের আহ্বান’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব কথা উঠে আসে। সেমিনারে কি-নোট উপস্থাপনকালে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস’র (সিইজিআইএস) প্রধান নির্বাহী মালিক ফিদা আবদুল্লাহ খান এসব তথ্যে তুলে ধরেন।
এইউএসটি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ ফজলে ইলাহীর সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টি এবং আহসানিয়া মিশনের চেয়ারম্যান কাজী রফিকুল আলম।
মালিক ফিদা আবদুল্লাহ খান বলেন, জার্মান ওয়াচের আন্তর্জাতিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচকের দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকির সূচক অনুযায়ী দুই দশকে (২০০০-২০১৯) সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। এসব ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার নাপা (২০০৫), বিসিসিএসএপি (২০০৯), বিডিপি ২১০০ (২০১৮) এবং অতি সম্প্রতি ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান-২০৩০’ গ্রহণ করেছে। এছাড়াও তারা জলবায়ু সহনশীল উন্নয়ন নিশ্চত করার জন্য বর্তমানে মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী কৌশলসমৃদ্ধ ‘ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান (ন্যাপ) ২০২২’ তৈরি করেছে।
এ বিষয়ে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন দুইভাবে ঘটে- এক প্রাকৃতিকভাবে এবং অন্যটি মানুষের হাতে। মূলত মানুষই প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে। ঢাকা শহরের গাছপালা কেটে, খাল ও মাঠ দখল করে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে। এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার মানুষ ব্যাপকহারে ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহরে চলে আসছে। আমাদের দেশে সবাই ঢাকামুখী হওয়ায় রাজধানীতে আর মানুষ ধারণক্ষমতা নাই। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী রাষ্ট্রগুলোকে এর দায় নিতে হবে। আমাদের দরকার ক্লাইমেট জাস্টিস। ঢাকার ওপর অতিরিক্ত চাপ নিঃসরণ ও অন্যান্য জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য আমাদের দরকার ক্লাইমেট ফান্ড। কিছুদিন আগে এই বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমি ঢাকার জন্য ক্লাইমেট ফান্ড থেকে সাহায্য চেয়েছি।’
প্রকৃতির বিরুপ আচরণের জন্য মানুষই দায়ী উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ময়লা ও পয়ঃবর্জ্য ফেলে ঢাকা শহরের খালগুলোকে দূষিত করা হয়েছে। খালগুলোতে এখন আর মাছের চাষ করা যায় না। বরং মশার চাষ হয়। প্রকৃতিকে ধ্বংস করার কারণে, দূষণের ফলে প্রকৃতি এখন প্রতিশোধ নিচ্ছে।’
বাসযোগ্য পৃথিবীর জন্য আমাদের ন্যাচার-বেজড সল্যুশন বা প্রাকৃতিক উপায়ে সমাধানের পথে হাঁটতে হবে বলে জানান মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ঢাকায় অবশিষ্ট যে অল্প কিছু গাছপালা রয়েছে সেগুলো আর কাটা যাবে না। কিছুদিন আগেও বনানীতে গাছপালা কেটে ভবন নির্মাণের কাজ করতে দেখা গেছে। আমরা সিটি করপোরেশন থেকে সেই নির্মাণ কাজ বন্ধে পদক্ষেপ নিয়েছি। দয়া করে কেউ ঢাকা শহরের গাছপালা ধ্বংস করবেন না।’
বক্তব্যে ডিএনসিসি মেয়র আরও বলেন, ‘ওয়াসা থেকে খালগুলো বুঝে পাওয়ার পর আমরা সেগুলো উদ্ধারে কাজ করে যাচ্ছি। মোহাম্মদপুরের বছিলায় লাউতলা খালে অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ড ছিল, বহুতল মার্কেট ছিল। সেগুলো উচ্ছেদ করে আমরা লাউতলা খাল উদ্ধার করেছি। খালে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করেছি। সেখানে এখন নৌকা চলছে। তবে খাল পরিষ্কার করতে গিয়ে আমরা খাল থেকে জাজিম, বস্তা, ডাবের খোসা, পুরনো টেলিভিশন, চেয়ার, টেবিলসহ এমন কিছু নেই যা পাইনি। এভাবে খালগুলো নোংরা হচ্ছে এবং ভরাট হচ্ছে। আবার বিভিন্ন ডেভেলপার কোম্পানিগুলো বালু ভরাট করে অনেক খাল বেদখল করে ফেলেছে। প্লট বিক্রির সময় তারা নকশায় খেলার মাঠ ও বাজার দেখিয়েছে। জায়গার দাম বাড়ায় তারা খেলার মাঠ ও বাজারও প্লট আকারে বিক্রি করে দিয়েছে। আমরা রাজউকের সঙ্গে আলাপ করেছি। রাজউকের অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী সেই মাঠ ও বাজার উদ্ধার করব।’
বাড়ির মালিকদের নিজেদের ভবনে অ্যাট সোর্সে পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থার আহ্বান জানিয়ে ডিএনসিসি মেয়র বলেন, ‘সবাই যদি নিজেদের বাড়িতে অ্যাট সোর্সে পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে পারি তাহলে শহরের পরিবেশ ঠিক থাকবে, খালের পানিও পরিষ্কার থাকবে। অন্যদিকে শহরের বর্জ্য জমে জমে ল্যান্ডফিল বা ভাগাড় যেন ভরে না যায় তাই আমিন বাজারে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ চলছে। এখানে ৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে।’
আহসান উল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের অধ্যাপক মো. মুজিবুর রহমান বলেন, ‘১৯৭২ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে আয়োজিত স্টকহোম কনফারেন্সে প্রথমবারের মতো পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। এতে অংশগ্রহণকারীরা স্টকহোম ঘোষণা এবং মানব পরিবেশের জন্য অ্যাকশন প্ল্যান এবং বেশ কয়েকটি রেজুলেশনসহ পরিবেশের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য একাধিক নীতি গ্রহণ করে। স্টকহোম কনফারেন্সের ৫০ বছর পর জলবায়ু পরিবর্তন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিশ্ব পরিবেশ ক্রমাগত বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। এর ফলে জীববৈচিত্র্য ক্রমাগতভাবে ক্ষয়ে যাচ্ছে, মাছ কমে যাচ্ছে, মরুভূমিকরণের ফলে অধিক হারে উর্বর ভূমি কমে যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ক্রমাগতভাবে লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠছে। ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে ও অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃতির বিধ্বংসী রূপ দেখা যাচ্ছে। বায়ু-পানি-সাগর দূষণের ফলে লক্ষাধিক প্রাণের টেকসই জীবনমানকে হুমকির মুখে রেখেছে। আর এর নির্মম শিকার হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশসমূহ।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের শিকার বাংলাদেশকে বাঁচাতে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের পাশাপাশি নিজদেরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অতিথিরা। মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা শহরকে বাঁচাতে হলে পরিবেশ দূষণ কমাতে হবে। এজন্য নানা পদক্ষেপের মধ্যে একটি হতে পারে রাস্তায় গাড়ির পরিমাণ কমানো। শহরের স্কুলগুলোতে স্কুল বাস চালু করলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক সম্প্রীতি বাড়ার পাশাপাশি শহরের রাস্তায় গাড়ির পরিমাণও কমবে।’
সারাবাংলা/আরএফ/এনএস