ঢাকা: দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ সাম্প্রতিক নানা সংকটে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ জাতিকে জানাতে জাতীয় সংসদে সাধারণ প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। প্রস্তাবের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধীদল জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ আখ্যা দিয়ে সমালোচনার পাশাপাশি বাণিজ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। আর সরকার দলীয় সংসদ সদস্যরা এর বিরোধিতা করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মূল্য বৃদ্ধি ও বিএনপির সময়কার দুর্নীতির কথা মনে করিয়ে দেন।
মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুর সভাপতিত্বে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
এর আগে কার্যপ্রণালী-বিধির ১৪৭ বিধির আওতায় আনীত প্রস্তাবকে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘সংসদের অভিমত এই যে, কোভিড-১৯, বৈশ্বিক অস্থিরতা, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, জ্বালানি সংকট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রভৃতি সমস্যা মোকাবিলা করার নিমিত্তে সরকারের গৃহীত স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি টেকসই পদক্ষেপগুলো মহান সংসদে আলোচনার মাধ্যমে জাতিকে অবহিত করা হোক।’
প্রস্তাব উত্থাপন করে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘কোভিডের কারণে অনেক মানুষ চাকরিচ্যুত হয়েছে। অনেক মানুষ ঢাকা শহর ছেড়ে দেশের বাড়ি চলে যায়। আমাদের সরকার ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ৪১-৫১ শতাংশ জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিল। বলা নেই, কওয়া নেই তেলের দাম বহুলাংশে বেড়ে গেল। সেকারণে সংশ্লিষ্ট সব জিনিসের দাম বেড়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে একসঙ্গে এতটা দাম বেড়েছে কিনা তা আমার জানা নেই।’
তিনি বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর এক সপ্তাহ আগে যে চালের দাম ছিল ৬২ টাকা, এখন তা ৮০ টাকা। আটা ছিল ৪০ টাকা, হলো ৫০ টাকা। পাঁচ লিটার সয়াবিন ছিল ৮৭০ টাকা। হয়ে গেল ৯০০ টাকার ওপরে। অনেক সময় পাওয়া যায় না। সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘কোভিড-১৯, বৈশ্বিক অস্থিরতা, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, জ্বালানি সংকট- সব মিলিয়ে বিশ্বে আজ অস্থিরতা বিরাজ করছে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ যখন শুরু হলো তখন যদি দাম বাড়াতাম ৬০ টাকা লিটার বাড়াতে হতো। তখনও ভারতের সঙ্গে লিটারপ্রতি দাম ৪০ টাকা পার্থক্য ছিল। সেখানে পাচার হওয়ার সম্ভবনা ছিল। সে কারণে আমাদের একটা ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। আমরা কোনো মতে দাম বাড়াইনি। সমন্বয় করেছি।’
ওয়াকার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘জ্বালানির মূল্য যখন এক লাফে ৪৬ টাকা বাড়ানো হলো তখন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলাম, সরকার আইএমএফ’র প্রেসক্রিপশন মানতে গিয়ে বিষ গিলেছে। সেই বিষের প্রভাব আমাদের সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়বে।’
তিনি বলেন, ‘গত ১৩ বছরে গ্যাস উত্তোলনের চেষ্টা করা হলো না। এলএনজি নিয়ে আসা হলো। এলএনজি টার্মিনাল করা হলো। এলএনজি টার্মিনালের সাথে কোন কোন প্রতিষ্ঠান যুক্ত, তার সঙ্গে কারা যুক্ত- এটা খুঁজে বের করতে হবে। কারা এটা নিয়ে এত উৎসাহী হয়ে গেল। দীর্ঘ মেয়াদি চুক্তির কথা ছিল সেটাও করা হয়নি। আমদানি নির্ভর জ্বালানি নীতির কারণে সমস্ত জায়গায় মুখ থুবড়ে পড়েছে।’
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু। তিনি বলেন, ‘আমরা জানি মানুষ কষ্টে আছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সংকটের জন্য এই কষ্ট হঠাৎ শুরু হয়েছে। দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির জন্য আমি আমার ও সরকারের তরফ থেকে জনগণের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। আমি আপনাদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। আমি পরিষ্কার বলতে চাই, এই সংকট মোকাবিলার সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে।’
কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘আসলে জ্বালানি তেলের অত্যাধিক মূল্য বাড়ার কারণে দেশ আজ মুদ্রাস্ফীতিতে ভুগছে। দেশ আজ জগৎ শেঠের কাছে জিম্মি হয়ে গেছে। কুইক রেন্টাল, নিজস্ব বিদ্যুৎ খাত, গ্যাস উত্তোলন না করে আমদানি নির্ভরতা আর ক্যাপাসিটি চার্জের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে। এটা বন্ধ করতে হবে।’
বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, ‘এ সরকারের দেখানো কিছু উন্নয়নের মধ্যে আছে কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কিছু প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের ফিরিস্তি। বর্তমানে দেশের সব ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি নিম্মমুখী।’ এই সংকটের কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বলে সরকার দেখালেও আসল সত্যটা কি তা তিনি জানতে চান। তিনি প্রশ্ন তোলেন, এই অবনতির কারণ কি ব্যাপক দুর্নীতি নাকি এটা ভয়ংকর লুটপাটের কারণ? কার স্বার্থে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ? বিদ্যুৎ না পেয়েও কোটি টাকা ক্যাপটাসিটি চার্জ দেওয়া হচ্ছে কেন? তিনি এলএনজি আমদানিতেও ব্যাপক দুর্নীতি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘আমরা যেমন বৈশ্বিক সমস্যায় রয়েছি, তেমনি পলিটিক্যাল ক্রাইসিস, রোহিঙ্গা সমস্যায়ও জড়িয়ে থাকার জন্য আমাদের এই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের সরকারের হাতে বিপুল অর্থ থাকার কথা। কিন্তু তা কেন নেই। এর কারণ হচ্ছে ভুল সিদ্ধান্ত। আমরা বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। কিন্তু বিপুল পরিমাণ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে দিতে হচ্ছে। আমরা মেগা প্রকল্প নিয়েছি। উন্নয়নের আনন্দে আত্মহারা ছিলাম। কিন্তু পরের কথা ভাবেনি। তাই আমাদের সব কিছু বাড়লেও ক্রয় ক্ষমতা বাড়েনি।’
আলোচনায় আরো অংশ নেন আওয়ামী লীগের সাবেকমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মতিয়া চৌধুরী, কর্নেল (অব.) ফারুক খান, কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ ও উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ, হুইপ সামছুল হক চৌধুরী, ওয়াসিকা আয়েশা খান, সুলতান মো. মনসুর আহমেদ, আবিদা খাতুন মিতা ও আহসানুল হক টিটু এবং জাতীয় পার্টির সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা ও পীর ফজলুর রহমান।