Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

১৪ শতাংশ হাসপাতাল নিবন্ধনের আবেদনই করেনি

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
৩১ আগস্ট ২০২২ ১২:২০

ঢাকা: দেশের প্রায় ১৪ শতাংশ বেসরকারি হাসপাতাল কখনোই নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেনি। যারা এক সময় নিবন্ধনের আওতায় এসেছিল, তাদের মধ্যেও বড় একটি সংখ্যার লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। অনুমোদন করার পরেও এখন পর্যন্ত লাইসেন্স নবায়ন করতে পারেনি দেশের ৫৯ শতাংশ বেসরকারি হাসপাতাল। ১৯৮২ সালের অধ্যাদেশ অনুসারে লাইসেন্সিং’র কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা বা তা লঙ্ঘনের শাস্তির নির্দেশনা না থাকা ও লাইসেন্সিং জটিলতার কারণে অনুমোদন প্রক্রিয়া দীর্ঘ হচ্ছে বলে আইসিডিডিআর’বির (আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ) গবেষণা প্রতিবেদনে জানান হয়।

বিজ্ঞাপন

২০১৯-২০ সালে এই গবেষণা পরিচালনা করা হয়। তবে, এই সময়ে এসে সেই পরিস্থিতি পরিবর্তনও হতে পারে বলে জানিয়েছে আইসিডিডিআর’বি। গতকাল মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) আইসিডিডিআরবি মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়।

এদিন ডাটা ফর ইম্প্যাক্ট এবং আইসিডিডিআর’বি যৌথ একটি সাংবাদিক সভার মাধ্যমে বাংলাদেশের বেসরকারি স্বাস্থ্যখাতে লাইসেন্সিং জটিলতা নিয়ে আলোচনার আয়োজন করা হয়। এই সময় গবেষণা ফলাফল তুলে ধরেন প্রতিষ্ঠানটির ম্যাটার্নাল অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ ডিভিশনের (এমসিএইচডি) সিনিয়র ডিরেক্টর ডা. শামস এল আরেফিন।

তিনি বলেন, দেশে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিভিন্ন সময় স্বাস্থ্য অধিদফতর নিয়ন্ত্রণে আনতে অভিযান পরিচালনা করেছে। এবিষয়টি দেখতে ইউএস-এইডের সহায়তায় আমরা ১২টি সিটি করপোরেশন ও ১০টি জেলার ২৯টি উপজেলায় একটি গবেষণা জরিপ পরিচালনা করি। এতে স্থানীয় সিভিল সার্জনসহ কিছু বেসরকারি হাসপাতাল সহায়তা করে।

তিনি বলেন, গবেষণাটি করতে গিয়ে ১ হাজার ১৮৯টি বেসরকারি হাসপাতালকে অ্যাসেসমেন্টের (মূল্যায়ন) জন্য সহযোগিতা চাওয়া হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে ৪০টি হাসপাতালই সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানায়। সবশেষে ১ হাজার ১১৭টিতে অ্যাসেসমেন্ট করা হয়।

শামস এল আরেফিন বলেন, জরিপ করা ১ হাজার ১১৭টি বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে ৯৫৬টি হাসপাতাল কোনো এক সময় নিবন্ধনের আওতায় এসেছিল, শতকরা হিসাবে যা প্রায় ৮৬ শতাংশ। আর বাকি ১৬১টি বেসরকারি হাসপাতাল কখনোই নিবন্ধন করেনি, যা শতাংশ হিসাবে ১৪ শতাংশ।

তিনি আরও বলেন, কোনো এক সময় নিবন্ধনের আওতায় আসা ৯৫৬টি বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে ৮৮৬টির (৭৯ শতাংশ) লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল, ৬৬টি হাসপাতালের (৬ শতাংশ) বৈধ লাইসেন্স ছিল এবং বাকি ৪টি হাসপাতাল (দশমিক ৫ শতাংশ) এবিষয়ে কোনো তথ্য জানায়নি।

বিজ্ঞাপন

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৮০ সাল থেকে দেশে বেসরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রমের অগ্রগতি শুরু হয়। অগ্রগতিটা সবচেয়ে বেশি হয় ২০০৭ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত। বর্তমানে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্য সেবার জন্য নির্ভর করে বেসরকারি হাসপাতালের ওপর। বেসরকারি হাসপাতালের ওপর মানুষের এই নির্ভরশীলতার কারণ হলো সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা, পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ নানা সংকট।

আরও বলা হয়, ১৯৮২ সালের আইন অনুযায়ী বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে স্বাস্থ্যসেবার ৭টি শর্ত/নিয়ম মানতে হয়। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, এসব শর্ত পূরণ করে স্বাস্থ্য সেবা দিতে গেলে নানা বাঁধার মুখে পড়তে হয়, যেকারণে কোয়ালিটি স্বাস্থ্য সেবা দিতে সমস্যা হয়।

গবেষণা ফলাফল তুলে ধরার পাশাপাশি জানানো হয়, বিগত ১৯৭০ থেকে সম্প্রতি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত এবং সামাজিক সূচকের উন্নতি উল্লেখযোগ্য এবং এই উন্নয়নের পেছনে অন্যতম অবদান রেখেছে দেশব্যাপী সরকারি, বেসরকারি এবং ব্যাক্তিগত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। ১৯৮০ থেকে দেশে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। যার মধ্যে রয়েছে মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্য পরিষেবা।

প্রতিষ্ঠানটি জানায়, বর্তমানে দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ হাসপাতাল বেসরকারি স্বাস্থ্যখাতের আওতাভুক্ত। ক্রমবর্ধমান সংখ্যার কারণে এসবের পরিচালনায় আছে সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব। ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএসএআইডি) সহযোগিতায় আইসিডিডিআর’বি ২০১৯ থেকে ২০২০ সময়সীমার মধ্যে বাংলাদেশের বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সিং গ্রহণ নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করে।

গবেষণায় আরও জানানো হয়, ১৯৮২ সালের অধ্যাদেশ অনুসারে লাইসেন্সিং’র কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা বা তা লঙ্ঘনের শাস্তির নির্দেশনা নেই। প্রতিষ্ঠানের মালিকরাও লাইসেন্স নবায়ন বিলম্বের কারণগুলো জানান। এর মধ্যে রয়েছে ১) লাইসেন্সিং বৈধতার সংক্ষিপ্ত সময়সীমা, ২) কর্তৃপক্ষের নিকট একাধিক ছাড়পত্র জমা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা, ৩) ছোট প্রতিষ্ঠানের আবেদনপত্র তৈরির প্রক্রিয়ার সীমিত ব্যবস্থাপনা ক্ষমতা, ৪) আবেদনপত্র অনুমোদনের দীর্ঘ সময়সীমা, ৫) আবেদনপত্রে যথাযথ ফিডব্যাকের অভাব এবং ৬) ছোট ক্লিনিকের ক্ষেত্রে চড়া লাইসেন্সিং ফি।

১৯৮২ এর অধ্যাদেশে বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সের জন্যে ৭টি বাধ্যতামূলক শর্তের উল্লেখ রয়েছে বলে অনুষ্ঠানে জানান হয়।

২০১৯-২০ সালে করা এই গবেষণা থেকে জানা যায়, মূল্যায়নকৃত প্রতিষ্ঠানের ৯০ শতাংশ ৭টির মধ্যে ৩টি শর্ত মেটাতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যে প্রতিটি রোগীর জন্যে যথোপযুক্ত জায়গা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অপারেটিং থিয়েটার এবং অন্তত একজন বিশেষজ্ঞের উপস্থিতি। তবে চিহ্নিত শর্তের সঙ্গে অনুবর্তিতার দূরত্বের আংশিক কারণ অস্পষ্ট সংজ্ঞা এবং মানসম্মত ব্যবস্থার সঙ্গে নিয়মের পরিষ্কার মূল্যায়নের অভাব। কিছু বাধ্যতামূলক শর্ত, যেমন- সংক্রামণ নিয়ন্ত্রণ, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং ওষুধের ক্ষেত্রে নিম্নমানের অনুবর্তিতার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

আরও জানা যায়, লাইসেন্স পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নথির প্রাপ্যতার মধ্যে তারতম্য ছিল। যা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের লাইসেন্সের বিলম্বের কারণ হিসেবে তুলে ধরেন। এর মধ্যে ট্যাক্স সার্টিফিকেট (৮৬%) এবং ভ্যাট সার্টিফিকেট (৫৮%) রয়েছে। যা ছোট এবং বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে ব্যাপকভাবে উপস্থিত (৮৬%)। এনভায়রনমেন্টাল ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট (৩২%) এবং নারকোটিক্স লাইসেন্সের (২৫%) প্রাপ্তি কঠিন বলে প্রতিবেদনে উঠে আসে। আর ছোট প্রতিষ্ঠানের জন্য উভয় লাইসেন্সের প্রাপ্তিই অনেক জটিল।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ২০১৯ সালে এই মূল্যায়নটি সংঘটিত হয়। যার ফলাফল ২০২০ সালে সংশ্লিষ্টদের জানান হয়। এই ফলাফলের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের (ডিজিএইচএস) হাসপাতাল পরিষেবা ব্যবস্থাপনা (এইচএসএম) ইউনিট দ্বারা বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ওপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি কিছু সুপারিশের কথা উল্লেখ করেন।

এগুলো হলো—

১) ২০১৬ সালের খসড়া নির্দেশিকা সংশোধন এবং অনুমোদন যা ১৯৮২ এর অধ্যাদেশে নিয়ম ও পদ্ধতি যুক্ত করে।

২) সকল বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের পরিদর্শনের জন্য প্রয়োজনীয় মানব সম্পদের অনুমান।

৩) অনুবর্তিতার ট্র্যাকিং ও মনিটরিং’র বিকল্প পদ্ধতির অনুসন্ধান, যেমন স্যামপল অডিটিং।

৪) ডিজিএইচএস’র নেতৃত্বে বিভিন্ন সরকারী বিভাগের সঙ্গে আলোচনা।

অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এইচএসএম শাখার প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. সুপ্রিয়া সরকার এই গবেষণার মূল্যায়নের উপর ভিত্তি করে ডিজিএইচএস গৃহীত পদক্ষেপগুলো সভায় উপস্থাপন করেন। একইসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের উপ-পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. শেখ দাউদ আদনান প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ উদ্যোগের কথা জানান।

সভায় উপস্থিত ছিলেন ইউএসএআইডি’র সিনিয়র রিসার্চ, মনিটরিং, ইভ্যালুয়েশন অ্যান্ড লার্নিং অ্যাডভাইজার ড. কান্তা জামিল, ড. ফিদা মেহরান, ড. রিয়াদ মাহমুদ এবং ইউএসএআইডি’র এমসিএইচডি শাখার গবেষণা বিভাগের প্রধান ড. কামরুন নাহার, ডাটা ফর ইম্প্যাক্টের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. মিজানুর রহমান, নলেজ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স স্পেশালিস্ট ড্যাটা ফর ইম্প্যাক্টের সুস্মিতা খান, আইসিডিডিআর’বি’র রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর
ড. শরিফ উদ্দীন লোটাস উপস্থিত ছিলেন।

সারাবাংলা/এসবি/এনএস

আইসিডিডিআরবি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর