প্রতিমা ভাংচুরের ‘গুজবে’ তুলকালাম
৩১ আগস্ট ২০২২ ১৮:৫৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো : চট্টগ্রাম নগরীর পাথরঘাটায় তুচ্ছ ঘটনার জেরে হামলা, মারামারি, থানা ঘেরাওসহ তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছে। পুলিশ জানিয়েছে, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রতিমা বহনকারী একটি ভ্যানগাড়ির সঙ্গে প্রাইভেট কারের ধাক্কা লাগা নিয়ে ‘প্রতিমা ভাংচুরের’ গুজব ছড়িয়ে পরিকল্পিতভাবে এই ঘটনা ঘটানো হয়।
মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) গভীর রাতে নগরীর কোতোয়ালী থানার পাথরঘাটা আশরাফ আলী রোডে এ ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আশরাফ আলী রোডের ফজলু কলোনিতে স্থানীয় সনাতন সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা ‘গণেশ পূজার’ আয়োজন করেন। রাত ১২টার দিকে ভ্যানগাড়িতে করে সাউন্ডবক্সে বাদ্যবাজনা বাজিয়ে গণেশ প্রতিমা নেয়া হচ্ছিল মণ্ডপে। সরু সড়কে প্রতিমা বহনকারী ভ্যানের সঙ্গে একটি প্রাইভেট কারের ধাক্কা লাগে।
ওই কারে চালকের আসনে ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা শেখ জোবায়েরের ছেলে ১৯ বছর বয়সী শেখ মেজোয়ান হোসেন জায়ান। ধাক্কা লাগার পর প্রতিমা বহনকারী তরুণ-যুবকরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তারা প্রাইভেট কার ভাংচুরের চেষ্টা করেন। তখন জায়ান দ্রুত কার নিয়ে এগোতে গিয়ে একটি বাই সাইকেলকে ধাক্কা দেয়। সাইকেলের আরোহী নন্দন দাশগুপ্ত পড়ে গিয়ে আহত হন। শিব নন্দন নামে এক পথচারীও আহত হন। এতে প্রতিমা বহনকারী লোকজন আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। প্রতিমা ভাংচুর করা হয়েছে বলে এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। পাথরঘাটা ও আশপাশের এলাকা থেকে লোকজন সেখানে জড়ো হতে থাকেন।
একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ লোকজন শেখ জোবায়েরের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করেন। তখন দু’গ্রুপে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও মারামারি শুরু হয়। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। আটক করে থানায় নেয়া হয় শেখ মেজোয়ান হোসেন জায়ানকে।
জানতে চাইলে কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘একেবারে তুচ্ছ ঘটনা। প্রাইভেট কারের সঙ্গে প্রতিমা বহনকারী ভ্যানগাড়িতে ধাক্কা লেগেছে। কিন্তু প্রতিমার কোনো ক্ষতি হয়নি। ধাক্কাটাও ইচ্ছাকৃত ছিল বলে প্রাথমিক তদন্তে আমাদের মনে হয়নি। কিন্তু হঠাৎ করে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় যে, প্রতিমা ভাংচুর করা হয়েছে। তখন সেখানে শত, শত লোক জমে যায়। আমরা গিয়ে প্রতিমা সুন্দরভাবে মণ্ডপে পৌঁছে দিই। লোকজনও শান্ত হয়ে ফিরে যান।’
কিন্তু রাত ১টার দিকে সনাতন সম্প্রদায়ের কয়েক’শ তরুণ-যুবক গিয়ে কোতোয়ালী থানার সামনে অবস্থান নেয়। তারা ‘জয় শ্রীরাম’, ‘প্রতিমা ভাংচুরের বিচার চাই’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে তারা থানার মূল ফটক পেরিয়ে ভেতরে গিয়ে প্রবেশপথ আটকে বিক্ষোভ করতে থাকেন। ওসিসহ পুলিশ কর্মকর্তারা বারবার অনুরোধের পরও তাদের সরাতে পারেনি। ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত তারা থানায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন।
ওসি জাহিদুল কবীর বলেন, ‘কিছু উচ্ছৃঙ্খল ছেলে প্রথমে ঘটনাস্থলে এবং পরে থানায় এসে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করে। প্রতিমা অক্ষত থাকার পরও তারা ভাংচুরের দাবি করে স্লোগান দিতে থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এই গুজব ছড়িয়ে পড়ে। তুচ্ছ ঘটনাটিকে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের রূপ দেওয়ার চেষ্টা হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে থানায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। আমাদের প্রস্তুতি দেখে ভোর সাড়ে ৪টার দিকে উচ্ছৃঙ্খল যুবকরা থানা ছেড়ে যায়।’
এদিকে বুধবার দুপুরে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পাথরঘাটা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পুলক খাস্তগীর এবং বিবদমান দু’পক্ষের উপস্থিতিতে কোতোয়ালী থানায় সমঝোতা বৈঠক হয়। উপস্থিত ছিলেন নগর পুলিশের কয়েকজন উর্দ্ধতন কর্মকর্তা, মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা।
ওসি জাহিদুল কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘আহত নন্দন দাশগুপ্ত ও শিব নন্দনের পরিবারের লোকজন সমঝোতার ভিত্তিতে তাদের অভিযোগ প্রত্যাহার করেছেন। উভয়পক্ষের লোকজন কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই মর্মে লিখিত অঙ্গীকারনামা দিয়েছেন। আটক শেখ জায়ানের কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের জিম্মায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’
পাথরঘাটা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পুলক খাস্তগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘একেবারে অনাকাঙ্ক্ষিত তুচ্ছ একটি ঘটনাকে বড় করা হয়েছে। রাস্তা সরু, ভ্যানে করে প্রতিমা নেয়ার সময় প্রাইভেট কারের হালকা ধাক্কা লাগে। কিছু উচ্ছৃঙ্খল ছেলে বাড়াবাড়ি শুরু করে। খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থলে যাই। ততক্ষণে প্রতিমা ভাংচুরের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। অথচ প্রতিমার কোনো ক্ষতি হয়নি। স্থানীয়রা থানায় গিয়েও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেছে। যা-ই হোক, আমরা আপস মীমাংসার মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান করেছি। এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন বজায় থাকে সেজন্য আমরা সচেষ্ট আছি।’
এদিকে দুপুরে পাথরঘাটার আশরাফ আলী রোডে ফজলু কলোনির ওই পূজামণ্ডপে গিয়ে পুলিশ পাহারা দেখা গেছে। ওই এলাকার তিনটি স্পটে পুলিশ মোতায়েন দেখা গেছে।
সারাবাংলা/আরডি/একে