বর্ষায় হয়নি কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি, ভয়াবহ ক্ষতির মুখোমুখি কৃষি
২ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১২:৫৭
যশোর: যশোরে এবার বর্ষা মৌসুমে অর্ধেক বৃষ্টিপাতও হয়নি। ভয়াবহ বৃষ্টিহীনতায় প্রকৃতি হচ্ছে রুক্ষ, পানির লেয়ার যাচ্ছে নেমে, ধান উৎপাদনের ওপর ইতোমধ্যে প্রভাব পড়েছে। গ্রামাঞ্চলের পুকর, মাঠ, ডোবা-নালা, খাল-বিল সবকিছুই শুস্ক হয়ে রয়েছে। এতে এলাকার স্বাভাবিক পরিবেশ হচ্ছে বিপর্যস্ত। শুধু কৃষির সঙ্গে জড়িতরাই নয়, পরিবেশবাদীরাও এই অবস্থা নিয়ে শঙ্কিত। এ অবস্থাকে ভয়াবহ অশনি সংকেত মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যশোরের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য মতে, জুন থেকে আগস্ট এই ৩ মাস পুরো বৃষ্টির মৌসুম। চলতি বছর এসময়ে যশোরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ৪১৯ মিলিমিটার। ২০২১ সালে তা ছিল ৮২৮.৭০ মিলিমিটার এবং ২০২০ সালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম থাকলেও এই ৩ মাসে মোট বৃষ্টিপাত ছিল ৬১২.৭৭ মিলিমিটার।
চলতি বছর সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে আগস্ট মাসে, যার পরিমাণ প্রায় ১৫৬ মিলিমিটার। তবে ২০২০ সালে একইসময় ২৪৩.২৮ মিলিমিটার এবং ২০২১ সালে এই বৃষ্টির পরিমাণ ছিল ২২২.৩৫ মিলিমিটার।২০২১ সালের জুলাই মাসে সব চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছিল, এর পরিমাণ ছিল ৩২১ মিলিমিটার, সেখানে চলতি বছর জুলাই মাসে বৃষ্টি হয়েছে মাত্র ১৪৫.২৫ মিলিমিটার। গত বছর জুন মাসে ২৮৫.৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও এবছর মাত্র ১১৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সেখানে ২০২০ সালের জুনেও ২১৭.৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল।
কৃষিবিভাগ জানিয়েছে, যেকোনো সূচকে এবার বৃষ্টির পরিমাণ ভয়াবহভাবে কম হয়েছে। এর প্রভাবও পড়তে শুরু করেছে। যশোর ছাড়াও মাগুরা, ঝিনাইদহ, নড়াইল অঞ্চলের বিস্তীর্ণ মাঠে পাট জাগ দেওয়ার অভাবে শুকিয়ে যেতে দেখা গেছে। কোথাও একটু পানি পেলে চাষিরা ভাগাভাগি বা পর্যায়ক্রমে পাট জাগ দিয়েছে বলে জানান। অনেক জায়গায় স্যালো মেশিনে পানি তুলে ডোবা ভরাট করে পাট জাগ দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
চাষিরা জানান, যশোর তো বটেই, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এসব ঘটনা নজিরবিহীন। পানির অভাবে পাটের উৎপাদন, আশের মান যথাযথ হচ্ছে না, পরিবহন, শ্রমিক খরচসহ সার্বিকভাবে ব্যয় বহুল অবস্থায় পৌঁছেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে পাট চাষ নিয়ে সন্ধিহান তারা।
এদিকে, সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে আমন ধান উৎপাদনে। মৌসুমের শুরুতে পানির অভাবে চাষিরা বীজতলা তৈরি করতে পারেনি। অনেকেই ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের মাধ্যমে বীজতলা করলেও পরে আবারও পানির অভাবে সেই চারা লাল হয়ে মারা গেছে। এরপরও বৃষ্টি অভাবে সময় মতো ধান রোপণ করতে পারেনি।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছিল, যশোরের ১ লাখ ৩৯ হাজার হেক্টর জমিতে চাষের লক্ষ্য থাকলেও মধ্য শ্রাবণ পর্যন্ত চাষ হয়েছিল মাত্র ১৯ হাজার হেক্টর জমিতে। ১৫ আগস্টের মধ্যে রোপণ শেষ করার লক্ষ্য থাকলেও বিপুল পরিমাণ জমি চাষের অপেক্ষায় ছিল বৃষ্টির জন্য। পরে হাজার হাজার কৃষক বাধ্য হয়েই স্যালো ও ডিপ মেশিনে পানি তুলে আমন চাষ করেছেন।
যশোরের কৃষি সেচ বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আষাঢ়-শ্রাবণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর সাধারণত ২-৩ ফুটের মধ্যেই থাকে, অথচ এবার শ্রাবণের মাঝামাঝি সেই পানির স্তর প্রায় ২৩ ফুটে নেমে গিয়েছিল।
সদরসহ বিভিন্ন উপজেলার অন্তত ১২-১৪ জন কৃষকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এই পানির স্তর নেমে যাওয়া মানেই সাধারণ টিউবওয়েলে পানি উঠবে না, মাটির জো থাকবে না, ফসল ফলবে না। খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ায় স্যালো ও ডিপ টিউবওয়েলে পানি পাওয়া যাবে না।
যশোর শহরসহ শহরাঞ্চলের আশপাশের মানুষ সাধারণত নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে পানির স্তর নেমে যাওয়া, টিউবওয়েলে পানি না ওঠার চিত্র দেখেছে। কিন্তু এবছর ঘোর শ্রাবণ মাসেও বিস্তীর্ণ এলাকার টিউবওয়েলে পানি ওঠেনি। এখন থেকেই শুধু কৃষক বা চাষি পর্যায়ের মানুষ নয় গৃহস্থালি কাজ-কর্মও পানি অভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ অবস্থা চললে আগামী শুষ্ক মৌসুমে বোরোর আবাদ নিয়েও চিন্তিত তারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হক জানান, যশোর বরাবরই কৃষি উদ্বৃত্ত অঞ্চল। সবজিতেও দেশ সেরা, মৎস্য চাষ ও উৎপাদনেও দেশ সেরা অঞ্চল। বৃষ্টি যথেষ্ট না হওয়ায় সব কিছু ক্ষতিগ্রস্ত এবং বিপর্যস্ত হবে। জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে কৃষিবিভাগও সাধ্যমতো সব দিক খতিয়ে দেখে পরিবর্তনশীল সময়ে নতুন জাত ও ফসলের চিন্তা করছে।
যশোরে গত সপ্তাহে যশোর-ফরিদপুর অঞ্চলের ১১ জেলার সব পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা-কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্টদের নিয়ে কৃষিবিভাগ এক কর্মশালা আয়োজন করে। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এতে প্রধান অতিথি ছিলেন। সেখানেও মন্ত্রীসহ কৃষি কর্মকর্তা ও চাষি পর্যায়ে এবছর বৃষ্টিহীনতা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। কৃষিমন্ত্রী নিজেও সেখানে কৃষি বিজ্ঞানীদের এই পরিবেশে ধান-তেলবীজ কেমন হবে বা কীভাবে এই অবস্থা মোকাবিলা করা যায় সে বিষয়ে উদ্ভাবন ও গবেষণার পরামর্শ দেন।
সারাবাংলা/এমও