শীর্ষ ২ নেতার ‘ধীরে চলো নীতি’, ১ অক্টোবর হচ্ছে না সম্মেলন
৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৯:২২
চট্টগ্রাম ব্যুরো: কেন্দ্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের ঘোষণার পরও ১ অক্টোবর চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন হচ্ছে না। ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগে সারাদেশে সকল ইউনিটের সম্মেলন সম্পন্ন করার সাংগঠনিক বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন কবে নাগাদ হতে পারে, সেটা নিয়ে অন্ধকারে আছেন খোদ স্থানীয় নেতারাই। নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দিকেই তাকিয়ে আছেন তারা।
নগর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ইউনিটের জন্য সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, নগর কমিটির দুই শীর্ষ নেতার অনীহা এবং ধীরগতির কারণে নির্ধারিত সময়ে সম্মেলন করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে হতাশা তৈরি হয়েছে সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে।
গত ২৫ মে চট্টগ্রামে এক সাংগঠনিক সভায় এসে কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ ও সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন ১ অক্টোবর চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর আগে, সেপ্টেম্বরের মধ্যে সকল ইউনিট, ওয়ার্ড ও থানা সম্মেলন সম্পন্ন করার কথা জানিয়েছিলেন। তারও আগে, জুনের মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনের ঘোষণা এসেছিল। কিন্তু সাংগঠনিক ধীরগতি ও ইউনিট সম্মেলন নিয়ে বিতর্ক ওঠায় সেটি পিছিয়ে যায়।
২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে চট্টগ্রাম নগরীর ৪৪টি সাংগঠনিক ওয়ার্ডে ইউনিট সম্মেলন শুরু করে নগর আওয়ামী লীগ। প্রতিটি ওয়ার্ডে তিনটি করে ইউনিট আছে। সেই সম্মেলন নিয়ে একাধিক সংঘাত ও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর কেন্দ্র থেকে ২৩ ডিসেম্বর ওয়ার্ড সম্মেলন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।
তৃণমূলের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগে পরস্পর বিরোধী দু’টি ধারার বিরোধ আরও জোরালো হয়। দুটি ধারার একটির নেতৃত্বে মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও আ জ ম নাছির উদ্দীন আছেন। আরেকটি ধারা প্রয়াত নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিউদ্দিনপুত্র মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল তাদের সঙ্গে আছেন।
ইউনিট সম্মেলনের শুরু থেকেই মহিউদ্দিনের অনুসারীরা অভিযোগ করে আসছিলেন, মাহতাব-নাছিরের একক কর্তৃত্ব ও ইচ্ছায় তৃণমূলে সম্মেলন হচ্ছে। বিভিন্ন ইউনিটে মহিউদ্দিন অনুসারী নেতাকর্মীদের বিভিন্ন কৌশলে সদস্য করা হয়নি। তাদের বাদ দিয়েই সম্মেলন করে এক নেতার অনুসারীদের মাধ্যমে কমিটি করে ফেলা হয়েছে।
এ অবস্থায় ইউনিট সম্মেলন নিয়ে বিরোধ নিরসনে গত জানুয়ারিতে কেন্দ্র থেকে পাঁচ সদস্যের একটি ‘রিভিউ কমিটি’ গঠন করে দেওয়া হয়েছিল। কমিটির সদস্যরা হলেন- নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, নগর কমিটির সদস্য শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন এবং সহ সভাপতি নঈমউদ্দিন চৌধুরী ও জহিরুল আলম দোভাষ।
রিভিউ কমিটি কেন্দ্রের অনুমতিক্রমে ১৫ সাংগঠনিক থানার জন্য নগর আওয়ামী লীগের একজন করে নেতাকে দায়িত্ব দিয়ে ১৫টি কমিটি গঠন করে। তাদের ইউনিট সম্মেলন নিয়ে অভিযোগ যাচাই-বাছাইপূর্বক দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসন করে ঐক্যবদ্ধভাবে সম্মেলন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সাংগঠনিক থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা হলেন- কোতোয়ালি থানায় সহ-সভাপতি জহিরুল আলম দোভাষ, বন্দর থানায় ধর্মবিষয়ক সম্পাদক জহুর আহমেদ, পাহাড়তলী থানায় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিক আদনান, ডবলমুরিং থানায় সহ-সভাপতি আলতাফ হোসেন চৌধুরী, হালিশহর থানায় সহ-সভাপতি নঈম উদ্দীন চৌধুরী, খুলশী থানায় যুগ্ম সম্পাদক বদিউল আলম, পাঁচলাইশ থানায় কৃষিবিষয়ক সম্পাদক আহমেদুর রহমান সিদ্দিকী, বায়েজিদ বোস্তামি থানায় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ফারুক, সদরঘাট থানায় বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক মশিউর রহমান চৌধুরী, চকবাজার থানায় সাংগঠনিক সম্পাদক নোমান আল মাহমুদ, ইপিজেড থানায় অর্থ সম্পাদক আবদুচ ছালাম, আকবর শাহ্ থানায় সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন, পতেঙ্গা থানায় সাংগঠনিক সম্পাদক হাসান মাহমুদ হাসনী, চান্দগাঁও থানায় সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী এবং বাকলিয়া থানায় সহ-সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল।
জানা গেছে, নগর আওয়ামী লীগের ১৩২টি ইউনিটের মধ্যে ১২০টির মতো সম্মেলন শেষ হয়েছে। তবে এসব সম্মেলন নিয়ে বিস্তর অভিযোগ ও আপত্তি আছে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের। সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা এসব সমস্যা চিহ্নিত করলেও শীর্ষ নেতাদের প্রভাবের কারণে কোনো সমাধান দিতে পারেননি।
এ অবস্থায় শনিবার (৩ সেপ্টেম্বর) সকালে চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন সার্কিট হাউজে নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক এবং ১৫ সাংগঠনিক কমিটির প্রধানদের নিয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকে সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ইউনিট সম্মেলন নিয়ে নানা অভিযোগ এবং ওয়ার্ড ও থানায় সাংগঠনিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত এক নেতা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইউনিট থেকে আমরা যেসব অভিযোগ পেয়েছি, অদৃশ্য প্রভাবের কারণে সেগুলোর অধিকাংশই নিষ্পত্তি করতে পারিনি। অনেকটা একতরফাভাবে ইউনিটে সম্মেলন হয়েছে। তৃণমূলের নেতাদের অভিযোগ যদি আমরা নিষ্পত্তি করতে না পারি, তাহলে তাদের সামনে যাব কিভাবে? এভাবে দ্বন্দ্বমূলক পরিস্থিতিতে কীভাবে ওয়ার্ড ও থানা সম্মেলন হবে, আমরা জানি না। বিষয়টি আমরা কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদককে জানিয়েছি। নির্ধারিত সময়ে আমরা মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনও করতে পারতাম। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ধীরগতির কারণে হয়নি।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের মোবাইলে কয়েকবার কল দিয়েও সাড়া মেলেনি।
শনিবারের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, আগামী ৮ সেপ্টেম্বর চকবাজার ওয়ার্ডের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে প্রথম দফায় ১৭টি ওয়ার্ডের সম্মেলন সম্পন্ন করা হবে। এর ধারাবাহিকতায় সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে মোট ৪৪টি সাংগঠনিক ওয়ার্ডের পর্যায়ক্রমে সম্মেলন শুরু হবে। এর আগে ৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি সভা হবে। সেই সভা থেকে কোনো ওয়ার্ডে কত তারিখ সম্মেলন হবে-সেটা জানিয়ে দেওয়া হবে। ১৮ সেপ্টেম্বর আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের উপস্থিতিতে চট্টগ্রামে আরেকটি সভা হবে। সেই সভায় সাংগঠনিক বাকি ওয়ার্ডগুলোতে সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ হবে।
জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা মহানগরের সম্মেলন করার আগে প্রতিটি ওয়ার্ড ও থানার সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বাস্তবতার নিরিখে ওয়ার্ডগুলোর সম্মেলন নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। আজকের (শনিবার) সভায় ১৭টি ওয়ার্ড সম্মেলন সেপ্টেম্বরের প্রথমার্ধে এবং বাকিগুলো ১৮ সেপ্টেম্বর আরেকটি সভার মাধ্যমে সমস্যাগুলো সমাধান করে তারিখ নির্ধারণ করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি ৬ সেপ্টেম্বর একটি সভা করে প্রথমার্ধের ওয়ার্ড সম্মেলনগুলোর তারিখ নির্ধারণ করবে। ১ অক্টোবর দুর্গাপূজা শুরু হবে। সেজন্য মহানগর সম্মেলনের তারিখ পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। ১৮ সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠেয় সভায় তৃণমূল সম্মেলনের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে মহানগরের সম্মেলনের তারিখ পুনর্নির্ধারণ করা হবে।’
জানতে চাইলে নগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি ও চসিকের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘যে সভায় ১ অক্টোবর মহানগরের সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়, সেই সভাতেই আমি দুর্গাপূজার বিষয়টি জানিয়েছিলাম। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এবং দুর্গাপূজার কারণে সম্মেলন পেছানোর যে সিদ্ধান্ত, সেটা সঠিক। তবে আমরা চাই, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ওয়ার্ড ও থানা সম্মেলন শেষ করে মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন করা হোক।’
নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নোমান আল মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা একদিকে বিএনপি-জামায়াতের নাশকতা-সন্ত্রাস মোকাবেলা করব, পাশাপাশি চট্টগ্রাম মহানগরে সাংগঠনিক প্রক্রিয়া জোরদার করে সংগঠনকে শক্তিশালী করব। ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ওয়ার্ড সম্মেলন শুরু হচ্ছে। আশা করছি, ওয়ার্ড-থানা পর্যায়ের সব সম্মেলন সুন্দরভাবে সম্পন্ন করে আমরা কিছুটা পেছালেও দ্রুততম সময়ের মধ্যেই মহানগর কমিটির সম্মেলন করতে পারব।’
জানা গেছে, শনিবারের সভায় কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন যেকোনো মূল্যে রাজপথ দখলে রাখার জন্য চট্টগ্রামের নেতাদের নির্দেশনা দেন।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম