সিডও সনদকে আইন হিসেবে স্বীকৃতি চান নারী অধিকারকর্মীরা
৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২৩:২৪
ঢাকা: নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসনের জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৭৯ সালে গৃহীত সিডও বিল গ্রহণ অনুসারে আন্তর্জাতিক সিডও দিবসে একে আইন হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন নারী অধিকারর্মীরা।
শনিবার (৩ সেপ্টেম্বর) বিকেলে দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তারা এই দাবি জানান। প্রতিষ্ঠানটির আনোয়ারা বেগম-মুনিরা খান মিলনায়তনে ‘জাতিসংঘ সিডও কমিটির সমাপনী মন্তব্য (২০১৬): বাস্তবায়ন পর্যালোচনা’ বিষয়ক এই কনসালটেশন সভা অনুষ্ঠিত হয়।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ইউএন সিডও কমিটির প্রাক্তন সদস্য ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, ‘সিডও সনদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সমঝোতা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সিডও এর মূল দুটি ধারা ০২ এবং ১৬,১(গ) এর উপর এখনও সংরক্ষণ বহাল রেখেছে। সিডও সনদকে আইন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। বিগত ৩৭ বছরে সরকারের বিভিন্ন দল দেশ পরিচালনা করছে কিন্তু সিডও সনদ বাস্তবায়নে সংরক্ষণ অব্যাহত রেখেছে, যা নারী পুরুষের সমতা, নারী ক্ষমতায়নের পরিপন্থী। অথচ আফগানিস্তান, কুয়েত, মালদ্বীপ, মৌরিতানিয়াসহ কয়েকটি দেশ সিডও সনদের পূর্ণ অনুমোদন দিয়েছে। বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করে অগ্রযাত্রার পথ সুগম করতে হলে সিডও সনদ বাস্তবায়ন জরুরি।’
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘সিডও সনদ সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার সম্পূরক হিসেবে স্বীকৃত হলেও এই সনদ বাস্তবায়নে এখনো চ্যালেঞ্জ আছে। সরকার কর্তৃক নারীবান্ধব নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও সিডও সনদের ২নং ধারা অনুমোদনের কোনো পদক্ষেপ নেই। পঞ্চাশ বছরে নারীর প্রতি বৈষম্যের মূল কারণ চিহ্নিত করতে পারা একটা অর্জন। তবে সিডওকে এখনো নারীর জন্য অধিকার হিসেবে না দেখে কল্যাণমূলক অ্যাপ্রোচ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।’
স্বাগত বক্তব্যে সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, ‘জাতিসংঘ ১৯৭৯ সালে নারীর মানবাধিকার দলিল হিসেবে সিডও সনদ গ্রহণ করে। বাংলাদেশ সরকার চারটি ধারার ওপর সংরক্ষণ রেখে সিডও সনদ স্বাক্ষর করে। পরবর্তীতে নারী আন্দোলনের ফলে সরকার দুটি ধারার ওপর সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে। সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও সিডও প্রতিবেদনে সংরক্ষণ প্রত্যাহারে সরকারের কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ লক্ষ করা যায় না। সনদের সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে পূর্ণ অনুমোদনের জন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা দরকার।’
ইউএনউইমেনের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ গীতাঞ্জলি সিং বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নকে গুরুত্ব দিয়ে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে। এর ফলে নারীর অগ্রগতি তরান্বিত হচ্ছে। কিন্তু গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট অনুসারে এখনও সমতা প্রতিষ্ঠায় নানা বৈষম্য আছে। সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, বৈষম্যমুক্ত পলিসি, জেন্ডার ডিসএগ্রিডেটেড ডাটা তুলে ধরার বিষয়ে জোর দিতে হবে।’
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর বলেন, ‘পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, বৈষম্যমূলক নীতি পরিহার করে ন্যায্যতা, সমতা প্রতিষ্ঠায় সিডও দলিল হলো একটা ইনস্ট্রুমেন্ট। এটি বাস্তবায়নে শিক্ষার মাধ্যমে সমাজকে প্রস্তুত করতে হবে। আইন বাস্তবায়নের জন্য রাজনীতিবিদ ও সরকারি প্রশাসনকে দায়বদ্ধ করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষক ও পুলিশ প্রশাসনকে জেন্ডার সেনসিটিভ হতে হবে।’
অ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবীর বলেন, ‘নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করতে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সংখ্যা বৃদ্ধি করলে হবে না, গুণগত দিকের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এমন এক সময় সিডও রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা হচ্ছে যখন বিশ্বজুড়ে পিতৃতান্ত্রিকতা, নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্য চরমে। সিডও প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে ইউএন সংস্থাগুলোকে কাজ করতে হবে।’
কেয়ার বাংলাদেশের উইমেন অ্যান্ড গার্লস এমপাওয়ারমেন্ট প্রোগ্রামের পরিচালক হোমায়রা আজিজ বলেন, ‘কতদিন নারী আর কন্যাশিশু অপেক্ষা করলে তাদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। পারিবারিক ক্ষেত্রে কাজের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান চিরাচরিত বৈষম্য আছে। অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে এর প্রভাব পড়ছে। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে দায়িত্বপালন করতে হলে সিডও সনদ বাস্তবায়ন জরুরি।’
আন্তর্জাতিক সম্পাদক দেবাহুতি চক্রবর্তী বলেন, ‘নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে নারীবান্ধব নানা আইন থাকলেও এর প্রায়োগিক দিক দুর্বল। ৫০ বছরে এসে নানা অজুহাত দেখিয়ে এই সনদ অনুমোদন করা হচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকার নবম রিপোর্টে সিডও বাস্তবায়নের ইতিবাচক দিক তুলে ধরবে এই প্রত্যাশা করি।’
বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ফাল্গুনী ত্রিপুরা বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জমাকৃত সিডও অবজারভেশন রিপোর্টে মানবাধিকারের দিকটি উপেক্ষিত হয়েছে। আদিবাসীদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা নিয়ে আরও কাজ করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে হলে আদিবাসী, প্রতিবন্ধী, দরিদ্র্য নারীসহ সকলের অধিকার নিয়ে কাজ করতে হবে।’
দৈনিক সমকাল পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু বলেন, ‘অনেক উন্নয়ন হচ্ছে কিন্ত ভাবাদর্শগত দিকে পশ্চাতপদতা আছে। এখানে সচেতনতার লক্ষ্যে শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগ নিতে হবে। নাগরিক সমাজের ঐক্যবদ্ধ সক্রিয় শক্তি নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।’
সভায় মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক, দলিত সম্প্রদায়ের নারী, বিএনএসকে, বিদেশ ফেরত নারী অভিবাসীকর্মী, স্টেপস-এর প্রতিনিধিরা।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেমের সঞ্চালনায় কনসালটেশন সভায় উপস্থিত ছিলেন ব্লাস্ট, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশন, অ্যাডাব, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবি সমিতি, ওয়াইডব্লিউসিএ, বিএনএসএল, তরঙ্গ, নাগরিক উদ্যোগ, আইসিসিএডি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিনিধি, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দসহ ১০০ জন উপস্থিত ছিলেন।
সারাবাংলা/আরএফ/একে