জাল সনদে এখনও বহাল তবিয়তে বৈমানিক মেহেদী!
৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১০:৪৫
ঢাকা: রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজে সম্প্রতি ১৪ বৈমানিককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আর এই নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এবার বেরিয়ে এলো ফার্স্ট অফিসার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া আল মেহেদী ইসলামের এয়ারলাইন্স ট্রান্সপোর্ট পাইলট লাইসেন্স (এটিপিএল) সনদ জালের বিষয়টি। নিয়োগ পেতে জমা দেওয়া মেহেদীর এটিপিএল সনদটি জাল বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। অথচ সনদ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাকে। যেটি যাচাইয়ের দায়িত্ব ছিল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের।
সারাবাংলার অনুসন্ধান বলছে, আল মেহেদী ইসলাম বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাছে যে এটিপিএল সনদ দাখিল করেছে সেটি জাল। ২০২০ সালের ২০ জুন সিভিল এভিয়েশন অথরিটির একটি প্যাডে সংস্থাটির সহকারী পরিচালক (ফ্লাইট সেফটি) শিরিন সুলতানার সই করা একটি সনদ দাখিল করেছেন তিনি। যেখানে বলা হয়েছে, আল মেহেদী ইসলাম তার এটিপিএল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং সকল গ্রাউন্ডে কৃতকার্য। তিনি বৈমানিক হিসেবে কখনো কোনো দুর্ঘটনা ঘটাননি। সেইসঙ্গে তার কর্মজীবনে সফলতা কামনা করা হয়েছে সনদে।
কিন্তু সিভিল এভিয়েশন সূত্রে জানা যায়, সহকারী পরিচালক শিরিন সুলতানার (বর্তমানে উপ-পরিচালক) সইটি জাল করা হয়েছে। আর এই জাল সনদ দিয়েই বিমানে নিয়োগ পেয়েছেন আল মেহেদী ইসলাম। অপরদিকে, সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ প্রাথমিক তদন্ত করে এই দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ পেয়ে আল মেহেদী ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মাস দেড়েক আগে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি দেয়। কিন্তু কোনো এক অজানা শক্তির কারণে বিমান এখনো তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি।
এদিকে, অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, একজন বৈমানিককে এটিপিএল’র জন্য নয়টি বিষয়ে সিভিল এভিয়েশনে পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে হয়। বিষয়গুলো হচ্ছে— এয়ারক্রাফট জেনারেল নলেজ, ফ্লাইট প্লানিং অ্যান্ড পারফরমেন্স, মেটোরোলজি, হিউম্যান পারফরমেন্স অ্যান্ড লিমিটেশন, প্রিন্সিপল অব ফ্লাইট, আর্টিপ্রসিডিউর, অপারেশন প্রসিডিউর, এভিয়েশন ল অ্যান্ড নেভিগেশন। সেইসঙ্গে বিমানের নিয়োগ পরীক্ষাতেও যোগ্যতা হিসেবে এটিপিএল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার কথা বাধ্যতামূলক রয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আল মেহেদী ইসলাম এটিপিএল পরীক্ষার অংশ নিতে ২০১৯ সালের ২৭ মে থেকে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১০ বার রেজিস্ট্রেশন করেছেন। যার মধ্যে এক বার করে তিনি দুটি বিষয়ে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন এবং অকৃতকার্য হয়েছেন। জানা গেছে, তিনি ২০২০ সালের ২১ অক্টোবর মেটোরোলজি বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে ১০০ নম্বরের মধ্যে ৫৪ পান (অকৃতকার্য) আর ২০২০ সালের ২৮ অক্টোবর হিউম্যান পারফরমেন্স বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে ১০০ নম্বরের মধ্যে ৪৪ পান (অকতৃকার্য)। ফলাফল বলছে, তিনি নয়টি বিষয়ের মধ্যে মাত্র দুটি বিষয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন এবং ফেল করেছেন। উল্লেখ্য, প্রতিটি বিষয়ে পরীক্ষার গড় পাস নম্বর ৮০ শতাংশ।
বিমান সূত্রে জানা যায়, ইতোমধ্যে বিমান আল মেহেদী ইসলামকে সিমুলেটর ট্রেনিং করিয়েছে। যেখানে বিমানের খরচ হয়েছে প্রায় ২০ লাখ টাকা। এই ট্রেনিং শেষে ২২ মে থাইল্যান্ড থেকে দেশে ফেরেন তিনি। নিয়ম অনুযায়ী, সিমুলেটর ট্রেনিংয়ে পাস করার ২৮ দিনের মধ্যে রুট ট্রেনিং করতে হয়। কিন্তু মেহেদী রুট ট্রেনিং করেননি। আর সিমুলেটর ট্রেনিংয়ের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০ জুন। ফলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স আল মেহেদী ইসলামের পেছনে ২০ লাখ টাকা খরচ করে যে সিমুলেটর ট্রেনিং করিয়েছে তার পুরোটাই গচ্চা গেছে। অপরদিকে, জালিয়াতির মাধ্যমে বিমানে নিয়োগ পেয়ে নিয়োগ প্রার্থীদেরও বঞ্চিত করেছেন মেহেদী। সেইসঙ্গে বিমানের লাখ লাখ টাকার ক্ষতি করার পাশাপাশি সুনাম নষ্ট করেছেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বিমানে নিয়োগে প্রার্থীদের যাবতীয় তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের কাজ করে থাকেন সাধারণত বিমানের চিফ অব ট্রেইনিং, পরিচালক (অপারেশন) এবং বিমানের চিফ অব সেফটি। কিন্তু এই ১৪ বৈমানিক নিয়োগের সময় বিমানে কোনো চিফ অব সেফটি ছিল না। তবে পরিচালক অপারেশন হিসেবে তখন দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন ইসমাইল। সনদ জালিয়াতির বিষয়ে জানতে বিমানে নিয়োগ পাওয়া আল মেহেদী ইসলামের ব্যক্তিগত ফোনে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোনটি রিসিভ করেননি।
তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও যাহিদ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই নিয়োগ আমি আসার আগে হয়েছে। ফলে এ বিষয়ে আমি কোনো কিছু বলতে পারব না। এমনকি আমি এর কোনো দায়ভারও নেব না।’
জাল প্রমাণিত হলে কী ব্যবস্থা নেবেন? বা সাধারণত কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়?— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে বিষয়েও আপনাকে আমি কিছুই বলব না। এখন ব্যস্ত আছি। পরে কথা হবে।’ তদন্ত হচ্ছে কি না?- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে ব্যাপারেও কিছু বলতে পারব না।’
তবে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও যাহিদ হোসেন এই নিয়োগের বিষয়ে কিছু জানেন না বলেও নিয়োগকালে তিনি বিমানের পরিচালক (এডমিন) হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।
সনদ জালের বিষয়টি নিয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (সিভিল এভিয়েশন) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি এ সম্পর্কে অবগত না। খোঁজ নিয়ে দেখব, কী ঘটেছে। তবে এমন কিছু ঘটে থাকলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এটা ঘটে থাকলে আমাদের জন্য লজ্জার।’
এ প্রসঙ্গে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিমানে কোনো দুর্নীতিবাজের জায়গা নেই। বৈমানিক নিয়োগে দুর্নীতি নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ হয়েছে। সেগুলো নিয়ে তদন্ত চলছে। এমন কোনো ঘটনা ঘটলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এটা সম্মানের প্রশ্ন। এখানে কোনো দুর্নীতিবাজের স্থান হবে না।’
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে সম্প্রতি নিয়োগ নিয়ে নানা দুর্নীতির কথা শোনা যাচ্ছে। বিমানকে এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া দরকার। এতে বহির্বিশ্বে বিমানের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। কেউ যদি সনদ জালিয়াতি করে তাহলে তার হাতে একটি উড়োজাহাজ এবং শত শত মানুষের জীবন কিভাবে নিরাপদ? এখনি এসব দুর্নীতিবাজদের শনাক্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। নয়তো বিমানের সুনাম নষ্টের সঙ্গে সঙ্গে বড় কোনো দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। যেখানে বিমানকে বিশাল মূল্য দিতে হতে পারে।’
উল্লেখ্য, বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজে ফার্স্ট অফিসার হিসেবে নিয়োগ পেতে আবেদন করেছিলেন ১০ জন। এদের মধ্যে নিয়োগ পান ছয়জন। নিয়োগপ্রাপ্ত মেহেদী ছাড়া অন্যরা হলেন- সাদিয়া আহমেদ, বরকত এ খোদা, রেজওয়ান আহমেদ, মহিত রেজওয়ান ও আতিকুর রহমান। তবে রেজওয়ান আহমেদ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির বিষয়টি বুঝতে পেরে সম্প্রতি বিমানের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ইউএসবাংলা এয়ারলাইন্সে যোগ দিয়েছেন। তবে নিয়োগ পাওয়া সাদিয়া আহমেদ ও তার স্বামী বিমানে কর্মরত চিফ অব ট্রেনিং ক্যাপ্টেন সাজিদের সঙ্গে আল মেহেদী ইসলামের গভীর সখ্যতা রয়েছে বলে জানা গেছে। শুধু তাই নয়, সাদিয়া আহমেদের নিয়োগেও সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
সারাবাংলা/এসজে/পিটিএম