‘হুন্ডিতে গত বছর ৭৫ হাজার কোটি টাকা মানি লন্ডারিং’
৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৮:২২
ঢাকা: দেশে গত বছর হুন্ডির মাধ্যমে ৭৫ হাজার কোটি টাকা মানি লন্ডারিং হয়েছে। সারাদেশে তিনটি গ্রুপের পাঁচ হাজার মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) এজেন্টের হুন্ডি ব্যবসায় সক্রিয় বলে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা সিআইডি জানিয়েছে।
বুধবার (৭ সেপ্টেম্বর) রাতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহার করে ডিজিটাল হুণ্ডি চক্রের মূলহোতাসহ ১৬ জনকে গ্রেফতার করে সিআইডির ফিইনান্সিয়াল ও সাইবার ক্রাইম ইউনিট।
বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর মালিবাগ সিআইডি সদর দফতরের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া এ তথ্য জানান।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় গত ৪ মাসে ২৫ কোটি টাকা মানি লন্ডারিং করেছে চক্রটি।
সিআইডি প্রধান বলেন, ‘সংঘবদ্ধ এই হুন্ডিচক্র প্রবাসে বাংলাদেশিদের সংগ্রহ করা মুদ্রা বাংলাদেশে না পাঠিয়ে ওই বৈদেশিক মুদ্রারমূল্য স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ করে। তারা তিনটি গ্রুপ থেকে এই কাজটি করে থাকেন।’
প্রথম গ্রুপ বিদেশে অবস্থান করে প্রবাসীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে। দেশে থাকা যারা টাকা পাচার করতে চায় তাদের দেয়। দ্বিতীয় গ্রুপ পাচারকারী ও তার সহযোগীরা দেশীয় মুদ্রায় এমএফএস এর এজেন্টদের কাছে পাঠায়। পরে তৃতীয় গ্রুপ বিদেশে অবস্থানকারী প্রবাসীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে এমএফএস নাম্বারে দেশীয় মুদ্রায় পরিশোধ করে।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন হুন্ডি এজেন্ট আক্তার হোসেন, দিদারুল আলম সুমন, খোরশেদ আলম ইমন, শামীমা আক্তার, বিকাশ এজেন্ট রুমন কান্তি দাস জয়, আবদুল বাছির, মাহাবুবুর রহমান সেলিম, আবদুল আউয়াল সোহাগ, ফজলে রাব্বী, বিকাশ ডিএসএস হোসাইনুল কবির, নবীন উল্লাহ, জুনাইদুল হক, আদিবুর রহমান, আসিফ নেওয়াজ, ফরহাদ হোসাইন ও রাশেদ মঞ্জুর ফিরোজ।
এ সময় তাদের কাছ থেকে নগদ ১০ লাখ ৪৬ হাজার ৬৮০ টাকা, চারটি সিমে ৩ কোটি ৪৬ লাখ ৪৭ হাজার ২২৯ জব্দকৃত ইলেকট্রনিক টাকা, ৩৪টি মোবাইল, ৩টি ল্যাপটপ, একটি ট্যাব, ৩৩টি সিম, একটি হাডডিক্স, ৭টি মডেম ও ১০টি চেক বই জব্দ করা হয়।
সিআইডি প্রধান বলেন, ‘মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায় ব্যবহার করে বিলিয়ন ডলারের ডিজিটাল হুন্ডি কারবার করে আসছে। সাম্প্রতিক বিশ্ব পরিস্থিতি এদেশের অর্থনীতির ওপর যে চাপ তৈরি করেছে তা মোকাবিলা করার জন্য সরকার অত্যন্ত তৎপর। হুন্ডি সবসময় রিজার্ভের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।’
বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর এই ঝুঁকি মোকাবিলায় সিআইডি হুন্ডি কার্যক্রমের ওপর নজরদারি শুরু করে।
অনুসন্ধানের মাধ্যমে জানা যায় যে একটি সংঘবদ্ধ চক্র অবৈধভাবে হুন্ডির মাধমে বিদেশে অর্থপাচার এবং বিদেশে অবস্থানরত ওয়েজ আনারিদের কষ্টার্জিত অর্থ বিদেশ থেকে বাংলাদেশে না এনে স্থানীয় মুদ্রায় মূল্য পরিশোধ করার মাধ্যমে মানি লন্ডারিং অপরাধ করে আসছে।
এসব চক্র প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে এমএফএস ব্যবহার করে ক্যাশ ইনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হুন্ডি করছে। এমএফএস এজেন্টদের সহযোগিতায় পাচারকারীরা বিদেশে স্থায়ী সম্পদ অর্জনসহ অনলাইন জুয়া, মাদক কেনাবেচা, স্বর্ণচোরাচালান, ইয়াবা ব্যবসাসহ প্রচুর অবৈধ ব্যবসাও পরিচালনা করছে।
ডলারের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কেন অভিযান চালিয়ে এদেরকে গ্রেফতার করা গেল না। সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত না পাওয়ার কারণে ধরা যায়নি। সিআইডির গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা তথ্য মিল পাওয়ার ভিত্তিতে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়।’
বাংলাদেশ সরকার বিভিন্নভাবে প্রণোদনা দিচ্ছে এর পরেও বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা না পাঠিয়ে অবৈধভাবে কেন বাংলাদেশিরা টাকা পাঠাচ্ছে জানতে চাইলে সিআইডি প্রধান বলেন, ‘এই বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে আমাদের একটি মিটিং হয়েছে। আমার বিশ্বাস এর একটি সুষ্ঠু সমাধান হবে।’
সিআইডি ৫ হাজার মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস এজেন্টকে শনাক্ত করেছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, ‘মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস এজেন্ট অবৈধ কার্যক্রম করছে। আমরা টার্গেট করে তিনটি গ্রুপকে ধরেছি। এরইমধ্যে যারা অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল সিআইডির তৎপরতায় সেখান থেকে তারা সরে আসতে শুরু করেছে। আমরা ইন্টেলিজেন্স বেইজ অপারেশন পরিচালনা করি। সিআইডি ৫ হাজার মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস এজেন্টদের নজরদারির মধ্যে রেখেছে। দু’একদিনের মধ্যে অবৈধভাবে লেনদেন ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ কমে যাবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিকাশ, রকেট, নগদ ছাড়াও যেসব মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস রয়েছে তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে মিটিং করিনি। আনুষ্ঠানিকভাবে মিটিং না করার কারণ ইন্টেলিজেন্স যাতে ফাঁস না হয়।’
লাখ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি সৌদি আরবে কাজ করেন। তাদের টাকাগুলো ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে এলে দেশের রিজার্ভ অনেক ভারী হতো। কিন্তু সৌদিতে এজেন্ট আছে। ওই দেশের এজেন্টরা বাংলাদেশি এজেন্টদের কাছে কথা বলে হুন্ডির মাধ্যমে অবৈধভাবে টাকা পৌঁছে দিচ্ছে। তবে এটি খুব শিগগিরই বন্ধ হয়ে যাবে এবং দেশের রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পাবে।
এ ঘটনায় মানিলন্ডারিং আইনে ঢাকা ও চট্টগ্রামে পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে চট্টগ্রাম কোতয়ালী থানায় একটি মামলায় ২৩ জন নামীয় আসামির মধ্যে ১১জন গ্রেপ্তার। ওই মামলায় আরও ১০-১২ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় এজাহা নামীয় ১০ আসামির মধ্যে দুজন গ্রেফতার হয়েছে। এতে আরও ২০-২৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর খিলগাঁও মডেল থানায় ১২ নামীয় আসামির মধ্যে তিনজন গ্রেফতার হয়েছেন। অজ্ঞাতনামা আরও ৫-৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।
হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো টাকা জঙ্গিবাদে কোনো কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে সিআইডি প্রধান বলেন, ‘তদন্ত করে দেখা হবে বিষয়টি।’
সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) আশরাফুল আলম, ফিইনান্সিয়াল ইউনিটের এসএসপি হুমায়ূন কবির ও মিডিয়া অফিসার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান উপস্থিত ছিলেন।
সারাবাংলা/ইউজে/একে