Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

থানায় পুলিশ হত্যা ও অস্ত্র লুটের পর ৩০ বছর আত্মগোপনে

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১০ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৯:৪৫

ঢাকা: নাটোরের গুরুদাসপুর থানায় ১৯৮৭ সালে হামলা করে পুলিশ সদস্য খুন, অস্ত্র লুট ও চরমপন্থী আসামিকে থানা থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে ৩০ বছর পর গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৩)।

তার নাম সাইফুল ইসলাম। তিনিও একজন চরমপন্থী।

শনিবার (১০ সেপ্টেম্বর) দুপুরে কারওয়ান বাজার মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন সাংবাদিকদের এ সব তথ্য জানান।

তিনি বলেন, ‘১৯৮৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার হাটের দিন সকাল ১টার দিকে একদল চরমপন্থী ছদ্মবেশে লুঙ্গি, গামছা পরিহিত অবস্থায় হাতে পোটলা নিয়ে হাটের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে থাকে। ওই পোটলাগুলোর মধ্যে তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্র লুকানো ছিল। তাদের মধ্যে কিছু লোক অস্ত্র প্রদর্শন করে টেলিফোন অফিস নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সেন্ট্রাল কমান্ড বিকল করে দেয় এবং কয়েকজন জিডি করার উদ্দেশ্যে থানায় প্রবেশ করে অস্ত্রের মুখে থানা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।’

এ সময়ে থানায় দায়িত্বরত কনস্টেবল হাবিবুর রহমান বাধা দিলে চরমপন্থীরা তাকে গুলি করে হত্যা করে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে থানার অস্ত্রাগার লুট করে দুইটি এসএমজি, ৪ টি এসএলআর, ১৮ টি ৩.৩ রাইফেল ও গোলাবারুদ লুট করে থানার লকআপে বন্দি চরমপন্থী আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তারপর আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য তারা একযোগে টেলিফোন অফিস ও থানা কম্পাউন্ডে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। তারপর তারা লুণ্ঠিত মালামাল নিয়ে চাঁচকৈর হয়ে পূর্বদিকে গারিসাপাড়া হয়ে ধামাইর মাঠের দিকে চলে যায়।

ওই ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে গুরুদাসপুর থানায় দুটি মামলা করে পুলিশ। দুই মামলার তদন্ত শেষে সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তা ২০ জন আসামি গ্রেফতার করেন। গ্রেফতার আসামিদের জবানবন্দি, সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ৪৯ জনকে আসামি করে ১৯৯০ সালে চার্জশিট দেয় পুলিশ। বিচার প্রক্রিয়া শেষে ২০০৭ সালে ওই দুই মামলার রায় ঘোষণা করেন আদালত।

র‌্যাব-৩ এর আভিযানিক দল গোপন সংবাদের মাধ্যমে জানতে পারে ওই মামলার একজন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নারায়ণগঞ্জ এলাকায় আত্মগোপন করে আছে। তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় এবং গোয়েন্দা নজরদারির মাধমে গতকাল (৯ সেপ্টেম্বর) রাতে অভিযান চালিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ এলাকা হতে ছাত্তার নামে ছদ্মবেশে আত্মগোপন করা অবস্থায় সাইফুল ইসলাম ওরফে মানিককে (৫৬) গ্রেফতার করা হয়।

আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে জানায় যে, সে ১৯৮৪ সালে চরমপন্থী নেতা তারেকের মাধ্যমে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি লাল পতাকা ওরফে সর্বহারা দলে যোগ দেয়। চরমপন্থী নেতা তারেক প্রতি সপ্তাহে চাটমোহর এলাকায় উঠতি বয়সের যুবকদের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে উঠান বৈঠক করত। উক্ত বৈঠকে সে আকর্ষণীয় কথাবার্তা বলত। সে বলত, তার দলে যোগ দিলে কোনো অভাব অনটন থাকবে না। তারা সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করবে। কেউ তাদের কাজে বাধা দিলে তাদেরকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবে। যদি সরকার বা সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তবে তারা পুলিশ হত্যা করে থানা ফাঁড়ি লুট করবে। তাদের এরূপ আকর্ষণীয় কথায় মুগ্ধ হয়ে সে সক্রিয়ভাবে চরমপন্থীদের হত্যা, লুটপাট, ত্রাস সৃষ্টি, অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির কাজে অংশগ্রহণ করতে থাকে। চরমপন্থীদের সঙ্গে যোগ দেওয়ায় এলাকায় সবাই তাকে সমীহ করত।

চরমপন্থী নেতা তারেক ওই ঘটনার দুই মাস পূর্ব হতে গুরুদাসপুর থানা লুট করার পরিকল্পনা করে। এ জন্য সে ঝিনাইদহ, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, পাবনা, টাঙ্গাইল এলাকা থেকে চরমপন্থী দলের সদস্যদের আহ্বান জানিয়ে একত্রিত করে।

ঘটনার দিন তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৬০ জন নাটোর, ধামাইর মাঠে জড়ো হয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী ছদ্মবেশে লুঙ্গি, গামছা পরিহিত অবস্থায় পোটলার মধ্যে অস্ত্র লুকিয়ে গুরুদাসপুর থানা ও টেলিফোন অফিসের আশপাশ এলাকা এবং হাট এলাকায় অবস্থান নেয়।

ঘটনার এক সপ্তাহ আগে থেকেই কয়েকজন সার্বক্ষণিক টেলিফোন অফিসের কর্মী এবং গুরুদাসপুর থানার ফোর্সের গতিবিধির ওপর নজরদারি করছিল। তাদের সবুজ সংকেত পাওয়া মাত্রই সুলতানের নেতৃত্বে ৫ জন টেলিফোন অফিসে প্রবেশ করে সেন্ট্রাল কমান্ড বিকল করে দেয়। অন্যদিকে তারেকের নেতৃত্বে সে সহ প্রথমে ৪ জন জিডি করার জন্য থানায় প্রবেশ করে এবং মজিদের নেতৃত্বে ১০ জন থানা ব্যারাকে প্রবেশ করে সকল ফোর্সকে কক্ষের মধ্যে বন্দি করে রাখে।

এ সময় ডিউটিরত কনস্টেবল হাবিবুর রহমান প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চাইলে তারেক গুলি করে কনস্টেবল হাবিবুর কে হত্যা করে। গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে থানার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তখন তারেক অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে অস্ত্রাগার থেকে সব অস্ত্র, গোলাবারুদ লুটপাট করে এবং থানার লকআপে বন্দি চরমপন্থী দলের আটককৃত একজন সদস্য ইয়াকুবকে তালা ভেঙে মুক্ত করে। এরপর তারা বোমা ফাটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে থানা কম্পাউন্ড এবং টেলিফোন অফিস ত্যাগ করে লুণ্ঠনকৃত অস্ত্র নিয়ে হাটের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে চলে যায়।

হাটের মধ্যে অনেক লোক উপস্থিত থাকলেও কেউ তাদের বাধা দেওয়ার সাহস করেনি। তাছাড়াও পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী– তাদের দলের সদস্যরা ভীড়ের মধ্যে ছদ্মবেশে লুকিয়ে ছিল। কেউ তাদের কাজে বাধা দিলে প্রতিহত করার পূর্ব প্রস্তুতি তাদের ছিল। লুণ্ঠনকৃত অস্ত্র তারেক, সুলতান, মজিদ এবং ইয়াকুব তাদের হেফাজতে নিয়ে চাটমোহর, চলনবিল এলাকায় লুকিয়ে রাখে। ঘটনার শেষে ধৃত সাইফুল তার বাড়িতে গিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে থাকে।

১৯৮৮ সালে তারেকের নেতৃত্বে চাটমোহর থানার খোতবাড়ি এলাকায় মাঠের মধ্যে রাতে নকশালপন্থী এবং সর্বহারাদের মধ্যে সম্মুখযুদ্ধ হয়। উক্ত ঘটনায় নকশালপন্থী ১২ জন নিহত হয়। ওই ঘটনার পর সে সহ সর্বহারা দলের সদস্যরা চলনবিলে গোসল করে যার যার বাড়িতে চলে যায়। ভোর হলে পুলিশ ১২টি লাশ উদ্ধার করে থানায় মামলা রুজু করে।

ওই মামলায় ধৃত সাইফুল গ্রেফতার হয়। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে গুরুদাসপুর থানার অস্ত্র লুটের সত্যতা বেরিয়ে আসে। মামলাগুলোতে জামিনে মুক্ত হয়ে তার পলাতক জীবন শুরু হয়। জামিনে মুক্ত হওয়ার পর সে আদালতে কোনো হাজিরা দেয়নি। থানা লুট ও ১২ নরহত্যা মামলাসহ তার নামে পাঁচটি মামলা রয়েছে।

আসামির জীবন বৃত্তান্ত: আসামি সর্বহারা দলের সক্রিয় সদস্য। সর্বহারাদের নেতৃত্বে পরিচালিত সব কার্যক্রমে সে নিয়মিত অংশগ্রহণ করত। তার নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই। ত্রাস সৃষ্টি, লুটপাট ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ দিয়েই সে জীবিকা নির্বাহ করত। সে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। তারা ৮ ভাই বোন। আসামি ভাই বোনদের মধ্যে বড়। তার ১ ছেলে ও ১ মেয়ে রয়েছে। বর্তমানে সে নারায়ণগঞ্জ, রূপগঞ্জ এলাকায় ছাত্তার নামে শ্রমিক সরদার হিসেবে কাজ করত।

২০১৮ সালে সে তার নাম পরিবর্তন করে সাইফুল প্রধান নামে নারায়ণগঞ্জে রূপগঞ্জ এলাকায় ভোটার হিসেবে এনআইডি তৈরি করে। রূপগঞ্জ এলাকায় সে ছাত্তার নামে পরিচিত। ওই এলাকার মানুষ তার অপরাধ কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত নয়।

পলাতক জীবন: ১২ নরহত্যা মামলার পর তারেকসহ চরমপন্থী দলের সদস্যরা চাটমোহর থেকে আত্মগোপন করে সিরাজগঞ্জে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে তারা তাদের দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করত। ১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাসে তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে সে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে।

জামিনে মুক্ত হয়ে সে তারেকের সঙ্গে যোগাযোগ করে চরমপন্থী দলের সঙ্গে পুনরায় হত্যা, লুটপাট, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, অস্ত্র প্রদর্শন করে ত্রাস সৃষ্টি, অস্ত্র নিয়ে এলাকায় মহড়া দেওয়া, অর্থের বিনিময়ে জমি দখল, পারিবারিক বিরোধ মিমাংসা ইত্যাদি কাজে লিপ্ত ছিল। এ সময় সে তারেকের সঙ্গে নৌকায় বিলের মধ্যে অবস্থান করত। দলের কার্যক্রম শেষে তারা পুনরায় সশস্ত্র অবস্থায় বিভিন্ন এলাকায় নৌকার মধ্যেই জীবনযাপন করত। ২০০৪ সালে চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে র‌্যাবের সাঁড়াশি অভিযান শুরু হলে তারেকের নির্দেশে চরমপন্থীরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তখন সে রাজধানীতে চলে আসে। রাজধানীতে সে কিছুদিন বাসের হেলপারি করে। ট্রাকে মালামাল লোড আনলোডের শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। তারপর নারায়ণগঞ্জে তার এক আত্মীয়ের বাসায় সে আশ্রয় নেয়। ওই আত্মীয় তাকে একটি গার্মেন্টস কারখানায় চাকরি দেয়। সবার কাছে তাকে ছাত্তার নামে পরিচয় করিয়ে দেয়।

আস্তে আস্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান স্তিমিত হয়ে আসলে তারা আবার মাঝে মাঝে এলাকায় গিয়ে সর্বহারা দলের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। ৭-৮ বছর পূর্বে চরমপন্থী দলের বিরোধে তারেক নিহত হলে সে সর্বহারা দলের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেয়।

এরইমধ্যে সে এনআইডি পরিবর্তন করে রূপগঞ্জ এলাকার ভোটার হিসেবে নিজেকে ছাত্তার নামে প্রতিষ্ঠিত করে। স্ত্রী সন্তান নিয়ে নারায়ণগঞ্জে বসবাস করত। বর্তমানে চরমপন্থী দলের সদস্যদের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। তারেকের মৃত্যুর পর ওই গ্রুপের সদস্যরা বিচ্ছিন্নভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ওই ঘটনার সাথে জড়িত অপরাপর সদস্যদের শনাক্ত করে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে র‌্যাব জানিয়েছে।

সারাবাংলা/ইউজে/একে

আসামি ধরা চরমপন্থী টপ নিউজ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর