জ্বালানি নিরাপত্তায় ১৯৭৬৮ কোটি টাকার প্রকল্প বিপিসি’র
১২ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১০:৫০
ঢাকা: দেশের পেট্রোলিয়ামের চাহিদা পূরণ এবং জ্বালানি নিরাপত্তা সুদৃঢ় করতে চায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এজন্য ১৯ হাজার ৭৬৮ কোটি ৯৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছে সংস্থাটি। ‘ইন্সটলমেন্ট অব ইআরএল ইউনিট-২’ শীর্ষক এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নিজস্ব তহবিল থেকে পুরো অর্থ খরচ করবে বিপিসি।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পর গত ২৪ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভা। গত ৫ সেপ্টেম্বর জারি করা ওই সভার কার্যবিরণী।
সূত্র জানায়, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ইস্টার্ন রিফাইনারির জেনারেল ম্যানেজার রায়হান আহমেদ প্রকল্পের পটভূমি এবং গ্রহণের ভিত্তি বিষয়ে পিইসি সভায় তুলে ধরেন। এসময় তিনি দেশে পেট্রোলিয়াম পণ্যের চাহিদা ও উৎপাদনের সক্ষমতার বিবরণ দিয়ে বলেন, ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড বর্তমানে বছরে ১.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন অপরিশোধিত তেল প্রক্রিয়াজাত করতে সক্ষম। এটি দেশের মোট চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ। এই চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৬-২০২৭ সালে চাহিদা দাঁড়াবে প্রায় ৮.০৩ মিলিয়ন টনে। এছাড়া ২০২৯-২০৩০ সালে চাহিদা দাঁড়াবে প্রায় ১০ .২৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন। প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে আরও ৩.০ মিলিয়ন মেট্রিক টনের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ৪.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন। অর্থাৎ ২০২৬-২০২৭ সালে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পরও চাহিদার ঘাটতি রয়ে যাবে প্রায় ৩.৫৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রকল্পটি বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০ এর আওতায় বাস্তবায়নের জন্য ২০১৪ সালের ১২ জুন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর অনুমোদন নেওয়া হয়। এই বিধানের আওতায় প্ল্যন্ট স্থাপনের জন্য ফিড সার্ভিসেস ফর দ্যা ইন্সটলেশন অব ইআরএল ইউনিট-২ শীর্ষক একটি প্রকল্পের আওতায় ফ্রন্ট অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন তৈরি এবং ইপিসি ঠিকাদার হিসাবে কাজ বাস্তবায়নের জন্য একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ফ্রান্সের টেকনিপের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়।
এছাড়া মূল প্রকল্প এবং এফইইডি প্রকল্পের পরামর্শক সেবা দেওয়ার জন্য অপর একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার ইন্ডিয়া লিমিটেড (ইআইএল) প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে।
পিইসি সভার সভাপতি পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া বলেন, ‘প্রকল্পের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য অর্থের নিশ্চয়তা এবং বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা প্রাপ্তি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখার জন্য কাঁচামালের উৎসের বহুমুখীকরণ সম্পর্কে অনুসন্ধান করা যেতে পারে। প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে প্ল্যান্ট পরিচালনার জন্য জনবল সংস্থানের উদ্যোগ যথাসময়ে নিতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গণপূর্ত অধিদফতরের মাধ্যমে নন-প্ল্যান্ট অবকাঠামোর নির্মাণ কাজ করা যায় কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা যায়। প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান স্কুলকে কলেজে রূপান্তরের এ পর্যায়ে নেওয়ার বিষয়টি তিনি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। এছাড়া নন-প্ল্যান্ট অবকাঠামো নির্মাণ কাজ আরও যাচাই করে প্রকৃত চাহিদাভিত্তিক করার বিষয়ে ব্যয় প্রাক্কলন অনুযায়ী ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) প্রণয়ন করায় প্ল্যান্টের গুণগত মানের কোনরুপ পরিবর্তন যাতে না হয় এ বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার’।
সভায় পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের যুগ্ম প্রধান বলেন, ‘দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ দিয়ে পেট্রোলিয়াম পণ্যের চাহিদা পূরণ করে জ্বালনি নিরাপত্তা সুদৃঢ় করার জন্য জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের আওতাধীন বাংলাদেশ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে এ প্রকল্পটি প্রস্তাব করেছে। চলতি বছর থেকে ২০২৭ সালের জুনে বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ১২৩.১২৭ একর জমি (সংস্থার নিজস্ব ও লিজ করা) ব্যবহৃত হবে। এছাড়া আরও ৫০ একর জমি ভাড়ায় ৫ বছরের জন্য ব্যবহার করা হবে তাই সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন নির্দেশিকা চলতি জুনে এর ১১.২.৬ নং অনুচ্ছেদ অনুযাযী প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদনযোগ্য।’
তবে প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থ বিভাগের ফিনান্সিয়াল এনালিস্ট খালেদ বিন হাফিজ। পিইসি সভায় তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবিত প্রকল্পের জন্য অর্থ বিভাগ গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর লিকুইডিটি সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। এরমধ্যে আট মাস পার হয়েছে এবং চলতি বছরের মার্চের পর হতে বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বিশ্বব্যাপী চরম মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে যার প্রভাব বাংলাদেশেও ব্যাপক ভাবে পরেছে। এজন্য এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা যেতে পারে। এছাড়া বিপিসির বর্তমান চলমান প্রকল্পগুলোর ব্যয় নির্বাহ করার পাশাপাশি এতো বৃহৎ কলেবরের প্রকল্পের ব্যয় নির্বাহ করতে পারবে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।’
সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত প্রকল্পটির মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব ইউরো-৫ মানের গ্যানোলিন ডিজেল উৎপাদন সম্ভব হবে এবং বিদ্যমান রিফাইনারির ডিজেলকে ইউরো-৫ মানে রূপান্তর করা হবে যা পরিবেশ সুরক্ষায় ভূমিকা রাখবে। ইতিমধ্যেই এই প্ল্যান্টের ক্রুড অয়েল পরিবহনের জন্য ইন্সটলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন নামে অন্য একটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে। এই প্রকল্পটির মাধ্যমে বছরে ৪.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন পেট্রোলিয়াম ক্রুড অয়েল পরিবহন করা যাবে। বিপিসির হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে ইআরএল এ ক্রুড অয়েল পরিশোধনের মাধ্যমে পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি ব্যারেলে প্রায় ৯ থেকে ১০ ডলার সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। প্রকল্পটি দেশের গ্যাসোলিন ও জেট ফুয়েলের বর্তমান চাহিদা সম্পূর্ণ পূরণ করতে সক্ষম হবে।
সভায় কার্যক্রম বিভাগের উপপ্রধান বলেন, ‘গ্যাসোলিন ও জেট ফুয়েলের বর্তমান চাহিদা কত এবং ভবিষ্যৎ চাহিদার কোনো প্রক্ষেপণ আছে কিনা, থাকলে সেই তথ্য ডিপিপিতে সংযোজন করা প্রয়োজন। বর্তমানে যেসব দেশ হতে ক্রুড অয়েল আমদানি করা হচ্ছে ভবিষ্যতে ক্রুড অয়েলের আরও উৎস্য অনুসন্ধান করা এবং প্রকল্পের আওতায় স্থাপিত নতুন প্ল্যান্টে যেকোন উৎস থেকে প্রাপ্ত ক্রুড অয়েলই প্রক্রিয়াকরণ করার সুযোগ সৃষ্টির জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যেতে পারে।’
পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের উপপ্রধান বলেন, ‘এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও দেশে পেট্রোলিয়াম পণ্যের ঘাটতি থেকেই যাবে। কাজেই এই ঘাটতি মোকাবিলার জন্য বিপিসি স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াাদী পরিকল্পনা নেওয়ার প্রয়োজন।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি বলেন, ‘প্রকল্পের আর্থিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ বিস্তারিতভাবে করা হয়নি। অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ শুধু আর্থিক প্রফিটকে বেনিফিট হিসাবে গণ্য করা হয়েছে।’
আইএমইডির প্রতিনিধি বলেন, ‘আর্থিক বিশ্লেষণে এ প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৩টি সহায়ক প্রকল্পের ব্যয় এবং জমির ব্যয় ধরা হয়নি। তাছাড়া প্রকল্পের অধিকাংশ অঙ্গেও ব্যয় প্রাক্কলন থোক হিসেবে রাখা হয়েছে।’
পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের প্রধান বলেন, ‘উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) ফার্নিচার ও কম্পিউটার সামগ্রীর স্পেসিফিকেশনে ব্রান্ডের নাম ও ছবি দেওয়া হয়েছে যা ঠিক নয়। প্রকল্পের ক্রয়-প্রক্রিয়া কোন আইনে হবে তা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।’
জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের যুগ্ম সচিব বলেন, ‘প্রকল্পটি বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০ অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা হবে। এক্ষেত্রে আইনের বিধি বিধান যথাযথভাবে অনুসরণ করা হবে।’
পূর্ত নির্মাণ কাজ প্রসঙ্গে শিল্প ও শক্তি বিভাগের তৈল, গ্যাস ও প্রাকৃতিক সম্পদ উইংয়ের সিনিয়র সহকারি প্রধান জানান, যেহেতু বাংলাদেশে বড় বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের সময় সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ের মাধ্যমে করা হয়েছে, কাজেই এই বৃহৎ কলেবরের প্রকল্পটি সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে প্ল্যান্ট ছাড়া পূর্ত কাজ গণপূর্ত অধিদফতরের মাধ্যমে করা সমীচীন হবে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব বলেন, প্রকল্পের প্ল্যান্ট ছাড়া পূর্ত নির্মাণ কাজ গণপূর্ত অধিদফতরের মাধ্যমে করালে সময়ের সামঞ্জস্য বিধানে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
সারাবাংলা/জেজে/এমও