জেলখানায় ‘বাবুলের কক্ষে ওসি’, নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন
১২ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৭:২৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো : স্ত্রী হত্যায় গ্রেফতার হয়ে ফেনী কারাগারে বন্দি বাবুল আক্তার তার কক্ষে স্থানীয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গিয়ে তল্লাশির অভিযোগ এনেছেন। এ জন্য বাবুল আক্তারের পক্ষ থেকে আদালতে তার নিরাপত্তার আবেদন করা হয়েছে। তবে ওসি বাবুল আক্তারের কক্ষে তল্লাশির অভিযোগ নাকচ করেছেন।
সোমবার (১২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ জেবুন্নেছা বেগমের আদালতে বাবুল আক্তারের পক্ষে তার আইনজীবী গোলাম মওলা মুরাদ এ আবেদন দাখিল করেন।
মহানগর পিপি’র কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, আদালত আবেদনটি বাবুল আক্তারের দাখিল করা আরেকটি আবেদনের সঙ্গে নথিভুক্ত করে ১৯ সেপ্টেম্বর শুনানির জন্য সময় নির্ধারণ করেছেন। একইদিন পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদারসহ ছয় পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বাবুল আক্তারের মামলার আবেদনের শুনানির দিন ধার্য আছে।
বাবুলের আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে- গত ১০ সেপ্টেম্বর দুপুরে ফেনী মডেল থানার ওসি নিজাম উদ্দিন ফেনী কারাগারে প্রবেশ করে বাবুল আক্তারের কক্ষে দীর্ঘ সময় ধরে তল্লাশি চালান। হেফাজতে রেখে নির্যাতনের অভিযোগে বাবুল আক্তার যে ছয় পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেছেন, তাদের নির্দেশে ও প্ররোচনায় এ তল্লাশি চালানো হয়েছে। কারাগারে ফেনী মডেল থানার ওসির প্রবেশের বিষয়টি সিসি ক্যামরার ফুটেজ যাচাই করলে নিশ্চিত হওয়া যাবে।’
বাবুলের আবেদনে বলা হয়েছে, আইন-আদালতের তোয়াক্কা না করে বাবুল আক্তারের জীবনের ক্ষতিসাধন ও মানসিকভাবে দুর্বল করার জন্য ওসি এভাবে কারাগারে প্রবেশ করেন। জেল কোড অনুসরণ না করেই, বন্দির কক্ষ তল্লাশির নামে জীবনের ক্ষতি সাধনের চেষ্টায় এ যাত্রায় সফল না হলেও আসামিরা যে কোনো সময় বাদী ও তার পরিবারের জীবননাশসহ যে কোনো ধরনের ক্ষতি করতে পারে।
কারাগারে বাবুল আক্তারের কক্ষে ওসি’র প্রবেশের তদন্ত এবং তার জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ফেনীর জেলা সুপারকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়ার আবেদন জানানো হয়েছে।
আইনজীবী গোলাম মওলা মুরাদ বলেন, ‘জেল কোড অনুসারে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও আদালতের লিখিত অনুমতি ছাড়া থানার পুলিশ কর্মকর্তা কোনোভাবেই জেলখানায় প্রবেশ করতে পারেন না।’
জানতে চাইলে ফেনী মডেল থানার ওসি নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘আমি অন্য একটি মামলার তদন্তের কাজে কারাগারে গিয়ে জেল সুপারের সঙ্গে সাক্ষাত করেছি। আমি বাবুল আক্তারের কক্ষে যাইনি। উনি (বাবুল) যে ফেনী কারাগারে আছেন, সেটি আমার স্মরণেও ছিল না। আদালতের অনুমতি ছাড়া তো ওনার কক্ষে যাবার সুযোগ আমার নেই।’
এর আগে, গত ৮ সেপ্টেম্বর হেফাজতে নিয়ে ‘নির্যাতনের’ অভিযোগে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান অতিরিক্ত আইজি বনজ কুমার মজুমদারসহ ছয় পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের আদালতে একটি মামলার আবেদন করেন সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের পক্ষে তার আইনজীবী।
নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ এর ১৫ (১) এবং ৫ (২) ধারায় দাখিল করা এ মামলার আবেদনে আরও যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে তারা হলেন- পিবিআই চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার মো. নাজমুল হাসান, মেট্রোর পুলিশ সুপার নাঈমা সুলতানা, পিবিআইয়ের সাবেক পরিদর্শক বর্তমানে খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা ও বর্তমানে সহকারী পুলিশ কমিশনার (পাহাড়তলী জোন) একেএম মহিউদ্দিন সেলিম এবং পিবিআইয়ের জেলা পরিদর্শক কাজী এনায়েত কবির।
মামলার আবেদনে বাবুল আক্তার অভিযোগ করেছেন, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের নামে বনজ কুমার মজুমদারের নির্দেশে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা তার সঙ্গে নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণ করেছেন।
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরীর পাঁচলাইশ থানার ও আর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার অদূরে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। স্ত্রীকে খুনের ঘটনায় পুলিশ সদর দফতরের তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদসহ নানা নাটকীয়তার পর ওই বছরের আগস্টে বাবুল আক্তার চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন।
হত্যাকাণ্ডের পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন প্রথম এই খুনে বাবুলের জড়িত থাকার সন্দেহ প্রকাশ করেন। নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাত ঘুরে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলার তদন্তভার পড়ে পিবিআইয়ের ওপর। এরপর আস্তে আস্তে জট খুলতে থাকে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টিকারী চাঞ্চল্যকর এই মামলার।
২০২১ সালের ১১ মে বাবুল আক্তারকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। পরদিন বাবুল আক্তারের মামলায় আদালতে ৫৭৫ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়, যেন উল্লেখ করা হয়- তদন্তে ঘটনার সঙ্গে বাদী বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
একইদিন (১২ মে) দুপুরে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বাদি হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় বাবুল আক্তারসহ আটজনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। পিবিআই হেফাজতে থাকা বাবুল আক্তারকে ওইদিনই মোশাররফের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর আদালতে দেয়া গ্রেফতার ভোলাইয়া, বাবুলের ঘনিষ্ঠ সাইফুল হক, গাজী আল মামুন, মোকলেসুর রহমান ইরাদ এবং আসামি মুসার স্ত্রী পান্না আক্তারের জবানবন্দিতে বাবুলের সম্পৃক্ততার তথ্য আরও জোরালো হয়। তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এসব জবানবন্দির একপর্যায়ে নিজের মামলায় পিবিআইয়ের দাখিল করা চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ওপর নারাজি আবেদন দাখিল করেন বাবুল আক্তার।
২০২১ সালের ৩ নভেম্বর শুনানি শেষে আদালত বাবুল আক্তারের নারাজি আবেদন প্রত্যাখান করেন। একইসঙ্গে পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করে পিবিআইয়ের চূড়ান্ত প্রতিবেদনও প্রত্যাখান করে অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন। ফলে মোশাররফ হোসেনের দায়ের করা মামলাটির পাশাপাশি করা বাবুল আক্তারের মামলাটিও সক্রিয় হয়ে যায়। দুই মামলার সমান্তরাল তদন্তভার এসে পড়ে পিবিআইয়ের ওপর।
ওই বছরের ২৩ ডিসেম্বর বাবুল আক্তারকে তার নিজের মামলায় গ্রেফতার দেখানোর জন্য আদালতে আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি আদালত তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদন মঞ্জুর করে বাবুলকে গ্রেফতার দেখানোর আদেশ দেন।
এরপর ২৫ জানুয়ারি তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতের পর্যবেক্ষণ মেনে মোশাররফের মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। একইসঙ্গে ওই মামলার ডকেট প্রথম মামলার সঙ্গে সংযুক্ত করে তদন্তের জন্য আবেদন করেন। আদালত অনুমতি দিলে শুধুমাত্র বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলাটির তদন্তই চলমান থাকে।
মামলাটির তদন্ত এখন প্রায় শেষপর্যায়ে। গত ২২ আগস্ট অভিযোগপত্রের সাক্ষ্যস্মারকে সম্মতি দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মহানগর পিপি ফখরুদ্দিন চৌধুরী। পিপি’র বক্তব্য অনুযায়ী- অভিযোগপত্রে বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করা হয়েছে, যিনি এই মামলার বাদী। বাকি ছয় আসামি হল- মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, এহতেশামুল হক প্রকাশ হানিফুল হক প্রকাশ ভোলাইয়া, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু এবং শাহজাহান মিয়া।
সারাবাংলা/আরডি/একে