স্ত্রী হত্যায় বাবুলকে প্রধান আসামি করে অভিযোগপত্র
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৬:০২
চট্টগ্রাম ব্যুরো : স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে খুনের জন্য স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। মামলায় বাবুলসহ সাতজনকে আসামি করা হয়েছে। যে বাবুল আক্তার স্ত্রী হত্যার অভিযোগে মামলা দায়ের করেছিলেন, ছয় বছর পর ওই মামলায় তিনি নিজেই প্রধান আসামি হলেন।
মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর) বিকেলে তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক আবু জাফর মোহাম্মদ ওমর ফারুক অভিযোগপত্র নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (প্রসিকিউশন) কামরুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করেন। এসময় পিবিআই পুলিশ সুপার (মেট্রো) কাজী নাইমা হাসানও ছিলেন।
অভিযোগপত্র জমা দিয়ে বের হওয়ার পর জানতে চাইলে সাংবাদিকদের পুলিশ সুপার নাইমা হাসান বলেন, ‘মিতু হত্যা মামলার তদন্ত সম্পন্ন করে আমরা অভিযোগপত্র জমা দিয়েছি। মামলায় বাবুল আক্তারকে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে। আমরা সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব বজায় রেখে মামলাটি তদন্ত করেছি। পিবিআই কখনও পেশাদারিত্বের বাইরে গিয়ে তদন্ত করে না। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা মামলাটির তদন্তভার পেয়েছিলাম। আড়াই বছরের তদন্তে যাদের বিরুদ্ধে সব রকমের তথ্যপ্রমাণ আমরা পেয়েছি তাদের আসামি করা হয়েছে অভিযোগপত্রে।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (প্রসিকিউশন) কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা এখনও কেস ডকেট পুরোপুরি দেখতে পারিনি। এটা অনেক বড় একটা কেস ডকেট। শুধু এটুকু বলতে পারি যে- বাবুল আক্তারসহ সাতজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র আমাদের কাছে জমা হয়েছে। এখন আইন অনুযায়ী আমরা সেটা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঠাব। ম্যাজিস্ট্রেট সেটা পর্যালোচনা করে স্বাক্ষর করবেন, যেহেতু এটা হত্যা মামলা, ম্যাজিস্ট্রেট সেটা সেশন জজ আদালতে পাঠাবেন। এরপর পরবর্তী বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হবে।’
সূত্রমতে, অভিযোগপত্রে আরও যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হলেন- মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, এহতেশামুল হক প্রকাশ হানিফুল হক প্রকাশ ভোলাইয়া, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু এবং শাহজাহান মিয়া।
আসামিদের মধ্যে কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা ও খাইরুল ইসলাম কালুকে পলাতক দেখানো হয়েছে। জামিনে আছেন এহতেশামুল হক ভোলাইয়া। আর কারাগারে আছেন- বাবুল আক্তার, মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, আনোয়ার হোসেন এবং শাহজাহান মিয়া।
মিতু খুনের পর মামলায় গ্রেফতার হওয়া চারজনকে অভিযোগপত্রে অব্যাহতি দিয়েছে পিবিআই। এরা হলেন- কারাগারে থাকা মো. সাইদুল ইসলাম সিকদার সাক্কু, নুরুন্নবী, রাশেদ ও গুইন্যা। সাইদুল ও গুইন্যার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় তাকে অভিযোগপত্রে বাদ দেয়া হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পর গ্রেফতার নুরুন্নবী ও রাশেদ পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান।
আসামিদের মধ্যে ভোলাইয়া, ওয়াসিম ও আনোয়ার আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে মিতু হত্যার দায় স্বীকার করে।
জানা গেছে, পিবিআইয়ের জমা দেওয়া ২০ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রে মোট ৯৭ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। অভিযোগপত্রের সঙ্গে ২১ ধরনের আলামত জমা দেওয়া হয়েছে। দুই হাজার ৮৪ পাতার কেস ডকেটে আসামি ও সাক্ষীদের জবানবন্দিসহ বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ সংযুক্ত করা হয়েছে।
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হত্যাকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি পিবিআই পুলিশ সুপার (মেট্রো) কাজী নাইমা হাসান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘যেহেতু আমরা চার্জশিট জমা দিয়েছি এটা এখন প্রসিকিউশন শাখা এবং আদালতের বিষয়। মামলা ট্রায়ালের পর্যায়ে গেলে বিস্তারিত জানতে পারবেন।
সূত্রমতে, তদন্তে পাওয়া তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত বিদেশি নাগরিক এক নারীর সঙ্গে বাবুলের পরকীয়ার জড়িয়ে পড়া নিয়ে তাদের সংসারে অশান্তি শুরু হয়। এর জেরে বাবুল আক্তার স্ত্রীকে খুনের সিদ্ধান্ত নেন। তিন লাখ টাকায় ‘খুনি’ ভাড়া করে স্ত্রীকে খুন করায়। নিজেকে আড়ালে রাখতে প্রচার করেন- জঙ্গিরাই মিতুকে খুন করেছে। মিতুকে খুনের মিশনে নেতৃত্ব দিয়েছে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুলের ‘সোর্স’ মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা। সঙ্গে ছিল আরও ছয়জন। হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল মুসাকে ফোনে নির্দেশ দেন- গা ঢাকা দেয়ার জন্য।
২০২০ সালে মিতু হত্যা মামলার তদন্তভার যায় পিবিআইয়ের কাছে যাওয়ার পর তদন্ত শুরু করেন পিবিআই পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা। তিনি নগরীর খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে বদলির পর পিবিআই পরিদর্শক একেএম মহিউদ্দিন সেলিম তদন্ত এগিয়ে নেন। সহকারী পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পেয়ে তিনিও বদলি হন পিবিআই থেকে চট্টগ্রাম নগর পুলিশে। সর্বশেষ পিবিআই পরিদর্শক আবু জাফর মোহাম্মদ ওমর ফারুক দায়িত্ব গ্রহণ করে তদন্ত কার্যক্রম শেষ করে অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন। আর তদন্ত তদারকের দায়িত্বে ছিলেন পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পুলিশ সুপার কাজী নাইমা হাসান।
যেভাবে জট খোলে এই হত্যাকাণ্ডের
নিহত মাহমুদা খানম মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন অভিযোগ করেছিলেন, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত বিদেশি নাগরিক গায়ত্রী অমর সিংয়ের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছিলেন বাবুল আক্তার। বিষয়টি প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পর মিতুর সম্পর্কের অবনতি হয়। এর জের ধরে বাবুল আক্তারকে পরিকল্পিতভাবে লোক ভাড়া করে মিতুকে খুন করেছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, তদন্তে মোশাররফের অভিযোগের সত্যতা পায় পিবিআই। মামলার আলামত হিসেবে উপহার পাওয়া বাবুল আক্তারের একটি বই জব্দের পর হত্যাকাণ্ডের জট খোলে। ২০১৩ সালে কক্সবাজার জেলা পুলিশে কর্মরত থাকার সময় বাবুলের সঙ্গে সেখানে একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত গায়ত্রী অমর সিংয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। গায়ত্রী বাবুলকে আহমেদ রশিদ রচিত ইংরেজি ভাষার ‘তালিবান’ নামে একটি বই উপহার দেন। ওই বইয়ের তৃতীয় পাতায় গায়ত্রী অমর সিংয়ের নিজের হাতের লেখায় এবং শেষ পাতা ২৭৬ এর পরের খালি পাতাটিতে বাবুল আক্তারের হাতে লেখা ইংরেজিতে তাদের ‘প্রথম সাক্ষাতের’ বিষয়সহ কিছু তথ্য লেখা আছে।
গত ৭ মার্চ তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে বাবুল আক্তারের হাতের লেখার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। বিশেষজ্ঞের মতামতের ভিত্তিতে পিবিআই নিশ্চিত হয় যে, বইয়ের পাতায় লেখাগুলো বাবুল আক্তারেরই।
অভিযোগপত্র চূড়ান্ত হওয়ার পর এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিবিআই পরিদর্শক আবু জাফর মোহাম্মদ ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেছিলেন, ‘বাবুল আক্তারের বাসার আশপাশের প্রতিবেশি ও ঘনিষ্ঠ লোকজনের দেয়া তথ্য যাচাইবাছাই করে এবং তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করেছি। ডকুমেন্ট এবং ডিজিটাল এভিডেন্সের ভিত্তিতে আমরা তদন্ত সম্পন্ন করে অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করছি।
তবে বিদেশি নাগরিক ওই নারীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সফল হয়নি পিবিআই।
তিন লাখ টাকায় খুনি ভাড়া করেন বাবুল
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ‘তালিবান’ বইয়ের পাতায় পাতায় বাবুল আক্তারের সঙ্গে গায়ত্রীর সম্পর্কের যে তথ্য উল্লেখ আছে, সেটা একদিন দেখে ফেলেন মাহমুদা খানম মিতু। এ নিয়ে বাবুলের কাছে জানতে চান মিতু। শুরু হয় সংসারে অশান্তি, দাম্পত্য কলহ। একই বাসায় আলাদা-আলাদা কক্ষে বসবাস শুরু করেন দু’জন। এর জেরে বাবুল আক্তার সিদ্ধান্ত নেন মিতুকে খুনের। তৎকালীন চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (এডিসি) বাবুল আক্তার তার বিশ্বস্ত সোর্স মুসাকে ‘কিলিং মিশনের’ প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেন। বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুলের মাধ্যমে মুসার কাছে তিন লাখ টাকা পাঠানো হয়। সাইফুল আদালতে জবানবন্দি দিয়ে বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
কিলিং মিশনে ছিল- মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু, শাহজাহান মিয়া, নুরুন্নবী ও রাশেদ। আর বাবুল আক্তারের নির্দেশে মুসাকে অস্ত্রের যোগান দিয়েছিল এহতেশামুল হক প্রকাশ হানিফুল হক প্রকাশ ভোলাইয়া।
২০২১ সালের ২১ অক্টোবর পিবিআই ভোলাইয়াকে গ্রেফতার করেছিল। ২৩ অক্টোবর ভোলাইয়া আদালতে জবানবন্দি দিয়ে জানায়, জায়গা-জমি নিয়ে বিরোধের জেরে কয়েকটি মামলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। সেই মামলায় সহযোগিতা পাইয়ে দেওয়ার জন্য কামরুল ইসলাম শিকদার মুসার মাধ্যমে ২০০৮ সালে তৎকালীন সিএমপির কোতোয়ালী জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার বাবুল আক্তারের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। মুসা ছিলে বাবুল আক্তারের বিশ্বস্ত সোর্স। মামলাগুলো থেকে তাকে অব্যাহতি পাইয়ে দেওয়ায় ভোলা ডবলমুরিং থানা এলাকায় অবৈধ অস্ত্রের সন্ধান দিয়েছিলেন। সেই অস্ত্র উদ্ধার করে বাবুল আক্তার প্রশংসিত হয়েছিলেন, পদকও পেয়েছিলেন।
পরে বাবুল আক্তার বদলি হলেও ২০১১ সালের দিকে আবার নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার হয়ে ফেরত আসেন। জবানবন্দিতে ভোলা জানিয়েছেন, বদলি হয়ে আসার পর বাবুলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ভোলা দেখেন সেখানে মুছা বসে আছেন। বাবুলের অনুরোধে ভোলা তার বালুর ডিপোতে মুছাকে ১৫ হাজার টাকা বেতনে ম্যানেজারের চাকরি দেন। মুসা আবার মনিরকে (পরে মিতু হত্যা মামলায় গ্রেফতার) তার কেয়ারটেকার হিসেবে নিয়োগ দেয়। বাবুল আক্তারের সোর্স হওয়ায় ভোলা মুসাকে সমীহ করে চলত বলে জবানবন্দিতে জানিয়েছে।
‘এর কয়েকবছর পর একদিন মুসা ভোলাকে জানায় যে, বাবুল আক্তারের সঙ্গে তার স্ত্রীর ঝামেলা আছে। বাবুল আক্তার বলেছেন, তাকে যেন মুসা ফিনিশ করে দেয়’- জবানবন্দিতে এমন তথ্য দিয়ে ভোলা আরও জানায়, মিতুকে খুনের কাজে মুসাকে সাহায্য করতে রাজি না হওয়ায় বাবুল আক্তার তাকে জিইসি মোড়ে মেরিডিয়ানের সামনে ডেকে নিয়ে বলেন, মুসাকে তিনি (বাবুল) একটা কাজ দিয়েছেন, ভোলা সাহায্য করতে না পারলেও যেন বাধা না দেয়, বাধা দিলে তার সমস্যা হবে। এতে ভয় পেয়ে যান ভোলা। ওইদিন বাবুল আক্তারের সঙ্গে মুসা এবং ওয়াসিমও ছিল। ভোলার দাবি, কয়েকদিন পর বাবুল আক্তারের দেওয়া টাকায় মুসা অস্ত্র সংগ্রহ করে।
ভোলার তথ্যমতে, এর ৩-৪ দিন পর আসে ২০১৬ সালের ৫ জুন। ওইদিন সকাল ৭টা থেকে সাড়ে ৭টার মধ্যে মুছা ভোলাকে বারবার ফোন দিতে থাকে। তবে ভোলা ফোন ধরেননি। সকাল ১১টার দিকে ব্যবসায়িক কাজে খাতুনগঞ্জের শাহজালাল ব্যাংকে গিয়ে টেলিভিশনে দেখেন, পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতুকে হত্যা করা হয়েছে। তখন ভোলা মুসাকে ফোন করেন, ফোন বন্ধ ছিল। বিকেলে মুসা ভোলার অফিসে গিয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। সে ভোলাকে বলে, তার (মুসা) কোনো উপায় ছিল না। সে যদি মিতু ভাবিকে না মারত, তাহলে বাবুল আক্তার তাকে ক্রসফায়ার দিত। তখন ভোলা বলেন, ‘এ কাজটা না করলে বাবুল স্যার হয়ত একবার ক্রসফায়ার দিত, এখন পুলিশ তো তোকে দশবার মারবে।‘
মুসা ভোলার অফিসে একটি কাপড়ের ব্যাগ রেখে চলে যান। ওইদিনই তার কেয়ারটেকার মনির এসে ব্যাগটি নিয়ে যায়। ভোলার তথ্যে ডিবি পুলিশ মনিরের বাসা থেকে ব্যাগটি উদ্ধার করে। সেখানে একটি অস্ত্র ছিল।
২০১৬ সালের ২৮ জুন পুলিশ ভোলাইয়া ও মনিরের হেফাজত থেকে পয়েন্ট ৩২ বোরের পিস্তলটি উদ্ধার করেছিল।
সূত্রমতে, হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল আক্তার ফোন করে মুসাকে ‘গা ঢাকা’ দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন। এ সংক্রান্ত কলরেকর্ড পিবিআই সংগ্রহ করেছে।
তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক আবু জাফর মোহাম্মদ ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেছিলেন, ‘বাবুল আক্তারই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী এবং নির্দেশদাতা। তিন লাখ টাকার চুক্তিতে লোক ভাড়া করে বাবুল আক্তার এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেন।’
হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই ‘নিখোঁজ’ আছেন কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা। তার স্ত্রী পান্না আক্তারের দাবি, মুসাকে হত্যাকাণ্ডের পর ২০১৬ সালের ২২ জুন ‘প্রশাসনের লোকজন’ তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ মিলছে না। মিতু হত্যা মামলায় মুছার স্ত্রী পান্না আক্তার আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। অভিযোগপত্রে তাকে সাক্ষী করা হয়েছে।
গত ২২ আগস্ট মিতু হত্যা মামলার অভিযোগপত্রের সাক্ষ্যস্মারক রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মহানগর পিপি মো. ফখরুদ্দিন চৌধুরী সম্মতি দিয়ে স্বাক্ষর করেন। এরপর তিনি সারাবাংলাকে জানিয়েছিলেন, মূল অভিযোগপত্র নয় পৃষ্ঠার। তবে এর সঙ্গে দশ খণ্ডের নথি সংযুক্ত করা হয়েছে।
‘খুবই ভালো তদন্ত হয়েছে। একেবারে নির্মোহ, পূর্ণাঙ্গ তদন্ত। তদন্তে বাদ পড়েছে এমন কিছু আমার চোখে পড়েনি। গুরুত্বপূর্ণ এই ফৌজদারি মামলায় বাদীকেই অপরাধের সঙ্গে সংযুক্ত হিসেবে প্রমাণ করার ক্ষেত্রে এবং তার সঙ্গে যুক্তদের অপরাধ অভিযোগপত্রে প্রমাণের ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং তদারক কর্মকর্তা যথেষ্ঠ দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।’- বলেছিলেন পিপি ফখরুদ্দিন চৌধুরী
ঘটনাক্রম
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরীর পাঁচলাইশ থানার ও আর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার অদূরে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। স্ত্রীকে খুনের ঘটনায় পুলিশ সদর দফতরের তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদসহ নানা নাটকীয়তার পর ওই বছরের আগস্টে বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
হত্যাকাণ্ডের পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন প্রথম এই খুনে বাবুলের জড়িত থাকার সন্দেহ প্রকাশ করেন। নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাত ঘুরে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলার তদন্তভার পড়ে পিবিআইয়ের ওপর। এরপর আস্তে আস্তে জট খুলতে থাকে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টিকারী চাঞ্চল্যকর এই মামলার।
২০২১ সালের ১১ মে বাবুল আক্তারকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। পরদিন বাবুল আক্তারের মামলায় আদালতে ৫৭৫ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়, যাতে উল্লেখ করা হয়- তদন্তে ঘটনার সঙ্গে বাদী বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
একইদিন (১২ মে) দুপুরে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বাদি হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় বাবুল আক্তারসহ আটজনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার বাকি সাত আসামি হলেন- মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, এহতেশামুল হক প্রকাশ হানিফুল হক প্রকাশ ভোলাইয়া, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু, মো. সাইদুল ইসলাম সিকদার সাক্কু এবং শাহজাহান মিয়া।
পিবিআই হেফাজতে থাকা বাবুল আক্তারকে ১২ মে মোশাররফের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর আদালতে দেয়া গ্রেফতার ভোলাইয়া, বাবুলের ঘনিষ্ঠ সাইফুল হক, গাজী আল মামুন, মোকলেসুর রহমান ইরাদ এবং আসামি মুসার স্ত্রী পান্না আক্তারের জবানবন্দিতে বাবুলের সম্পৃক্ততার তথ্য আরও জোরালো হয়। তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এসব জবানবন্দির একপর্যায়ে নিজের মামলায় পিবিআইয়ের দাখিল করা চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ওপর নারাজি আবেদন দাখিল করেন বাবুল আক্তার।
২০২১ সালের ৩ নভেম্বর শুনানি শেষে আদালত বাবুল আক্তারের নারাজি আবেদন প্রত্যাখান করেন। একইসঙ্গে পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করে পিবিআইয়ের চূড়ান্ত প্রতিবেদনও প্রত্যাখান করে অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন। ফলে মোশাররফ হোসেনের দায়ের করা মামলাটির পাশাপাশি করা বাবুল আক্তারের মামলাটিও সক্রিয় হয়ে যায়। দুই মামলার সমান্তরাল তদন্তভার এসে পড়ে পিবিআইয়ের ওপর।
ওই বছরের ২৩ ডিসেম্বর বাবুল আক্তারকে তার নিজের মামলায় গ্রেফতার দেখানোর জন্য আদালতে আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি আদালত তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদন মঞ্জুর করে বাবুলকে গ্রেফতার দেখানোর আদেশ দেন।
এরপর ২৫ জানুয়ারি তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতের পর্যবেক্ষণ মেনে মোশাররফের মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। একইসঙ্গে ওই মামলার ডকেট প্রথম মামলার সঙ্গে সংযুক্ত করে তদন্তের জন্য আবেদন করেন। আদালত অনুমতি দিলে শুধুমাত্র বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলাটির তদন্তই চলমান থাকে।
গ্রেফতারের এক বছর চার মাস পর গত ৮ সেপ্টেম্বর ফেনী কারাগারে বন্দী বাবুল আক্তার আইনজীবীর মাধ্যমে তাকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগে ছয় পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলার আবেদন করেন। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা হলেন- পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার, পিবিআই চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার মো. নাজমুল হাসান, মেট্রোর পুলিশ সুপার নাইমা হাসান, পিবিআইয়ের সাবেক পরিদর্শক বর্তমানে খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা ও বর্তমানে সহকারী পুলিশ কমিশনার (পাহাড়তলী জোন) একেএম মহিউদ্দিন সেলিম এবং পিবিআইয়ের জেলা পরিদর্শক কাজী এনায়েত কবির।
১২ সেপ্টেম্বর আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে দাখিল করা আরেকটি আবেদনে বাবুল আক্তার অভিযোগ করেন, গত ১০ সেপ্টেম্বর দুপুরে ফেনী মডেল থানার ওসি নিজাম উদ্দিন জেলকোড অনুসরণ না করে ফেনী কারাগারে প্রবেশ করে বাবুল আক্তারের কক্ষে দীর্ঘ সময় ধরে তল্লাশি চালান। হেফাজতে রেখে নির্যাতনের অভিযোগে বাবুল আক্তার যে ছয় পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেছেন, তাদের নির্দেশে ও প্ররোচনায় এ তল্লাশি চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ করে নিরাপত্তার আবেদন করেন তিনি।
চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ জেবুন্নেছা বেগম উভয় আবেদনের শুনানির জন্য ১৯ সেপ্টেম্বর সময় নির্ধারণ করেছেন।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম