আ. লীগ প্রার্থীর জয় চেয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার মোনাজাত ও বক্তৃতা!
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২০:৪৫
চট্টগ্রাম ব্যুরো : চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী এটিএম পেয়ারুল ইসলামের মনোনয়নপত্র জমা নিয়ে তার বিজয় কামনা করে দলীয় নেতাদের সঙ্গে মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন রিটার্নিং অফিসার ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান। এ সময় তিনি প্রার্থীকে পাশে বসিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্দেশে বক্তৃতাও করেন।
বক্তব্যে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবার যেন আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়, সে জন্য বিএনপি-জামায়াতেরও দোয়া কামনা করেছেন।
বৃহস্পতিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সকালে এটিএম পেয়ারুল ইসলাম শ’খানেক নেতাকর্মী নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেন। এ সময় জেলা পরিষদের বর্তমান প্রশাসক উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ সালাম, দক্ষিণ জেলার সভাপতি সাংসদ মোছলেম উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান এবং নগরের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর নগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য শফর আলী প্রার্থী এটিএম পেয়ারুল ইসলামের বিজয় কামনা করে মোনাজাত পরিচালনা করেন। এতে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে রিটার্নিং অফিসারকেও হাত তুলে অংশ নিতে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ও ছবিতে।
এরপর জেলা প্রশাসক বাম পাশে প্রার্থী এটিএম পেয়ারুল ইসলাম এবং ডানপাশে সংসদ সদস্য মোছলেম উদ্দিন আহমেদকে বসিয়ে বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে এটিএম পেয়ারুল ইসলামের মনোনয়নপত্র গ্রহণ করলাম। আজ যেন একটি সুযোগ পেয়েছি, এখানে আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগরের সকল পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত আছেন, কিছু কথা বলি। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, সেটা নস্যাৎ করতে দেশি-বিদেশি, আন্তর্জাতিকভাবে ষড়যন্ত্র চলছে।’
‘আপনারা জানেন, আড়াই বছরের মতো আমরা করোনায় পার করেছি, লকডাউন গেছে। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে সমস্ত বিশ্বে অর্থনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। ইউরোপ-আমেরিকা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু আমাদের রফতানি তেমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। আমাদের দেশের অর্থনীতিও এখনও সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এরপরও যারা সবসময় ইস্যু খোঁজে, তারা ইস্যু খুঁজবেই।’
এরপর জেলা প্রশাসক আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, ‘আগামী বছর বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আমি মনে করি, বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে এই নির্বাচনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। কারণ এই নির্বাচনে সিদ্ধান্ত হবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের পক্ষের শক্তির হাতে থাকবে নাকি স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তির হাতে যাবে।’
‘আমি মনে করি যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে যদি থাকে, তাহলে আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ বলি, বিএনপি বলি, জামায়াত বলি, সবাই নিরাপদ থাকবে। আমি মনে করি, বিএনপি-জামায়াতেরও এখন দোয়া করা উচিৎ শেখ হাসিনা যেন আবার ক্ষমতায় আসেন।’
আওয়ামী লীগ নেতাদের নিজেদের মধ্যে দূরত্ব কমানোরও তাগিদ দেন জেলা প্রশাসক। তিনি বলেন, ‘নিজেদের মধ্যে ছোটখাট ভুল বোঝাবুঝি যদি থাকে, সেগুলোর ঊর্ধ্বে উঠে যে কোনো মূল্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা যাতে স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির হাতে থাকে, সে জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করা উচিৎ। জাতির স্বার্থে, দেশের স্বার্থে সবাই একসঙ্গে সবাই কাজ করব, বাংলাদেশকে রক্ষা করব।’
সামনের দুর্গাপূজায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্যসহ সকল জনপ্রতিনিধিদের প্রতিমা বিসর্জন না হওয়া পর্যন্ত আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালন করার অনুরোধ করেন জেলা প্রশাসক।
জেলা প্রশাসকের পর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন সংসদ সদস্য মোছলেম উদ্দিন আহমেদ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘একজন রিটার্নিং অফিসার হিসেবে এটি উনি সম্পূর্ণ গর্হিত কাজ করেছেন। এটি শুধু আচরণবিধি লঙ্ঘনই নয়, নির্বাচনী আইনেরও বরখেলাপ করেছেন। ওনাকে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া উচিৎ। চট্টগ্রাম থেকেই অবিলম্বে সরিয়ে দেওয়া উচিৎ। আমি আশা করব, নির্বাচন কমিশন বিষয়টি আমলে নেবে এবং ওনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
বিষয়টি উল্লেখ করে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ সারাবাংলাকে বলেন, ‘রিটার্নিং অফিসার হিসেবে উনার নিরপেক্ষ থাকার কথা। উনি শুধু মনোনয়ন পত্র জমা নেবেন, এতটুকুই। কিন্তু দোয়া-মোনাজাত করা, আবার বক্তব্য রাখা এসব তো আচরণবিধির মধ্যে পড়ে না। এ বিষয়ে যদি কেউ আমাদের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করে অথবা আমরা যদি অফিসিয়ালি বিষয়টি জানতে পারি, তাহলে আমরা সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’
এ বিষয়ে জেলা পরিষদ নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমানের বক্তব্য জানতে পারেনি সারাবাংলা। মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করেও ডিসির সাড়া মেলেনি। তবে জেলা প্রশাসকের বক্তব্য সারাবাংলার কাছে সংরক্ষিত আছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের এটিএম পেয়ারুল ইসলামসহ তিনজন মনোনয়নপত্র জমা দেন। বাকি দু’জন হলেন- চট্টগ্রাম উত্তর জেলা কৃষক লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফয়েজুল ইসলাম এবং নিবন্ধনের প্রক্রিয়ায় থাকা জাতীয় স্বাধীনতা পার্টির মহাসচিব নারায়ণ রক্ষিত।
এছাড়া সাধারণ সদস্য পদে ৬১ জন ও সংরক্ষিত সদস্য পদে ২৬ প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, সদস্য পদে সাধারণ ওয়ার্ড-১ থেকে প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী, মিহির কান্তি নাথ, কালু কুমার দে, ওয়ার্ড-২ থেকে আ ম ম দিলসাদ, শওকতুল আলম, ওয়ার্ড-৩ থেকে নুরুন্নবী ভুট্টো, মুহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান, নাদিম শাহা আলম, মো. রফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন, মো. আলাউদ্দীন, শাহেদ সরোয়ার শামীম, মো. মাহফুজুর রহমান, ওয়ার্ড-৪ থেকে আখতার উদ্দীন মাহমুদ, আমান উল্লাহ খান চৌধুরী, ওয়ার্ড-৫ থেকে মোহাম্মদ আবুল আলম, জাফর আহমেদ, গোলাম মোস্তফা, আবু বক্কর সিদ্দিকী, সেলিম উদ্দীন, এইচ.এম আলী আবরাহা, মোহাম্মদ আলমগীর, মোহাম্মদ এজহার মিয়া, মো. নুরুল আবছার, মনজুর হোসেন চৌধুরী, ওয়ার্ড-৬ কাজী আবদুল ওহাব, ওয়ার্ড-৭ থেকে আবুল কাশেম চিশতী, ওয়ার্ড-৮ মোহাম্মদ এমরান, এস.এম মিজানুর রহমান, মো. আবুল মোকারম, মনসুর আহমদ, বোরহান উদ্দিন এমরান, মোহাম্মদ ইউনুছ, ওয়ার্ড-৯ থেকে ইসলাম আহমদ, রাশেদুল আলম, ওয়ার্ড- ১০ থেকে মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন ও দেবব্রত দাশ, ওয়ার্ড-১১ থেকে শেখ টিপু চৌধুরী, আবু আহমেদ চৌধুরী, ওয়ার্ড-১২ থেকে এস এম আলমগীর চৌধুরী ও মোহাম্মদ আবুল বশর, ওয়ার্ড-১৩ থেকে মোহাম্মদ আবদুল আজিজ, শাহদাত হোসেন চৌধুরী, মো. রায়হাদ চৌধুরী, মো. হামিদ উল্লাহ, কল্যাণ বড়ুয়া, নুর হোছাইন, এম জিল্লুর করিম শরিফী, নুরুল মোস্তফা সিকদার, মোজাম্মেল হক সিকদার, মোহাম্মদ আলমগীর কবির, মো. খালেকুজ্জামান, ওয়ার্ড-১৪ থেকে গোলাম ফেরদৌস, মনির আহমেদ, কামাল উদ্দিন, আব্দুল মালেক খান, আবদুল আলীম এবং ওয়ার্ড- ১৫ থেকে আনোয়ার কামাল, মোহাম্মদ এরফানুল করিম চৌধুরী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
এ ছাড়া সংরক্ষিত ওয়ার্ড-১ থেকে জাহান আরা নাজনীন, ইয়াছমিন আক্তার কাকলী, রওশন আরা বেগম, ইসমত আরা সুলতানা, নার্গিস আকতার, দিলোয়ারা বেগম, সংরক্ষিত ওয়ার্ড-২ থেকে দিলোয়ারা ইউসুফ, উম্মে হাবিবা, জুবাইদা সরওয়ার চৌধুরী নিপা, সংরক্ষিত ওয়ার্ড-৩ থেকে তাহমিনা আক্তার চৌধুরী, তিষণ ভট্টাচার্য্য, জগদা চৌধুরী, শারমিন আকতার, মোস্তফা রাহিলা চৌধুরী, সংরক্ষিত ওয়ার্ড-৪ থেকে দিলোয়ারা বেগম, মোছাম্মৎ দিলুয়ারা বেগম, রেহেনা বেগম ফেরদৌস চৌধুরী, সাজেদা বেগম, সুমি দে, মোছাম্মৎ ফারহানা আফরীন জিনিয়া এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ড-৫ থেকে দিলোয়ারা বেগম, রুখছানা আকতার, শাহিদা আকতার জাহান, শিকু আরা বেগম, তাসলিমা আক্তার, সুরাইয়া খানম মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, আজ (বৃহস্পতিবার) মনোনয়ন পত্র জমার শেষদিন ছিল। ১৭ অক্টোবর জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সারাবাংলা/আরডি/একে