মানসিক স্বাস্থ্যে নজর কম, বাড়ছে শিশু আত্মহনন প্রবণতা
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২৩:৪৫
ঢাকা: রাব্বী হোসেন (ছদ্মনাম)। বয়স সাত বছর। যশোরের বাতেন ইসলামের (ছদ্মনাম) ছেলে। সে স্থানীয় একটি হাফিজিয়া মাদরাসার ছাত্র। অন্যদিনের মতোই ১৯ জুলাই সকালে রাব্বীকে নিয়ে ভাত খেতে বসেছিলেন বাতেন। খাওয়ার এক পর্যায়ে টেবিলে থাকা তিন টুকরো মাংসের দুইটা ছেলের প্লেটে তুলে দিয়ে নিজে এক টুকরো নেন। কিন্তু রাব্বী তা মানছিল না। আর তাই রাগ হয়েছিল। আর এই রাগ থেকেই আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয় শিশু রাব্বী।
কথা হচ্ছিল শিশু রাব্বীর বাবা বাতেন ইসলামের সঙ্গে। সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘ওকে বললাম, ফ্রিজে মাংস আছে- তোমার মা রান্না করে দেবে দুপুরে। সে তাতে রাগ করছিল। আমি খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে টয়লেটে যাই এবং বের হয়ে দেখি ছেলে খাওয়ার টেবিলে নেই। তখন ডেকে সাড়া পাইনি। পরে ঘরের জানালা দিয়ে দেখি মশারির দড়ি গলায় পেঁচিয়ে ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। এ অবস্থা দেখে আমি চিৎকার দিই। চিৎকার শুনে পাশের বাড়ির নূরনবী নামে এক কিশোর এসে ভেন্টিলেটর দিয়ে উঠে ঘরের দরজা খুলে দেয়। কিন্তু ততক্ষণে ছেলে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আর কোনো সাড়া পাইনি।’
এ সময় তার সহধর্মিনী নার্গিস বেগম (ছদ্মনাম) জানান, ‘ছেলে আমার খুব রাগী ছিল। কিন্তু এভাবে কিছু একটা করে বসবে এমনটা কখনো ভাবিনি।’
এই বয়সে বাপ্পী কীভাবে আত্মহত্যার বিষয়ে জানে? বাসায় কি এমন কিছু নিয়ে আলোচনা করা হতো ওর সামনে? জবাবে বাতেন কিছু জানাতে না পারলেও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শিশুদের মাঝে রাব্বীর আত্মহত্যার ঘটনাই প্রথম নয়। এই উপজেলায় একাধিক শিশুর আত্মহত্যার ঘটনা রয়েছে!
২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর যশোরের একই উপজেলায় আত্মহত্যা করে ১২ বছর বয়সী জাকির হোসেন (ছদ্মনাম)। প্রায় কাছাকাছি আরেকটি এলাকায় গত ২ আগস্ট ১৪ বছর বয়সী রাজনীন (ছদ্মনাম) আত্মহত্যা করে। এসব ঘটনা নিয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নূরই আলম সিদ্দিকীর সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার এই প্রতিনিধির।
কেনো একটি উপজেলায় বারবার শিশুদের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে?- এমন প্রশ্নের জবাবে নূরই আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘আমার আগে যিনি ছিলেন থানার দায়িত্বে তখনও এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কেন বার বার হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না। এখন তো বাচ্চারা মোবাইলকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। সবাই সুপার ফার্স্ট। আর তাই খবরও জেনে যায় আগে।’
তবে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একই এলাকায় একাধিক ঘটনা ঘটলেও এ বিষয়ে সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোনো সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি। সবাই স্কুল শিক্ষার্থী হলেও কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা ক্যাম্পেইনও দেখা যায়নি।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ডা. সিফাত ই সাঈদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, ১৮ বছর পর্যন্ত যাদের বয়স তাদের শিশু বলা হয়ে থাকে। এই শিশুদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়লে সেটা সমাজের জন্য অবশ্যই এলার্মিং একটা বিষয়। এর জন্য অনেকগুলো কারণ কাজ করে। তবে একটা অন্যতম কারণ হচ্ছে- এইসব শিশুদের স্ট্রেস হ্যান্ডেলের ক্ষমতা খুবই কম।’
তিনি বলেন, ‘একই ঘটনা যদি কোনো নির্দিষ্ট এলাকা বা উপজেলা বা ইউনিয়ন বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘটে থাকে তবে সেটাকে উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই। শিশুদের আত্মহত্যা প্রতিরোধে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানো প্রয়োজন। এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে অভিভাবকদেরও এগিয়ে আসতে হবে।’
সম্প্রতি দেশে বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকা বিভাগে আত্মহত্যার হার বেশি। তবে শুধু কি ঢাকাতেই? এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ঢাকার বাইরে একাধিক স্থানে শিশুদের মাঝে আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়তে থাকলেও এখন পর্যন্ত মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানোর জন্য কোনো ধরনের ক্যাম্পেইন এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।
চলতি বছরেরই ১৪ মে খুলনা বিভাগে মায়ের সঙ্গে অভিমান করে ১০ বছরের সুলতানা (ছদ্মনাম) নামে এক শিশু। স্কুলের টিফিনে মাংস না দেওয়ার কারণে সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। স্থানীয় একটি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সুলতানা তার মায়ের কাছে স্কুলের টিফিনে গরুর মাংস দেওয়ার আবদার জানান।
মাংস না দেওয়ার কারণেই কী তবে আত্মহত্যা?- এমন প্রশ্নের উত্তরে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগ চিকিৎসক ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘শিশুটির ঘাত সহনশীলতা বা রেজিলিয়েন্সি কম- এমনটা আমরা এক্ষেত্রে বলতে পারি। প্লেটে খাবারের টুকরা বা মাংসের টুকরা পায়নি এটা আসলে তেমন বেশি গুরুত্বপূর্ণ না। শিশুটির যেকোনো বিষয়ে সক্ষমতা ও তার আবেগীয় দক্ষতা অনেক কম ছিল। এটা গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। এটা কেন কম? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে তার প্যারেন্টাল ফরমেশন কেমন ছিল বা তার বাবা-মার ভূমিকা কতটুকু ছিল সেগুলো জানা প্রয়োজন। একইভাবে শিশুটির বেড়ে ওঠার জায়গাটা কতটুকু ছিল- এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘এই স্পেসিফিক শিশুটির ক্ষেত্রে আসলে খাবার বা মাংসের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অন্য একটি বিষয়। অন্য কোনো ক্ষেত্রেও শিশুটি যদি রিজেকশন বা কোনো কিছু না পাওয়ার জন্য অভিমান করে তার নেগেটিভ ইমোশনকে অ্যাবজর্ভ করার ক্ষমতা না থাকে তবে সেটা কিন্তু মার্ক করার মতোই একটা বিষয়। গাড়ির মতো মানুষেরও কিন্তু আবেগের জায়গায় শক অ্যাবজর্ভার থাকে। এই শক অ্যাবজর্ভারের জায়গাটি যখন আমরা যথেষ্ট পরিমাণে গঠন করতে পারি না, তখন মানুষ কিন্তু তার আবেগকে প্রকাশ করতে বা জায়গাগুলোকে সামাল দিতে পারে না। তখন নানা ধরণের জটিলতা হয়। শিশুটির ক্ষেত্রে কিন্তু তাই হয়েছে।’
ডা. হেলাল বলেন, ‘তার এলাকায় এমন ঘটনা ঘটার বিষয়টাও গুরুত্বপূর্ণ। এটাকে আমরা বলে থাকি অবজারভেশনাল লার্নিং, বা দেখে শেখা। এই ধরনের শেখা থেকেও শিশুদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়তে পারে।’ ডা. হেলালের এই বক্তব্যের সঙ্গে অবশ্য মিলে যায় শিশুদের আত্মহননের একাধিক ঘটনার বাস্তবতাও।
সরেজমিনে বিভিন্ন আত্মহননের ঘটনার খোঁজ নিয়ে পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুধুমাত্র মাংস না দেওয়া বা শাসনের কারণে নয়, বরং যখনই শিশুদের মানসিকতার বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত গেছে বলে মনে হয়েছে তাদের, সেখানেই আত্মহননের চেষ্টা করেছে তারা।
২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর বরগুনায় আত্মহত্যা করে ১২ বছরের রাবেয়া (ছদ্মনাম)। তার মা ঝর্না বেগম (ছদ্মনাম) ২০ নভেম্বর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর থেকেই শিশু রাবেয়া মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপরের দুই/তিনদিন প্রায় পুরো সময় একা একা ঘরের মধ্যে বসে থাকত। ২৪ নভেম্বর ঘরে কেউ ছিল না। আর সেটার সুযোগ নিয়ে রাবেয়া ঘরের আড়ায় সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে।’
২০২২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি মোবাইলে ভিডিও গেম খেলতে না দেওয়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একটি উপজেলা এলাকায় মায়ের ওপর অভিমান করে আত্মহত্যা করে রাজীব (ছদ্মনাম) নামে আট বছরের এক শিশু। ২০২২ সালের ২৯ জুলাই লক্ষ্মীপুর জেলায় টিকটক মডেলের মতো আত্মহত্যার অভিনয় করতে না দেওয়ায় পৃথিবী ছেড়ে যায় ৮ বছরের শিশু তমাল হোসেন (ছদ্মনাম)।
তমালের মা সুমি আক্তার (ছদ্মনাম) সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার মোবাইলে টিকটকে একটি মেয়ের আত্মহত্যার অভিনয় দেখে তমাল। সেও ওই মেয়ের মতো টিকটকে আত্মহত্যার অভিনয় করলেও মারা যাবে না বলে জানায় আমাকে। সেজন্য আমার কাছে বারবার মোবাইল চাইছিল। কিন্তু তাকে সেটা আমি দিইনি।’
তিনি বলেন, ‘ছেলেকে মোবাইল না দিয়ে ঘরে তালা মেরে পুকুরে গোসল করতে যাই। গোসল থেকে ফিরে দরজার তালা খুলতেই দেখি সেটা ভেতর থেকে বন্ধ। এলাকার মানুষদের ডাক দিলে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দেখি তমাল ঝুলতেছে। হাসপাতালে নিয়েও আর কোনো লাভ হয় নাই।’
গত ২২ আগস্ট যশোরে বান্ধবীর বিয়েতে যেতে না দেওয়ার কারণে মায়ের ওড়না গলায় পেচিঁয়ে আত্মহত্যা করে ১০ বছর বয়সী তসলিয়া আক্তার (ছদ্মনাম)। ১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর একটি এলাকায় আত্মহত্যা করে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুমি আক্তার ঝর্না (ছদ্মনাম)। ১২ বছর বয়সী এই শিক্ষার্থী কেনো আত্মহত্যা করে জানতে চাইলে তার মা সালমা বেগম (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমি চার দিন ধরে আমার মায়ের বাসায় ছিলাম। আমি জানতে পারি, গত রাতে ওর দাদি জাহানারা বেগম পড়াশোনা নিয়ে বকাঝকা করলে ঝর্না অভিমান করে দাদিকে কোনো উত্তর দেয়নি। পরে দাদি তাকে বলে, তুই মরিস না কেন। আল্লাহ তোর মৃত্যু দেয়নি।’
তিনি বলেন, ‘এরপরেই আমার মেয়ে রাগান্বিত হয়ে বাসায় থাকা কীটনাশক খেয়ে ফেলে। এতে সে অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতাল নিয়ে যাই। পরে অবস্থার অবনতি হলে তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত বলে জানান।’
এ বিষয়ে ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শিশুদের মানসিক বিকাশকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের মন ও মননের বিকাশকে গুরুত্ব দিতে হবে। একজন শিশুর জন্মের পর থেকে তার বেড়ে ওঠা বা বিকাশ, তার প্যারেন্টিং, আবেগীয় বিকাশের ডেভেলপমেন্ট খুবই জরুরি। শিশু দেখে শিখে। ফলে তার চারপাশে ভার্চুয়াল ও একচুয়েল লাইফে সে যা দেখে তাই অনুকরণ করার চেষ্টা করে। ফলে শিশুর বিকাশের ক্ষেত্রে যদি তার ভার্চুয়াল ও একচুয়েল লাইফকে গুরুত্ব দেওয়া না হয় তবে তা ভুল হবে। এক্ষেত্রে কোনো শিশুর সামনে ক্রাইম পেট্রোল, বীভৎস কিছু সিনেমার দৃশ্য দেখানো হয় তবে তার আগে পরিবারকে বুঝতে হবে সন্তানের আবেগের বিকাশ কতটুকু হয়েছে। এক্ষেত্রে পারিবারিক রীতি বা শিক্ষা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এগুলো গুরুত্ব না দিলে শিশুদের আত্মহত্যা প্রবণতা বাড়তেই পারে।’
জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) তথ্য বলছে, বাংলাদেশের ৫-১৭ বছর বয়সী স্কুলগামী শিশু-কিশোরদের মধ্যে ৮ শতাংশই কোনো না কোনো মানসিক ও শারীরিক সমস্যায় ভুগছে। অন্তত ১৪ ধরনের মানসিক ও শারীরিক জটিলতায় ভুগছে বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ।
সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূলত মানসিক স্বাস্থ্যের বিরূপ প্রভাব রয়েছে স্কুলগামী শিশু-কিশোরদের মধ্যে। বিষণ্নতায় ভুগছে ৪ শতাংশ ছেলেমেয়ে। তাদের মধ্যে উদ্বিগ্নতার হার ৩ শতাংশ। ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে আচরণ নিয়ন্ত্রণের অক্ষমতা রয়েছে যথাক্রমে ৩ ও ২ শতাংশ। এছাড়া দৃষ্টি ও শ্রবণ সমস্যা, বন্ধু তৈরিতে অনীহা, যোগাযোগ রক্ষা করতে না পারা, মনোযোগ ভঙ্গ হওয়া, চলাফেরায় সমস্যা, নিজের প্রতি যত্ন নেওয়ার অক্ষমতা, শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের বিষয়ে অভ্যস্ত হতে না পারা, শিখন সমস্যা ও মনে রাখতে না পারার মতো শারীরিক ও মানসিক জটিলতা রয়েছে।
২০২০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় জানানো হয়, বাংলাদেশের ৬৬ শতাংশ শিশু শরীরচর্চার পেছনে দৈনিক এক ঘণ্টা সময়ও ব্যয় করে না। অর্থাৎ প্রতি তিনজনের মধ্যে দুজন শিশু শরীরচর্চার পেছনে সময় ব্যয় করে না। শারীরিক অনুশীলনের অভাবে শিশুর স্বাস্থ্য তো বটেই, মস্তিষ্কের বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে; ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সামাজিক দক্ষতা। একইসঙ্গে অতিরিক্ত মাত্রায় মোবাইল বা অন্যান্য ডিভাইস ব্যবহারের কারণে শিশুরা হারাচ্ছে চিন্তাশক্তি। সেইসঙ্গে নিজের মতের সঙ্গে মিল না হওয়ার কারণে খুব দ্রুতই উত্তেজিত হয়ে আত্মহত্যার মতো ভাবনাও আসছে তাদের মাঝে।
৯ সেপ্টেম্বর বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত এক সমীক্ষার ফলাফলে জানা যায়, দেশে জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাস সময়ে ৩৬৪ জন আত্মহত্যা করেছে। এর মাঝে ৫৩.৩০ শতাংশ অর্থাৎ ১৯৪ জনই ছিলেন স্কুলগামী শিক্ষার্থী। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্টের মধ্যে ১৩ থেকে ২০ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে। যা প্রায় ৭৮.৬ শতাংশ। এর মাঝে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করে ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সীরা, যার সংখ্যা ১৬০ জন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের মনোরোগ চিকিৎসক ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আত্মহত্যা প্রায় সব বয়সসীমাতেই বাড়ছে। তবে শিশুদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ার জন্য দু’টি বিষয় কাজ করছে। প্রথমত, তাদের যে আবেগের বিকাশ সেটি ঠিকমতো না হতে পারা। আঁচল ফাউন্ডেশনের রিপোর্টেও আত্মহত্যার মূল কারণ হিসেবে আবেগীয় সম্পর্কের বিষয়টি উল্লেখ করা আছে। এজন্য শিশুদের আবেগের বিকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শৈশবে, পরিবারে ও স্কুলে এ বিষয়টাতে নজর দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘আরেকটি বিষয় হচ্ছে গত কয়েক বছরে বিশেষ করে করোনাকালে যত ধরণের মানসিক অভিঘাত আমাদের ওপরে এসেছে তাতে পেশাজীবীদের বাইরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষার্থীরা। একদিকে তাদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত হয়েছে, দুইটা বছর তাদের স্কুলিং নষ্ট হয়েছে; অন্যদিকে তাদের পরীক্ষা, ক্যারিয়ারসহ নানা বিষয়ে চাপ বেড়েছে। সেইসঙ্গে যোগ হয়েছে পারিবারিক চাপ। সব বিষয় তাদের ওপর একটা বাড়তি চাপ ফেলছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এক দিকে শিশুদের অন্তর্গত চাপ; যেখানে তাদের আবেগের বিকাশের ব্যাঘাত ঘটেছে, অন্যদিকে করোনাকালে সৃষ্টি হওয়া নানাধরণের চাপ শিশুদের মাঝে বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহননের প্রবণতা বাড়িয়েছে। আত্মহত্যা কখনো একটা কারণে হয় না। অনেকগুলো কারণ যখন একসঙ্গে হয় তখন আত্মহত্যার প্রবণতা সৃষ্টি হয়।’
এম আর খান শিশু হাসপাতালের ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের প্রধান ও শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ফরহাদ মনজুর সারাবাংলাকে বলেন, ‘শিশু-কিশোরদের মানসিক সমস্যা সমাধানে মূল ভূমিকা রাখতে পারে সাইকোলজিস্ট বা সাইকিয়াট্রিকরা। স্কুল বেইজড তারা কাউন্সেলিং করতে পারে। কিন্তু আলাদা আলাদাভাবে চেষ্টা করে খুব একটা বেশি ভালো ফল আসার সম্ভাবনা দেখি না। দেখা গেল, আমি আমার বাচ্চাকে কাউন্সেলিং করলাম। কিন্তু সে যখন আবার স্কুলে যাবে তখন সঙ্গীদের সঙ্গে মিশে আবার পুরনো অবস্থায় ফিরে যাবে। এজন্যেই স্কুলে যদি পরিকল্পনা নিয়ে কাউন্সেলিং করা যায় সেটাতে ভালো ফলাফল পাওয়া যেতে পারে।’
সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম