নির্বাচনি দায়িত্ব হারানো ডিসি’র পাশে ‘১০১ বীর মুক্তিযোদ্ধা’
২০ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২৩:২৩
চট্টগ্রাম ব্যুরো: আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিজয় কামনা করে মোনাজাতে অংশ নিয়ে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়া চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমানের পক্ষে ১০১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম উল্লেখ করে একটি বিবৃতি এসেছে। ‘বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্ট-চট্টগ্রাম’ সংগঠনের ব্যানারে বিবৃতিটি পাঠানো হয়েছে। এতে সই করেছেন গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ও যুদ্ধকালীন শহর গ্রুপ কমান্ডার ডা. মাহফুজুর রহমান।
মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) তৌহিদুল ইসলাম হোয়াটস অ্যাপে বিবৃতিটি সারাবাংলার কাছে পাঠিয়েছেন।
বিবৃতিতে জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অভিযোগ করা হয়েছে। তবে বিবৃতিতে নাম উল্লেখ করা কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা হয়েছে সারাবাংলার। এদের মধ্যে কেউ বলেছেন, বিবৃতিটি একান্তই ডা. মাহফুজুর রহমানের সিদ্ধান্তে দেওয়া হয়েছে, সেখানে কী লেখা হয়েছে সেটা তারা জানেন না। কেউ বলেছেন, বিবৃতিতে নাম উল্লেখের বিষয়টি তাকে জানানো হয়নি। আবার কেউ বলেছেন, রিটার্নিং অফিসার হিসেবে জেলা প্রশাসকের কর্মকাণ্ড ‘অগ্রহণযোগ্য’ হলেও তিনি পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন বলে তারা মনে করেন।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এক মোনাজাতকে কেন্দ্র করে মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের চেষ্টা চলছে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত এবং দুঃখজনক। তরুণ, চৌকস সরকারি কর্মকর্তা মমিনুর রহমান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করেন। তার সাথে সাক্ষাতে মুক্তিযোদ্ধারা তা অনুভব করেন। চট্টগ্রামের জনগণের জন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করেন। প্রতিদিন অসংখ্য লোকের অভিযোগ শোনেন এবং সমাধান দেয়ার চেষ্টা করেন। তিনি সরকারি ভূমি উদ্ধারে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। একটি স্বার্থান্বেষী কুচক্রী মহল এই জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে।
বিবৃতির বিষয়ে জানতে ডা. মাহফুজুর রহমানকে টেলিফোনে বারবার চেষ্টা করেও সাড়া মেলেনি। ফেসবুকের মেসেঞ্জারে কল দেওয়া হলে তিনি বার বার কেটে দেন। মেসেঞ্জারে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো জবাব মেলেনি। হোয়াটস অ্যাপ নম্বরে কল দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। ফলে মাহফুজুর রহমানের বক্তব্য জানতে পারেনি সারাবাংলা।
বিবৃতির বিষয়ে জানতে চাইলে বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম রাজু সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি জেনেশুনেই বিবৃতি দিতে সম্মত হয়েছি। পত্রপত্রিকায় একজন প্রার্থীর জন্য মোনাজাতের বিষয়ে যা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে দ্বি-মত নেই। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এটাকে ইস্যু বানিয়ে অপপ্রচার করা হচ্ছে। সেখানে এমন পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, উনার কিছুই করার ছিল না। উনি মনোনয়ন পত্র গ্রহণ করে সেখান থেকে সরে যেতে পারতেন। কিন্তু সেটা শোভনীয় হতো না। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। জঙ্গল সলিমপুরের খাসজমি উদ্ধারসহ বিভিন্ন বিষয়ে উনি যে দৃঢ় ভূমিকা নিয়েছেন, তাতে এই মুহূর্তে উনার (ডিসি) পাশে থাকা উচিত বলে আমি মনে করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই বক্তব্য একান্তই আমার ব্যক্তিগত। তবে বিবৃতি লিখেছেন মাহফুজুর রহমান সাহেব। উনার চিন্তা কী, সেটা আমি বলতে পারব না। আমি আমার নিজস্ব চিন্তা থেকে বিবৃতিদাতাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি।’
জানতে চাইলে বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রবীণ সাংবাদিক পঙ্কজ দস্তিদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘মোনাজাতের বিষয়টি আমি পত্রিকায় পড়েছি। কিন্তু আসলে ঘটনাটি কী সেটা পুরোপুরিভাবে আমার জানার সুযোগ হয়নি। রিটার্নিং অফিসার হিসেবে ডিসি সাহেবের কাজটি উচিত হয়নি, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু এরপর উনার বিরুদ্ধে যেভাবে বক্তব্য-বিবৃতি আসছে সেটা আমার কাছে অমানবিক মনে হচ্ছে। এজন্য আজ (মঙ্গলবার) সকালে মাহফুজ ভাই যখন ফোন করলেন বিবৃতি দেওয়ার জন্য, আমি রাজি হয়েছি। তবে বিবৃতিতে কী লেখা হয়েছে সেটা তিনি আমাকে পড়ে শোনাননি।’
আরও পড়ুন:
- চট্টগ্রামের ডিসি’কে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি
- চট্টগ্রামে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসার
- আ. লীগ প্রার্থীর জয় চেয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার মোনাজাত ও বক্তৃতা!
জানতে চাইলে বীর মুক্তিযোদ্ধা অরুণ দাশ সাথী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিবৃতি দেওয়ার বিষয়ে আমাকে কেউ কিছু জানায়নি। গবেষণা কেন্দ্র-ট্রাস্টের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়া হলে তো মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। আমার সঙ্গে কারও কোনো যোগাযোগ হয়নি, আমাকে কেউ জিজ্ঞেসও করেনি। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার ডিসিকে একজন ভালো মানুষ মনে হয়েছে।’
এদিকে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমানের পক্ষে মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছে কয়েকটি সংগঠন। এতে সভাপতিত্ব করেন সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কাজী নাঈম এবং যুগ্ম আহবায়ক মিজানুর রহমান।
মানববন্ধনে সেভ দ্যা নেচার অব বাংলাদেশ, হিউম্যান রাইটস বাংলাদেশ, মানবিক ফাউন্ডেশন, স্বাধীনতা ৭১, উই দ্যা ক্র্যাক প্লাটুনস, হিউম্যান রাইটস অব রাঙ্গুনিয়া, সার্ক মানবাধিকার সংগঠন, রেগুলেশন ভয়েজ- এসব সংগঠনের ব্যানার দেখা গেছে। এতে বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা জেলা প্রশাসক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেন।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান জেলা পরিষদ নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করছিলেন। গত ১৫ সেপ্টেম্বর ছিল জেলা পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন পত্র দাখিলের শেষদিন। এদিন সকালে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী এটিএম পেয়ারুল ইসলাম রিটার্নিং অফিসার অর্থাৎ জেলা প্রশাসকের সভাকক্ষে মনোনয়ন পত্র জমা দিতে যান। এ সময় জেলা পরিষদের বর্তমান প্রশাসক উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ সালাম, দক্ষিণ জেলার সভাপতি সাংসদ মোছলেম উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান এবং নগরের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনসহ জ্যেষ্ঠ্য নেতারা তার সঙ্গে ছিলেন।
মনোনয়ন পত্র জমা শেষে নগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য শফর আলী প্রার্থী এটিএম পেয়ারুল ইসলামের বিজয় কামনা করে মোনাজাত ধরেন। এতে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে রিটার্নিং অফিসারকেও হাত তুলে অংশ নেয়। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ও ছবিতে দেখা গেছে।
মোনাজাতের পর আওয়ামী লীগ প্রার্থী এটিএম পেয়ারুল ইসলামকে বাম পাশে এবং সাংসদ মোছলেম উদ্দিন আহমেদকে ডান পাশে বসিয়ে উপস্থিত দলটির নেতাদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন রিটার্নিং অফিসার মোহাম্মদ মমিনুর রহমান। বক্তব্যে তিনি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবার যাতে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়, সেজন্য বিএনপি-জামায়াতের দোয়া কামনা করেন। জেলা প্রশাসকের পর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন সাংসদ মোছলেম উদ্দিন আহমেদ।
মোনাজাত এবং জেলা প্রশাসকের বক্তব্যের ভিডিও এবং ছবির ভিত্তিতে সংবাদ প্রকাশিত হয় সারাবাংলায় এবং পরবর্তী সময়ে আরও বিভিন্ন গণমাধ্যমে। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমানকে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রত্যাহার করে নিতে আইনি নোটিশ পাঠান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান খান।
১৮ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ মমিনুর রহমানকে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসানুজ্জামানকে সেই স্থলে বসিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম