ঢাকা: সোনার মেয়েদের আসার কথা দুপুর একটা থেকে দেড়টায়। দুপুরের আগে থেকেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অপেক্ষায় ফুটবলভক্তরা। আগেই বলা হয়েছে বিমানবন্দর থেকে ছাদখোলা বাসে শহর প্রদক্ষিণ করে মতিঝিল বাফুফে ভবনে নিয়ে আসা হবে সোনাজয়ী বাংলাদেশ দলকে। শুধু বিমানবন্দর ও এর আশপাশের এলাকাই নয়, উৎসুক সাধারণ মানুষ অপেক্ষায় রয়েছে পথজুড়ে- ট্রফিহাতে সোনার মেয়েদের একটুখানি দেখতে, হাত নেড়ে অভিবাদন জানাতে। দুপুর একটা চল্লিশ মিনিটে নারী ফুটবল দলকে বহনকারী বিমান শাহজালালে অবতরণের পর ফুলেল শুভেচ্ছা ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষে জাতীয় এই বীরেরা যখন বহুল প্রতীক্ষিত ছাদখোলা বাসে উঠে রওনা দেয় মতিঝিলের পথে তখন উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে নগরবাসী। সেই উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে নগরীর রাস্তায়, ভবনের ছাদে, টেলিভিশন চ্যানেলের লাইভে আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাতায় পাতায়।
করোনা মহামারি, যুদ্ধের প্রভাবে যুক্ত হওয়া জ্বালানি সংকট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, লোডশেডিংসহ নানাকিছুতে রূদ্ধশ্বাস জাতি যেন এমন একটি উপলক্ষই খুঁজছিল বুকভরে শ্বাস নেওয়ার জন্য, লাল-সবুজের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে আরও একবার জাতীয় পরিচয়ের অহংকারে নিজেকে গর্বিত করার জন্য। আর জাতিকে সেই আরাধ্য জয়ের খুশি এনে দেওয়া মেয়ে ফুটবলারদের বরণ করে নিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য দেখায়নি বাঙালি।
সাফ ফুটবলের এবারের আসরে যখন নেপালের উদ্দেশে পাড়ি জমায় বাংলাদেশ দল তখন আসলে ক্রীড়াসংশ্লিষ্ট মানুষ ছাড়া খুব কম মানুষই এই আসর বা বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল সম্পর্কে জানত বা আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু সাবিনা খাতুনের নেতৃত্বে যখন এই বাংলাদেশ একে একে পাকিস্তান, ভুটান, ভারতকে হারিয়ে ফাইনালে যায় তখনই উত্তেজনার পারদ উঠতে থাকে উপরের দিকে।
পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ নারী দল মালদ্বীপকে ৩-০ গোলে হারিয়ে টুর্নামেন্ট শুরু করে। তারপর পাকিস্তানক ৬-০, ভারতকে ৩-০ ও ভুটানকে ৮-০ গোলে বিধ্বস্ত করে ফাইনালে পৌঁছে। ফাইনাল ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাড়তে থাকে উত্তেজনা। পুরো টুর্নামেন্টে তখন পর্যন্ত প্রতিপক্ষকে ২০ গোল দেওয়ার বদলে একটি গোলও হজম না করা বাংলাদেশ কী ফাইনালেও পারবে এই অদম্য মনোভাব ধরে রাখতে। যত যাই হোক, ফাইনালে প্রতিপক্ষ তো স্বাগতিক নেপাল। স্বাগতিক হওয়ার কারণে প্রতিপক্ষ নেপাল দর্শক ও মাঠের সুবিধাটা পাবে। তবে তা নিয়ে ভাবছেন না বলেই জানান বাংলাদেশ অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। ফাইনালে নিয়ে কোনো বাড়তি চাপ না নিয়ে অপ্রতিরোধ্য আত্মবিশ্বাসের ধারাটা অব্যাহত রাখার বার্তা দেন তিনি।
এই আত্মবিশ্বাসের পুরো প্রতিফলনই দেখা যায় ১৯ সেপ্টেম্বরের নেপালের দশরথ স্টেডিয়ামের ফাইনালে। ২০২২ সালের ষষ্ঠ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে নেপালকে ৩-১ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা জয় করে বাংলাদেশ। আর এই জয়ের মাধ্যমে ২০১৬ সালে ভারতের কাছে সাফের ফাইনালে হেরে রানার্সআপ বাংলাদেশের সেই আক্ষেপ ঘোঁচে ছয় বছর পর। পুরো টুর্নামেন্টে প্রতিপক্ষের জালে পঁচিশ গোল দিলেও ফাইনালে এসে নেপালের কাছে এক গোল খেলেও অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ।
শিরোপা জেতার পর যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ঘোষণা দেন যে মেয়েদের বরণ করে নিতে তৈরি থাকবে ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাস। সেই সম্মাননা এখন পর্যন্ত পায়নি বাংলাদেশের কোনো জাতীয় দল। আজ সাবিনারা আসার আগেই তাই চ্যাম্পিয়ন লেখা জাতীয় দলের খেলোয়াড় ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি সম্বলিত বাস নিয়ে বিমানবন্দরে হাজির হন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কর্মকর্তারা। বিমানবন্দরের ভেতরেই ফুল দিয়ে বরণ করে নেনে বিজয়ী খেলোয়াড়দের। এ সময় কেক কেটে উদযাপন করা হয় বাংলাদেশের এই ঐতিহাসিক বিজয়।
এর আগে বাফুফে এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় যৌথভাবে মারিয়া-মনিকাদের বরণের উদ্যোগ নেয়। এই উপলক্ষে মঙ্গলবার যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে একটি সমন্বয়সভা অনুষ্ঠিত হয়। এর পরই মূলত জানা যায় চ্যাম্পিয়ন বাস রেডি করার কথা। আর সেই সংবাদ পেয়ে আগে থেকেই ফুল হাতে, মিষ্টিমুখ করে আনন্দ উৎসবে যোগ দিতে হাজির হন হাজারো রাজধানীবাসী।
বিমানবন্দর থেকে বনানী, মহাখালী হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে দিয়ে বিজয় সরণি হয়ে তেজগাঁও, কাকরাইল, ফকিরাপুল, আরামবাগ হয়ে বাফুফে কয়েক ঘণ্টায় বাফুফে ভবনে পৌঁছায় ট্রফিজয়ী মেয়েরা। এ সময় রাস্তার দুই প্রান্তে অসংখ্য মানুষ তাদের শুভেচ্ছা জানান। অনেকেই গাড়ি, মোটরসাইকেল সহযোগে যোগ দেন এই বিজয়মিছিলে। বিজয়ী মেয়েগুলোও ফুল ছিটিয়ে, হাত নেড়ে, ট্রফি উঁচিয়ে জবাব দেন সেই বিজয় সম্বর্ধনার। এমনকি জাতির উদ্দেশে শিরোপা উৎসর্গ করে সেই ভালোবাসার প্রতিউত্তর দিতেও ভোলেননি বাংলাদেশের এই সোনার মেয়েরা।
ছবি: হাবিবুর রহমান, সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট