‘লাশ নামিয়ে দিলেও বকশিস দিতে হয় রংপুর মেডিকেলে’
২২ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৯:০৮
রংপুর: রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, বিনামূল্যের ওষুধ না দেওয়া, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের পছন্দমতো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বেশি দামে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বাধ্য করা, পদে পদে আয়া-সেবিকাদের টাকা দেওয়ার এসব অভিযোগ নিত্যদিনের। এমনকি লাশ নামিয়ে দেওয়ার পর স্বজনদের কাছে জোর করে টাকা নেওয়ার ঘটনাও ঘটে এই হাসপাতালে। এসব অভিযোগ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে গেলেও কোন প্রতিকার মেলে না বলে জানান ভুক্তভোগীরা।
রোগীদের অভিযোগ, বকশিশ না পেলে রোগীর স্বজনদের উপর চড়াও হওয়া থেকে শুরু করে মারধরের ঘটনা ঘটে প্রতিনিয়ত। এখানকার কর্মচারী, দালাল এবং বিভিন্ন পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়ানো ‘বকশিস সিন্ডিকেট’ চক্রের সদস্যদের কাছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষসহ সবাই যেন জিম্মি।
তবে গত মঙ্গলবার রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোসার্জারি বিভাগের জুনিয়র কনসালটেন্ট এ বি এম রাশেদুল আমীরের কাছে জোর করে বকশিস চেয়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বকশিশ চাওয়ার এ ঘটনা এবং রোগী হয়রানি বিষয়ে রমেক হাসপাতালের পরিচালক বরাবর গত রোববার একটি লিখিত অভিযোগ দেন ওই চিকিৎসক।
এ ঘটনায় গত মঙ্গলবার দুই পরিছন্নকর্মী মাসুদ ও ঝর্ণা বেগমকে বরখাস্ত করে হাসপাতালের পরিচালক ডা. শরীফুল হাসান।
হাসপাতালে রংপুরের পীরগাছা থেকে চিকিৎসা নিতে আসা এক রোগীর স্বজন জানান, গত রাতে তার মাকে নিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। এরপর জোরপূর্বক ৩০০ টাকা নেয় কয়েকজন ওয়ার্ড বয়। প্রথমে টাকা না দিতে চাইলে তাদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করা হয়। পরবর্তীতে টাকা দিয়েই তার মাকে ওয়ার্ডে ভর্তি করান তিনি।
পঞ্চগড় থেকে চিকিৎসা নিতে আসা পারভেজ বলেন, রোগীরা ট্রলি, স্ট্রেচার ও হুইলচেয়ার ব্যবহার করলে টাকা দিতে হয় আয়া-ওয়ার্ড বয় ও নার্সদের। আর টাকা না দিলে সেগুলো ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না। দিনের পর দিন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নীরব ভূমিকায় এভাবেই চলছে জোরপূর্বক বকশিস আদায়।
তিনি বলেন, “কিছুদিন আগে আমার বাবাকে নিয়ে এসেছিলাম হাসপাতালে। হাসপাতালের নিচে দেখি এক ওয়ার্ডবয় লাশ নিয়ে বেশ তর্কাতর্কি করছেন। গিয়ে দেখি এক নারী তার স্বামীর লাশ নিয়ে যাবেন, কিন্তু ওয়ার্ড বয় ছাড়ছে না। ওয়ার্ড বয়ের দাবি ছিলো, ‘খুশি হয়ে ২০০ টাকা না দিলে লাশ দিবো না।” এই হাসপাতালে লাশ নিতেও বকশিস দিতে হয় বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
ওয়ার্ড বয়, আয়াদের বিষয়ে ভুক্তভোগী চিকিৎসক রাশেদুল আমীরের সঙ্গে যোগাযোগ করে হলে তিনি জানান তার নিজের অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, ‘গত শনিবার মা হৃদরোগে আক্রান্ত হলে হাসপাতালে ভর্তি করানোর জন্য জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন স্বজনেরা। এসময় জরুরি বিভাগে ভর্তির জন্য ২৫০ টাকা দাবি করা হয়। পরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মা পরিচয় জানতে পেরে তারা ভর্তি বাবদ ৫০ টাকা নেন। যদিও হাসপাতালে নির্ধারিত ভর্তি ফি ২৫ টাকা এবং সরকারি কর্মকর্তার মা এবং অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী হিসেবে ভর্তি ফি না নেওয়ার কথা।’
তিনি আরও বলেন, “ভর্তি-পরবর্তী সিসিইউতে মাকে নেওয়া হলে সেখানের জরুরি বিভাগে কর্মরত দুজন জোরপূর্বক আমার ব্যক্তিগত সহকারীর কাছ থেকে ২০০ টাকা বকশিশ নেন। এ সময় তাদের আমার নাম-পরিচয় এবং রোগী সম্পর্কে জানানো হলে তারা বলেন ‘যে স্যারের মা-ই হোক টাকা দিতে হবে’। পরে আমি রাতে আসার পর মায়ের শয্যার পাশে অবস্থানের সময় সিসিইউতে কর্মরত ওয়ার্ডবয় পরিচয়ধারী মাসুদ আমার কাছে সরাসরি টাকা দাবি করে। এ ঘটনা আমার কাছে অত্যন্ত মানসিক পীড়াদায়ক এবং অপমানজনক। যে প্রতিষ্ঠানে আমি সেবা দিয়ে যাচ্ছি, সেখানে আমি হয়রানির শিকার হচ্ছি তা সত্যি দুঃখজনক। আমি নিজে হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা হয়েও যদি হয়রানির শিকার হই, তাহলে সাধারণ মানুষের অবস্থা তো সহজেই অনুমেয়।”
অভিযোগের বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক ডা. শরীফুল হাসান জানান, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত দুই কর্মচারী মাসুদ ও ঝর্ণা বেগমকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া হয়রানির নেপথ্যে আর কেউ জড়িত আছে কিনা তা জানতে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছেন হাসপাতালের পরিচালক।
তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করলে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখি। আমরা প্রায় সময়ই পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে অভিযান পরিচালনা করি। চেষ্টা করছি এসব দালালদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করার।’
সারাবাংলা/এমও