শিক্ষা বোর্ডের সাড়ে ৭ কোটি টাকা লোপাট, এক বছরেও হয়নি চার্জশিট
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৯:০৫
যশোর: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাড়ে সাত কোটি টাকার চেক জালিয়াতির মামলার এক বছর পার হলেও এখনো দেওয়া হয়নি চার্জশিট। ফলে বিচারের আওতায় আসেনি এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কর্তাব্যক্তিরা। এতে শিক্ষাবোর্ড কর্মকর্তাসহ শহরের বিশিষ্টজনদের মাঝে হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তবে দ্রুতই এ মামলার খবর শোনোতে পারবেন বলে জানিয়েছেন দুদকের উপপরিচালক।
এর আগে, ২০২১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর যশোর শিক্ষা বোর্ডে ৯টি চেক জালিয়াতির মাধ্যমে ২ কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ১০ টাকা লোপাটের বিষয়টি উদ্ঘাটন করেন হিসাব শাখার উপপরিচালক মো. এমদাদুল হক ও তৎকালীন অডিট অফিসার মো. আব্দুস সালাম আজাদ এবং জুনিয়র অডিটর শেখ আব্দুর রফিক। বোর্ডর মাত্র ১০ হাজার ৫৩৬ টাকা আয়কর ও ভ্যাট পরিশোধের চেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ওই বিপুল পরিমাণ টাকা লোপাট করা হয়। বিষয়টি উদ্ঘাটন করে তৎকালীন সচিব প্রফেসর এএমএইচ আলী আর রেজার কাছে উত্থাপন করেন তারা। পরবর্তীতে তা সচিবের সহায়তায় আলোর মুখ দেখে এবং যশোরসহ সারাদেশে হইচই পড়ে যায়। ওই সময় এ কাজে সরাসরি জড়িতের প্রমাণ পাওয়া যায় তৎকালীন হিসাব সহকারী (চাকরিচ্যুত) আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে। এরপর মোট ৩৮টি চেকের সন্ধান মেলে, যার মাধ্যমে বোর্ডের সাড়ে সাত কোটির অধিক টাকা লোপাট করা হয়।
পরে ওই বছরের ১০ সেপ্টেম্বর শিক্ষা বোর্ডের পক্ষ থেকে যশোর দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদকে) মামলার জন্যে আবেদন করা হয়। মামলার বাদী ছিলেন তৎকালীন বোর্ড সচিব প্রফেসর এএমএইচ আলী আর রেজা। দুদক ওই দিনই তৎকালীন বোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোল্লা আমীর, সচিব ও বাদী প্রফেসর এএমএইচ আলী আর রেজাসহ পাঁচজনের নামে মামলা দায়ের করে।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন— তৎকালীন হিসাব সহকারী (চাকরিচ্যুত) আব্দুস সালাম, ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের মালিক আশরাফুল ইসলাম বাবু ও মেসার্স শাহীলাল এন্টার প্রাইজের আশরাফুল। প্রথম ধরা পড়া ৯টি চেক ভেনাস ও শাহীলালের নামে ছিল। এ সময় অভিযুক্ত আব্দুস সালাম নিজ অপরাধ স্বীকার করে লিখিত দেন ও পরবর্তীতে একই মাসে দুই দফায় প্রায় ৩১ লাখ টাকা ফেরত দেন।
এদিকে দুদকে মামলা হওয়ার পর আরও ৩ দফায় চেক জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে সর্বশেষ মোট চেকের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৮টি এবং টাকার অংক সাড়ে সাত কোটি পেরিয়ে যায়।
তবে দুদকের তৎকালীন উপপরিচালক ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. নাজমুচ্ছায়াদাত জানিয়েছিলেন, প্রাথমিক মামলায় ৯টি চেক ও পাঁচজন অভিযুক্ত হলেও পরবর্তীতে পাওয়া জালিয়াতির চেক ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি এই মামলার আসামি হিসেবে গণ্য হবে। সাধারণত দুদকের মামলায় ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে হয়, বিশেষ প্রয়োজনে সময় বাড়ানো যায়। তবে এ মামলার বিষয়টি স্পষ্ট তাই খুব দ্রুত তদন্ত শেষ হবে।
মামলার বিষয়ে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘টাকার শেষ গন্তব্য পর্যন্ত যাবে দুদক। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’ এ কথা বলার কয়েকদিন পর মামলা চলমান অবস্থায় এক পর্যায়ে শিক্ষা বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান ও সচিব ওএসডি হয়ে যান। বছরের শেষ দিকে মামলার তদন্তকারী কর্মকতা মো. নাজমুচ্ছায়াদাতকেও বদলি করে সিলেটে পাঠায় দুদক।
এরপর যশোরে দুদকের নতুন উপরিচালক হিসেবে যোগদেন মো. আল আমিন। কর্মস্থলে যোগ দিলেও দীর্ঘদিন এই মামলার আইন বা তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে অফিস আদেশ পাননি তিনি। এ নিয়ে যশোরের সুধি মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন মামলাটির গন্তব্য অনিশ্চিত। ওই সময় রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মহলের কেউ কেউ প্রতিকার চেয়ে মানব বন্ধন ও সমাবেশ করে। কেউ কেউ দুদকের খুলনা অফিসেও এ ব্যাপারে যোগাযোগ শুরু করেন বা মামলার বিষয়ে যশোরের মানুষ নাখোশ এ বিষয়টি উপস্থাপন করেন।
অবশেষে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির দিকে মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পান দুদকের যশোর অফিসের উপপরিচালক মো. আল আমিন। নতুন হওয়ায় বিভিন্ন সময় মামলার কার্যক্রম বা অগ্রগতি বিষয়ে তথ্য চাইলেও মামলার গুরুত্ব ও গোপনীয়তা রক্ষার কথা বলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তথ্য দিতে অপরাগতা প্রকাশ করেন তিনি। তবে গুরুত্বের সঙ্গে যশোর শিক্ষা বোর্ডের মামলাটি বিবেচনা করা হচ্ছে এবং দিনের পর দিন তার টিম এটির কাজ করছে বলে জানান দুদকের এই উপপরিচালক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত সপ্তাতে এ মামলায় উল্লেখযোগ্য যারা সাক্ষাৎকার দেন তাদের মধ্যে অভিযুক্ত ও বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোল্লা আমীর হোসেন, সাবেক সচিব প্রফেসর এএমএইচ আলী আর রেজা, সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর মোহাম্মদ আব্দুল আলীম, সাবেক সচিব প্রফেসর মো. তবিবার রহমান রয়েছেন। জালিয়াতি হওয়া চেকের বেশ কয়েকটিতে শেষ দু’জনের সইও রয়েছে বলে জানা গেছে। এইসব জিজ্ঞাবাদের সময় দুদকের খুলনা অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ছিলেন বলে সূত্রের দাবি।
এদিকে মামলার কার্যক্রম ধীর হয়ে গেলে এবং বোর্ডের সাবেক হিসাব সহকারী আব্দুস সালামের আরও অপরাধ পাওয়ার পর শিক্ষা বোর্ড তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করে। দীর্ঘ শুনানি ও প্রক্রিয়া শেষে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এ ঘটনায় আব্দুস সালামের শাস্তি হলেও মূল অপরাধী ও জড়িত প্রভাবশালীরা দুদকের মামলার অজুহাতে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
ওই সময় শিক্ষা বোর্ডের আরও কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম একাধিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, বোর্ডের বিভাগীয় মামলায় আব্দুস সালাম তার লিখিত জবাবে শিক্ষা বোর্ডের আরও কয়েকজন প্রভাবশালীর নাম উল্লেখ করলেও অজানা কারণে বোর্ড শুধু সালামের চাকরিচ্যুতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। অন্যদের বিরুদ্ধে ন্যূনতম তদন্তও করেনি বোর্ড।
এ ঘটনায় দুদকে মামলা চলছে। তাই মামলা চলমান থাকায় ও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া কারও বিরুদ্ধে আর কিছু করার নেই বলে জানায় বোর্ড কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে যশোর শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মো. আহসান হাবীব জানান, দুদক বর্তমানে খুব তৎপর এবং এর মধ্যেই বোর্ড থেকে কয়েক দফা কাগজপত্র নিয়েছে, অনেকের বক্তব্য নিয়েছে। দ্রুতই তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়বে এবং এ দুর্নীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত সবাই চিহ্নিত ও শাস্তির আওতায় আসবে বলে আশা করেন তিনি।
দুদকের যশোরের উপপরিচালক ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. আল আমিন বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদ প্রায় শেষের দিকে। এ মামলার বেশিরভাগ অভিযুক্ত, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তা ও বোর্ড কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মামলা এক বছর পার হলেও তদন্তের কাজ থেমে নেই। জড়িত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তসহ প্রায় সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। সকল তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। অতি শিগগিরই একটি বড় খবর দেওয়া যাবে।’
সারাবাংলা/এনএস