দল-জোটে ভাঙা-গড়া শুরু, মার্চে সরকার পতন আন্দোলন
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২৩:১২
ঢাকা: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক অঙ্গনে ততই দল ভাঙা-গড়ার খেলা এবং নির্বাচনি জোটের তৎপরতা বাড়তে শুরু করেছে। পাশাপাশি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অবাদ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য রাজপথ কাঁপানো আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেজন্য দলগুলো নিজেদের সংগঠনকে শক্তিশালী করার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। জানা গেছে, আগমী বছর মার্চের প্রথম দিকে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন শুরু করবে বিএনপি, গণতন্ত্র মঞ্চসহ সমমনা বিরোধীদলগুলো। একমঞ্চ থেকে এই কর্মসূচি পালনের কথা রয়েছে।
সরকার পতনের একদফা আন্দোলনের জন্য ইতোমধ্যে সরকারবিরোধী দলগুলো ক্ষেত্র তৈরি কাজ শুরু করছে। এমনকি সবদলের সমন্বয়ে আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়নের কাজ চলছে বলেও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। আর এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ওই সময় জাতীয় ঐক্যের আত্মপ্রকাশ ঘটতে পারে। বিএনপি, গণতন্ত্রমঞ্চ ও অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি বর্তমানে বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে রয়েছে। তবে সাত দলের সমন্বয়ে গঠিত গণতন্ত্র মঞ্চসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এখনও যুগপৎ আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে পারেনি বিএনপি। বিএনপির সঙ্গে বিরোধীদলগুলোর মতানৈক্য এবং একে অপরের প্রতি অবিশ্বাসের কারণে যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি বলে জানা গেছে।
প্রায় ছয় মাস আগে বিএনপির সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ হয়। কিন্তু এর পর আর কোনো বৈঠক হয়নি তাদের। এদিকে, গণতন্ত্রমঞ্চ অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে রাজনৈতিক দলগেুলোর সঙ্গে আন্দোলনসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে সংলাপ শুরু করবে। ওই সংলাপে বিএনপিকে তারা আমন্ত্রণ জানাবে বলে জানা গেছে।
সূত্র বলেছে, সাতদলীয় গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক দলগুলো তাদের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য তৎপর রয়েছে। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচি পালন করবে তারা। ওই কর্মসূচি থেকে তারা বিএনপিসহ বামগণতান্ত্রিক জোটের নেতাদের যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচি পালনের জন্য ফের আহ্বান জানাবে। সেইসঙ্গে রাজধানীর মিরপুর ,উত্তরা, নিউমার্কেট, যাত্রবাড়ী এলাকায় সমাবেশ কর্মসূচি পালন করবে তারা। এছাড়া চারটি বিভাগীয় শহরে প্রতিনিধি সভারও পদক্ষেপ নিয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চ।
গণতন্ত্র মঞ্চের কয়েকজন নেতা জানান, নির্বাচনের দিনক্ষণ যত ঘনিয়ে আসবে সরকারও বিভিন্ন রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। সরকার বিরোধীশক্তিগুলোও ঐক্যবদ্ধ হবে। আগামী বছরের মার্চের শেষের দিকে সরকারবিরোধী শক্তিগুলো নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের দাবিতে জোরেশোরে আন্দালন শুরু করবে। ওই সময় জাতীয় ঐক্যও গঠন হতে পারে। তবে তার আগে রাজনৈতিক দলগুলোতে ভাঙন ও নেতাকর্মীদের দল বদলানো খেলা শুরু হবে।
ইতোমধ্যে জাতীয় পার্টি আরেক দফা ভাঙনের মুখে পড়েছে। দল বা জোট ভাঙার সানাই বিএনপি এবং সাতদলীয় জোটের মধ্যেও শুরু হতে পারে। এ সর্ম্পকে নেতারা বলেছেন, রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন রয়েছে বিএনপি’র একটি গ্রুপ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি। বিষয়টি বিএনপির হাই কমান্ডও জানে। ফলে ওই গ্রুপটির দিকে বিএনপির নীতি নির্ধারকরা কড়া নজর রাখছেন। এছাড়া গণতন্ত্র মঞ্চেও ফাটলের আশঙ্কা রয়েছে। সেজন্য এই মঞ্চের নেতারা একে অপরের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখছে।
এ সম্পর্কে গণতন্ত্র মঞ্চের এক নেতা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘গণধিকার পরিষদের দিকে আমরা বেশি নজর রাখছি।’ বিএনপির বর্তমান কর্মসূচি সর্ম্পকে তিনি বলেন, ‘বিএনপির এই কর্মসূচি জনগণকে সম্পৃক্ত করার জন্য। যদিও তাদের এই কর্মসূচি দিয়ে সরকার পতন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায় সম্ভব হবে না। তারপরও নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখতে এই কর্মসুচি পালন করছে তারা। তবে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এখনই আন্দোলনের সময়। এই সময়ে তারা যুগপৎ আন্দোলন না করে এককভাবে রাজপথে রয়েছে। আমরা আশা করি, আগামী বছরের মার্চে সরকার পতনের এক দফা দাবি শুরু হবে।’
তিনি জানান, বিরোধীদলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে প্রত্যেকটি দলের কাছ থেকে প্রস্তাবনা নিয়েছে বিএনপি। সবকিছু মিলিয়ে তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সংবলিত রাজনৈতিক প্রস্তাবনা পেশ করার কথা রয়েছে। যদিও তারা এখনও তা করতে পারেনি।
এ সব বিষয়ে নিয়ে কথা হয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশারফ হোসেনের সঙ্গে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘একটি কমন ইস্যু নিয়ে সরকারবিরোধী রাজনৈতিকদলগুলো যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করবে। এ ব্যাপারে প্রথম দফা আলোচনা শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় দফা আলোচনা শুরু হবে। এ জন্য কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। অচিরেই সরকারবিরোধী দলগুলোকে নিয়ে এক দফা অর্থাৎ সরকার পতন আন্দোলন শুরু হবে।’
তিনি বলেন, ‘এরশাদের শাসন আমলে এবং ১/১১-তে দলের মহাসচিবকে দিয়ে বিএনপি ভাঙনের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সফল হয়নি। শেখ হাসিনা সরকারের সময় শেষ। এ সময় বিএনপিকে দ্বিধাবিভক্ত করতে পারবে না। বরং বিএনপিতে সংযোজন হবে। আর আওয়ামী লীগের জোট ভাঙবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অতীতেও দেখেছি, সরকারের শেষ সময় রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক ঘটনা ঘটে। সরকার বিভিন্ন শক্তি দিয়ে ঘটনাগুলো ঘটিয়ে থাকে। তবে এবারের বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা।’
রাজনৈতিক অঙ্গনের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে মাহামুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘সরকার লেজে-গোবরে হয়ে গেছে। তারা রাজনীতিতে ভাঙা-গড়ার খেলাসহ নানাধরনের কৌশল নেবে। গণতন্ত্র মঞ্চ লক্ষ্য, উদ্দেশ্য নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে। সরকারের কোনো কৌশলের মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চ যেন না পড়ে- সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রয়েছে সকলের।’
তিনি যুগপৎ আন্দোলন সর্ম্পকে বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে সংলাপের পর আর কোনো আলোচনা আমাদের হয়নি। এখন আন্দোলনের সময়। কিন্তু তাদের কোনো উদ্যোগ নেই। তারা মনে করছে, একাই সবকিছু করবে। গণতন্ত্র মঞ্চ এবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করবে। ওই সংলাপে বিএনপিকে ডাকা হবে।’ অচিরেই ফ্যাসিবাদী সরকার পতনে আন্দোলন শুরু হবে বলে জানান মান্না।
এ প্রসঙ্গে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আমাদের মতের অনেক মতপার্থক্য রয়েছে। তবে বর্তমান ফ্যাসিবাদী সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের দাবিতে আন্দোলনের ক্ষেত্রে মিল রয়েছে।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘সরকারের পদত্যাগ এবং নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের জন্য আন্দোলনের রূপরেখা এখনও তৈরি হয়নি। বিএনপি এ বিষয় নিয়ে দ্বিতীয় দফায় আলোচনায় বসেনি। তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য স্পষ্ট নয়। ফলে তাদের সঙ্গে এই মুহূর্তে যুগপৎ আন্দোলন হচ্ছে না। তারা যে আন্দোলন করছে সেটা আন্দোলন নয়। এটি তাদের প্রোগ্রাম।’ তিনি বলেন, ‘শিগগিরই গণতন্ত্র মঞ্চ আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে সংলাপ শুরু করবে।’
এদিকে, জাসদ রব’র কার্যকরী সাধারণ সম্পাদক শহিদ উদ্দিন স্বপন বলেন, ‘সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে বৃহত্তর আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়নের জন্য বিএনপি সবদলের সঙ্গে সংলাপ করেছে। সবদল বিএনপির কাছে তাদের নিজ নিজ প্রস্তাবনা তুলে ধরেছে। কিন্তু বিএনপি এখন পর্যন্ত আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করে দলগুলোর কাছে উপস্থাপন করতে পারেনিন। ফলে এই মুহূর্তে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন হচ্ছে না। তবে সুষ্ঠু, অবাদ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য শিগগিরই একমঞ্চ থেকে আন্দোলন শুরু হবে।’
সারাবাংলা/এএইচএইচ/পিটিএম