ডুবে থাকে ঝুলন্ত সেতু, ঝুলে আছে প্রকল্প
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৮:৩৮
রাঙামাটি: ‘আমরা চাইছি না আমাদের সরকারিভাবে ঋণ দেওয়া হোক, প্রণোদনা দেওয়া হোক। এ ধরনের কোনো আর্থিক সহায়তার কথাও আমরা বলছি না। শুধু বলেছি স্থানীয় পর্যটনের উন্নয়নে অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রয়োজন আছে, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সৌন্দর্যবর্ধন করা দরকার। মানুষের বিশ্রাম বা বসার স্থান ও শৌচাগারের ব্যবস্থা করা দরকার। বলতে বলতে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের সঙ্গেও ব্যানার টানিয়ে মতবিনিময় সভা করেছি। এরপরও বরফ গলছে না, কারও কোনো উদ্যোগ নেই। এভাবে তো রাঙামাটির পর্যটনের মানোন্নয়ন সম্ভব নয়।’
এভাবেই নিজের ক্ষোভ ঝেড়েছেন রাঙামাটির পর্যটন উদ্যোক্তা সুমেত চাকমা। সুমেতের দীর্ঘদিনের দাবি, স্থানীয় পর্যটনে সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি পড়ুক। কিন্তু বেসরকারি পর্যায়ে এ খাতের উন্নয়নে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ দৃশ্যমান না হওয়ায় হতাশায় সুমেতসহ অন্য উদ্যোক্তারাও। দীর্ঘদিন ধরে আশা বাঁধলেও নিরাশার বহু বসন্তই পার করেছেন তারা।
এটি শুধু উদ্যোক্তা সুমেত চাকমার কথাই নয়, রাঙামাটির পর্যটন সংশ্লিষ্ট সকলের ভাষ্যই এমন। তাদের অভিযোগ, জেলার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলো ব্রিজ, কালভার্ট, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করলেও পর্যটনের উন্নয়নে যুগোপযোগী ভূমিকা রাখছে না। যদিও নিরাশার দিনে আশা দেখাচ্ছে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ। তবে বিগত দিনের পর্যটনখাতের বাজেট বরাদ্দ ও ব্যয়ের চিত্র ভিন্ন। উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানটি গত কয়েকবছর ধরেই জানিয়ে আসছে, রাঙামাটির পর্যটনের উন্নয়ন মেগাপ্রকল্পে আসছে।
আজ থেকে ঠিক ৫ বছরের আগের এদিনে (২৭ সেপ্টেম্বর) পর্যটন দিবসের অনুষ্ঠানে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা জানিয়েছিলেন, পাহাড়ে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আগমনে আকৃষ্ট করতে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার মেগাপ্রকল্প আসছে। যদিও বিগত ৫ বছরেও সেই প্রকল্প আর আসেনি, প্রকল্পটি এখনো দৃশ্যত আলোরমুখ দেখেনি।
সম্প্রতি রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের বর্তমান পর্ষদের চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরীও শোনালেন একইকথা। খাগড়াছড়ি-বান্দরবানের চেয়ে রাঙামাটি পর্যটন অনেক পিছিয়ে আছে মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, রাঙামাটির পর্যটনের উন্নয়ন নিয়ে আমারও মনোক্ষুণ্ণ। ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ফিজিক্যাল স্টাডি ও কনসালটেন্ট ব্যয় নিয়ে অলরেডি ৫০ লাখ ব্যয় হয়েছে বলেও জানান চেয়ারম্যান।
এদিকে, জেলা পরিষদের এবারের ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৮৩ কোটির টাকার বাজেট বরাদ্দে ১ শতাংশ হিসাবে ৬৮ লাখ টাকা পর্যটনখাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে বিগত ২০২১-২২ অর্থবছরের ব্যয়ের হিসাবেও পর্যটনখাত ছিল না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাঙামাটির পর্যটন উদ্যোক্তা ও রাইন্যা টুগুন ইকো রিসোর্টের মালিক ললিত সি. চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, পর্যটনের উন্নয়নে প্রকল্প আসছে এটা ভালো কথা, সুখবর। কিন্তু এটা তো অনেক বছর ধরেই শুনে আসছি। কোনো অগ্রগতিত খবর তো পেলাম না। এভাবে মুখে-মুখে প্রকল্প আসছে আসছে বললে তো হবে না। মানুষ ও খাতসংশ্লিষ্টরা সরকারের আন্তরিক পদক্ষেপ ও দৃশ্যমান উদ্যোগ চান। আর জেলা পরিষদের বাজেটে নিয়ম করে বরাদ্দ রাখলেও এটি খরচ করেন না।
গড়ে উঠছে রেস্টুরেন্ট নির্ভর পর্যটনকেন্দ্র:
সম্প্রতি রাঙামাটির পর্যটনে বেসরকারি উদ্যোগে যেসব পর্যটনকেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়েছে, তার বেশিরভাগই রেস্টুরেন্ট নির্ভরশীল। ২০১৬ সালের পর থেকে রাঙামাটির আসামবস্তি-কাপ্তাই সড়কের বেশকিছু রেস্টুরেন্ট পর্যটনকেন্দ্র কেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম বেরান্নে লেকশোর ক্যাফে, বড়গাঙ, বার্গী লেকভ্যালি, ইজোর অন্যতম। তবে ক্রমান্বয়ে কায়াকিং, কটেজ ও অন্যান্য বিনোদনের ব্যবস্থার উদ্যোগ নিলেও শুরু হয়েছে মূলত রেস্টুরেন্ট দিয়েই।
এ প্রসঙ্গে বার্গী লেকভ্যালির পরিচালক ও পর্যটন সুমেত চাকমা সারাবাংলা ডটনেটকে জানান, ইচ্ছেতো ছিল অনেক বড়, অনেক কিছুই। কিন্তু পুঁজি সংকটে অনেক কিছুই হচ্ছে না। তবে করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও বাহিরের অনেকে যোগাযোগ করলেও আমি আগ্রহ দেখায়নি। তিনি বলেন, আর্থিক সংকটের কারণে বার্গী লেকভ্যালিটা আমরা রেষ্টুরেন্ট দিয়ে যাত্রা শুরু করেছি। ইচ্ছে আছে সুইমিংপুল করার, এখন কায়াকিং এর ব্যবস্থা রয়েছে। আগামী অক্টোবর মাসের শেষ দিকে ৩-৪টা কটেজ চালু করতে পারব আশা করছি।
তবে অবশ্য উন্নয়ন কর্মী নুকু চাকমা বলেছেন, রেস্টুরেন্টে নির্ভরতা হলেও বেসরকারিভাবে এটি দৃশ্যমান উদ্যোগ রাঙামাটির পর্যটনে। পর্যটনে বেসরকারি বিনিয়োগে অনেকটাই প্রচলিত না এখানকার মানুষ। সম্প্রতি বড় গাঙ, বেরান্নে, বারগী, ইজোর, নীলাঞ্জনা বোটক্লাব, ডিভাইন আইল্যান্ড, গাঙ সাবারাং সুন্দর উদ্যোগ। যদিও সরকারি সহায়তা নিয়ে তাদের অনেকেরই অভিমান রয়েছে।
বিনোদনকেন্দ্রে এগিয়ে সরকারি সংস্থা:
তবে গত কয়েকবছরে সরকারিভাবে রাঙামাটিতে বেশকিছু বিনোদনকেন্দ্র সংস্কার ও গড়ে তোলা হয়েছে। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর আরণ্যক, জেলা প্রশাসনের রাঙামাটি পার্ক, জেলা পুলিশের পলওয়েল পার্ক ও কাপ্তাইয়ে বিজিবির জুম রেস্তোরাঁ অন্যতম।
দীর্ঘসময় কোনোভাবে পড়ে থাকা পলওয়েল পার্ক এখন রাঙামাটিতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের ঘুরে বেড়ানোর অন্যতম প্রধানকেন্দ্র। পার্কের মধ্যে রয়েছে শিশুদের খেলাধুলার ব্যবস্থা, বিভিন্ন বসার স্থান, রেস্টুরেন্ট, ঝুলন্ত সেতু, সংগীত কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ ও লাভ পয়েন্ট। এছাড়া জেলা প্রশাসনের রাঙামাটি পার্কটিও শিশুদের জন্য অনেকটা বৈচিত্র্যপূর্ণ।
ডুবে থাকে ঝুলন্ত সেতু:
১৯৮৬ সালে রাঙামাটি শহরের তবলছড়ি বিজিবি সেক্টরের পেছনের এলাকায় দুই পাহাড়ের মাঝখানে তৈরি করা হয় দৃষ্টিনন্দন একটি ঝুলন্ত সেতু। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের উদ্যোগে নির্মিত নজরকাড়া ৩৩৫ ফুট দৈর্ঘ্য সেতুটি দেশে-বিদেশে ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছে। রূপ পেয়েছে ‘সিম্বল অব রাঙামাটি’তে। তবে বিগত ছয়-সাত বছর ধরে প্রায় নিয়ম করেই ডুবছে এটি।
সম্প্রতি রাঙামাটি বেড়াতে আসা অনেক পর্যটকই ঝুলন্ত সেতুটির বর্তমান হাল দেখে হতাশ হয়েছেন। তবে এ বছর বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় কাপ্তাই হ্রদের পানি পর্যাপ্ত না বাড়ায় এবার ডুবেনি সেতুটি। এর আগে প্রতিবছরই প্রায় দুই-তিন বার করে ডুবেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কাপ্তাই হ্রদে ১০৯ এমএসএল (মিন সি লেভেল) পানি ধারণের সক্ষমতা রয়েছে। তবে ১০৩-৪ এমএসএল পানি হলেই ডুবে যায় ঝুলন্ত সেতুটি। নিয়মানুযায়ী ১২০ এমএসএল’র নিচে কোনো স্থাপনা বা অবকাঠামো নির্মাণের বিধান না থাকলেও ‘অপরিকল্পিত’ভাবে নির্মাণের ফলে হ্রদে পানি বাড়লেই সেতুটি ডুবে যায়।
রাঙামাটি পর্যটন করপোরেশনের ব্যবস্থাপক সৃজন বিকাশ বড়ুয়া সারাবাংলাকে জানান, আমি রাঙামাটিতে আসার পর সেতুটির ব্যাপারে বেশ কয়েকবার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছি। বর্ষা মৌসুমে সেতুটি প্রায়শই ডুবে যায়। সাময়িক আমরা যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা দিলেও পানি নামার পর পাটাতন সংস্কার করে আবার চালু করি। তবে আগের সেতুটি এখন আর উপরে তোলার সুযোগ নেই। কিছু করতে হলে নতুন করে উদ্যোগ নিতে হবে। নতুন করে ঝুলন্ত সেতু করার অবস্থাও আমাদের নেই। এটি করতে হলে কোনো উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান বা ট্যুরিজম বোর্ডকে এগিয়ে আসতে হবে।
চাপা ক্ষোভ রাঙামাটি শহরে, সাজেকে স্বস্তি:
রাঙামাটি জেলা আবাসিক হোটেল-মোটেল মালিক সমিতি ও সাজেক কটেজ মালিক সমিতির হিসেবেই রাঙামাটি জেলায় ১৮১ হোটেল-মোটেল, কটেজ রিসোর্ট রয়েছে। তবে স্থানীয়ভাবে রাঙামাটি শহরকেন্দ্রিক আশানুরূপ পর্যটন ও বিনোদনকেন্দ্র গড়ে উঠায় পর্যটন হারাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে রাঙামাটির হোটেল ব্যবসায়ীদের।
জেলা শহরের বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে পরিচিত রিজার্ভবাজারের হোটেল মতিমহলের মালিক মো. শফিউল আজম বলেন, স্থানীয় পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে সংশ্লিষ্টদের যুগোপযোগী উদ্যোগ নেই। এভাবে পড়ে থাকলে দিন-দিন আরও পর্যটক হারাবে রাঙামাটি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাঙামাটি আবাসিক হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সভাপতি মো. মঈনুদ্দিন সেলিম বলেন, যেভাবে আধুনিক হোটেল হচ্ছে তার তুলনায় বর্তমানে পর্যটক অনেক কম।বান্দরবান-খাগড়াছড়িতে পর্যটকের আকৃষ্ট করার জন্য নতুন নতুন পর্যটন স্পষ্ট হলেও রাঙামাটিতে হচ্ছে না। রাঙামাটির পর্যটনখাত নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা না করার কারণে পর্যটন কমছে।
তবে আশার কথা শোনালেন সাজেক কটেজ মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক রাহুল চাকমা জন। তিনি জানান, সাজেকে নতুন করে আরও ২১টি কটেজ-রিসোর্ট সমিতির নিবন্ধনভুক্ত হয়েছে। সবমিলিয়ে সমিতির নিবন্ধনভুক্ত ১২৫টি কটেজ-রিসোর্ট আছে সাজেক ভ্যালিতে। আরও কিছু কটেজ নিবন্ধনের আওতায় আছে, নিবন্ধিত হলে সেগুলোও চালু করা হবে। মূলত সারাবছর ধরে সাজেকে পর্যটন আসায় নতুন নতুন কটেজ-রিসোর্ট গড়ে উঠছে। সাজেক উপত্যকায় মেঘ-পাহাড়ের মিতালি দেখতে দেশ-বিদেশের মানুষ ছুঁটে আসছেন। তবে সাজেকে বছরে সংখ্যায় কত পর্যটন আসেন সেই তথ্য জানাতে পারেননি জন।
সারাবাংলা/এনএস