১৪ বছরে সিজারের হার বেড়েছে ২৮ শতাংশ
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৯:২৬
ঢাকা: প্রয়োজন নেই, তবুও অপারেশন বা সিজারের মাধ্যমে বাচ্চা হওয়ার হার বাড়ছে বাংলাদেশে। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে এই হার বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দিকনির্দেশনা হচ্ছে, একটি দেশে সিজার হতে পারে ১৫ শতাংশ। কিন্তু ২০১৭-১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে এই হার ছিল ৩২ দশমিক ২২ শতাংশ। যেটি ২০০৩-২০০৪ সালের দিকে ছিল ৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ। অর্থ্যাৎ, ১৪ বছরে দেশে সিজারে বাচ্চা নেওয়ার হার বেড়েছে ২৮ দশমিক ২৩ শতাংশ।
এছাড়া গ্রামাঞ্চলে ওই সময়ে সিজারে বাচ্চা নেওয়ার হার ছিল ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ, যেটি ২০১৭-১৮ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২৯ দশমিক ১৮ শতাংশে। এদিকে, শহরে আগে থেকেই এই হার বেশি ছিল। ওই সময় শহরে সিজার হতো ১১ দশমিক ৭২ শতাংশ। এখন হয় ৪৪ দশমিক ২৪ শতাংশ।
বুধবার (২৮ সেপ্টেম্বর) রাজধানী ঢাকার আগারগাঁওয়ের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত ‘ম্যাসিভ বোম অব সি-সেকশন ডেলিভারি ইন বাংলাদেশ: এ হাউজহোল্ড লেভেল এনালাইসিস ২০০৪-২০১৮’ শীর্ষক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বিআইডিএস’র মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেনের সভাপতিত্বে জরিপ প্রতিবেদন তুলে ধরেন সংস্থাটির পপুলেশন স্টাডিজ বিভাগের গবেষক ড. আব্দুর রাজ্জাক সরকার।
বাংলাদেশের জরিপ দেখাতে গিয়ে প্রতিবেদনে প্রতিবেশি অন্যান্য দেশের সিজার হারও তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, একই সময়ে ভারতে ২২ শতাংশ, পাকিস্তানে ২২ শতাংশ, নেপালে ১৬ ও মিয়ানমারে তা ১৭ শতাংশ সন্তান প্রসব সিজারের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে-বিডিএইচএস ২০০৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে অপারেশন করা নারীদের থেকে তথ্য নিয়েছে। তারা ২৭ হাজার ৩২৮ হাজার নারীর মধ্যে এ জরিপ চালায়। তাদের বয়স ১৫ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিতে বেসরকারি হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় সিলেটে আর সবচেয়ে কম বরিশালে। সিলেটে ব্যয় হয় ৩০ হাজার ৫৫৭ টাকা ও রাজশাহীতে ব্যয় হয় ১৫ হাজার ৭০৫ টাকা। আবার সরকারি হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় সিলেটে ১৭ হাজার ৮৩৭ টাকা। আর সবচেয় কম হয় রংপুরে ৭ হাজার ৩১ টাকা। নন-গভার্নমেন্ট অর্গানাইজেশনে (এনজিও) সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় সিলেটে ২১ হাজার ৪৭৬ টাকা এবং রংপুরে ১২ হাজার ৮১ টাকা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশের আটটি বিভাগের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ঢাকায় ১৩ হাজার ৩৮৩ টাকা, চট্টগ্রামে ১৫ হাজার ৮৩১, বরিশালে ১৬ হাজার ৮৪৬, খুলনায় ১১ হাজার ৮৯৩, রাজশাহীতে ১০ হাজার ৯৪১, সিলেটে ১৭ হাজার ৮৩৭, রংপুরে ৭ হাজার ৩১ ও ময়মনসিংহে ১১ হাজার ৫১৬ টাকা ব্যয় হয়। বেসরকারি হাসপাতালে ঢাকায় ২৩ হাজার ১৬৮, চট্টগ্রামে ২৫ হাজার ৫০৭, বরিশালে ২৮ হাজার ৯৫৯, খুলনায় ১৫ হাজার ৭২৯, রাজশাহীতে ১৫ হাজার ৭০৫, সিলেটে ৩০ হাজার ৫৫৭, রংপুরে ১৮ হাজার ২৩০ ও ময়মনসিংহে ১৯ হাজার ৯৭৩ টাকা।
এনজিও’র হাসপাতালগুলোতে ঢাকায় ২০ হাজার ৪৯৮, চট্টগ্রামে ১৫ হাজার ২৬৯, বরিশালে ১৫ হাজার ৮২৩, খুলনায় ১৪ হাজার ৭১০, রাজশাহীতে ১০ হাজার ৩৪৬, সিলেটে ২১ হাজার ৪৭৬, রংপুরে ১২ হাজার ৮১, ময়মনসিংহে ১৫ হাজার ৬১ টাকা।
সেভ দ্য চিলড্রেনের তথ্য তুলে ধরে ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘২০১৮ সালে এক বছরে বাংলাদেশে অপ্রয়োজনীয় সিজার হয়েছে ৮ লাখ ৬০ হাজার। বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালে রোগীদের নিজেদের পকেট থেকে খরচ হয় ৬৫ শতাংশ অর্থ। বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে শতভাগই তাদের পকেট থেকে যায়। বাংলাদেশে সরকারি ডাক্তাররাই বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করছেন, অপারেশন করছেন। ডেলিভারিতে ধনী-গরিব সকলের সমান অর্থ ব্যয় হয়। কেননা প্রত্যেকেই নিজের সবকিছু বিক্রি করে হলেও সন্তানকে ভালো রাখতে চায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘গ্রামে সিজারের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তার মূল কারণ হচ্ছে, বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো গ্রামের দিকে মোড় নিচ্ছে। এক শ্রেণির দালাল এক্ষেত্রে প্রভাবিত করে। চিকিৎসকরাও বুঝে হোক বা না বুঝে হোক বা যেকোনো কারণে হোক মানুষদের সিজারে উৎসাহিত করছে।’
ড. বিনায়ক সেন বলেন, ‘বাড়িতে ডেলিভারি এখন আর হয় না। আমরা প্রাতিষ্ঠানিক হচ্ছি। কিন্তু কোথায় যাওয়া হচ্ছে। দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিকভাবে মানুষ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি শারিরিকভাবও নানা ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। সিজারের কারণে মায়েদের কর্মকক্ষমতা কমে যাচ্ছে। গবেষণা করে দেখতে হবে, কেন অপ্রয়োজনীয় সিজার বাড়ছে।’
পরকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য (সচিব) ড. আব্দুস সাত্তার মন্ডল বলেন, ‘আগে দেখা যেত গ্রামের মানুষ শহরে যেত মামলা-মোকদ্দমার কারণে। এখন সেই জায়গা দখল করে নিচ্ছে সিজার। যেভাবেই হোক মানুষ টাকা সংগ্রহ করে সিজার করাচ্ছেন। এর মাধ্যমে মানুষের প্রচুর অর্থ ব্যয় হচ্ছে। শারীরিক জটিলতায় পড়ছে মায়েরা।’
সেমিনারে বক্তারা বলেন, বর্তমানের ডাক্তাররা স্বাভাবিক ডেলিভারি করাতে চান না। স্বাভাবিক ডেলিভারিতে সময় লাগে বেশি। সেজন্য তারা দ্রুত সিজার করে। সময়ও বাঁচে আবার টাকাও বেশি আয় হয়। তবে সিজারের পর মায়েদের সার্বিক অবস্থা জানা যাচ্ছে না। অপারেশনের পর মা ও সন্তানের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়ছে তা চিহ্নিতও করা যাচ্ছে না।
বক্তরা আরও বলেন, আমাদের দেশে ধাত্রী প্রথা ছিল। সেটি হারিয়ে গেছে। অথচ সন্তান জন্ম নেওয়ার আগের লক্ষণগুলো এসব ধাত্রী ভালোভাবে ধরতে পারতেন। আবার অনেক সময় দেখা যায় ডাক্তারকে অগ্রিম টাকা দিতে হয়। না হলে তারা আসতে চান না। কিন্তু কোনো ধাত্রীর ক্ষেত্রে এমন অবস্থা তৈরি হয়নি যে, অর্থ না দিলে মাঝরাতে তিনি আসবেন না।
সারাবাংলা/জেজে/পিটিএম