কাগজে-কলমে শিক্ষার্থী ২৫২ জন, গড় উপস্থিতি ১২
৭ অক্টোবর ২০২২ ০৮:৪০
ঠাকুরগাঁও: প্রথম দেখাতেই মনে হবে যেন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াচ্ছেন শিক্ষক। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো প্রাইভেট নয়, ক্লাস নিচ্ছেন দাখিল মাদরাসার এক শিক্ষক। ক্লাসে একজন মাত্র শিক্ষার্থী। জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার কাদিহাট বেগুনবাড়ি দাখিল মাদরাসায় এ চিত্র দেখা যায়। কাগজে-কলমে মোট ২৫২ জন শিক্ষার্থী থাকলেও গত উপস্থিতি ১২ জন। কমিটির দ্বন্দ্ব আর শিক্ষকদের বিরোধে ধ্বংসের পথে বসেছে প্রতিষ্ঠাটি। এজন্য মাদরাসা সুপার সিরাজুল ইসলামকেই দায়ী করছেন সহকারী শিক্ষক ও অভিভাবকরা।
বকেয়া বিলের কারণে ৩ বছর আগে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও আজ পর্যন্ত সংযোগ স্থাপন করা হয়নি প্রতিষ্ঠানটিতে। জরাজীর্ণ, স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার অফিস কক্ষে দিনের বেলায় মশা তাড়াতে জ্বালাতে হয় কয়েল।
মাদরাসা সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৫ সালে ফোরকানিয়া মাদাসা নামে যাত্রা শুরু করে। পরে ইফতেদায়ী, এরপর কাদিহাট বেগুনবাড়ি দাখিল মাদরাসা নামকরণ করা হয়। ২০০২ সালের মে মাসে এমপিওভুক্ত হয় প্রতিষ্ঠানটি। প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত কাগজ কলমে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫২ জন। তার বিপরীতে শিক্ষক-কর্মচারী আছেন ১৮ জন। প্রতিমাসে শিক্ষক-কর্মচারীদের পিছনে সরকারের ব্যয় হয় সাড়ে ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা।
সরেজমিনে মাদাসায় গিয়ে দেখা যায়, ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতির হার গড়ে ১২-১৫ জন। এর মধ্যে ৩য় শ্রেণি ও ৫ম শ্রেণিতে কোনো শিক্ষার্থী উপস্থিতি নেই। ১ম শ্রেণিতে ১ জন, ২য় শ্রেণিতে ১ জন, ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ২ জন, ৭ম শ্রেণিতে ১ জন, ৮ম শ্রেণিতে ৭ জন ও ১০ শ্রেণিতে ৫ জন। একটি জরাজীর্ণ টিনসেট বিল্ডিং। নেই কোনো সাইনবোর্ড। দিনের বেলায় অন্ধকার ও স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে নেই শিক্ষাদানের পরিবেশ। এমনকি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের বসার ব্যবস্থাও নেই ভালো।
জানা গেছে, শিক্ষক-কর্মচারীসহ ১৮ জন নির্ধারিত স্কেলে বেতন-ভাতা নিলেও শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিসহ পাঠদানে নেই কোনো ভূমিকা। নেই কোনো জবাবদিহিতা। প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু জমি থাকলেও সেগুলো বন্ধক দেওয়া হয়েছে। আবার কেউ বলছেন- কিছু সম্পত্তি বিক্রি করা হয়েছে। এসবের জন্য দায়ী করা হচ্ছে মাদরাসার সুপার সিরাজুল ইসলামকে। চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি থেকে ১৭ মে পর্যন্ত টানা ৬ মাস প্রতিষ্ঠানে না এসে বেতন-ভাতা নিয়েছেন তিনি। মাদরাসাকে কেন্দ্র করে তার বিরুদ্ধে আদালতে একাধিক মামলা চলমান। তিনি নিজেও বাদী হয়ে বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
অপরদিকে চলতি বছরের ২২ সেপ্টেম্বর মাদরাসা সুপারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, জালিয়াতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তুলে দুইজন অভিভাবক রাণীশংকৈল উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবরে অভিযোগ দায়ের করেন, যা তদন্তনাধীন রয়েছে। মাদরাসাটিতে একের পর এক শিক্ষানীতি পরিপন্থী কার্যক্রম চালিয়ে আসলেও কর্তৃপক্ষ দেখেও না দেখার ভান করে থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, মাদরাসা ব্যবস্থাপনা কমিটির বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে। ব্যক্তিগত স্বার্থে গোপনে কমিটি গঠন করেছেন মাদরাসার সুপার। বিষয়টি জানাজানি হলে একজন অভিভাবক রানীশংকৈল উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বরাবরে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তের দায়িত্বভার পান উপজেলা শিক্ষা অফিসার (প্রাথমিক) মো. রাহিম উদ্দীন। তিনিও বিষয়টি তদন্ত করে মনগড়া প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। যাতে অভিভাবরা সন্তুষ্ট হতে না পেরে দিনাজপুর মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বরাবরে অভিযোগ দায়ের করেছেন, যা তদন্তনাধীন রয়েছে।
দ্বন্দ্ব রয়েছে শিক্ষকদের মধ্যেও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, ‘মাদরাসায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে প্রতিনিয়ত হাতাহাতির মতো ঘটনা ঘটছে। আর এই ঘটনার জন্য সব কিছুর মূলে সুপারের অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা। একইসঙ্গে যুক্ত আছেন নিয়োগ বাণিজ্য।’
মাদরাসা ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সভাপতি আইনুল হক বলেন, ‘একটি মহল নিজের স্বার্থের জন্য সুপারসহ এটাকে ভিন্ন ধারায় নিয়ে যাচ্ছে। সামনে নিয়োগ আছে, সেই নিয়োগ বাণিজ্যের জন্য এসব করছে। সম্প্রতি ইউএনও এসে ১ম থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রী পেয়েছেন মাত্র ১২ জন।’
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা কমিটির বর্তমান সভাপতির সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে এসব অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে কাদিহাট বেগুনবাড়ি দাখিল মাদরাসার সুপার সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘দ্রুত সকলের সঙ্গে সমন্বয় করে বিষয়গুলো সমাধানের চেষ্টা করা হবে।’
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. তৈয়ব আলী বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নিয়ে মতবিনিময় করেছি। মাদরাসার সুপার সিরাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়গুলো জেনেছি। বিষয়গুলো সমাধানের জন্য ওনাকে সময় দেওয়া হয়েছে। যদি ব্যর্থ হয় তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
এ বিষয়ে রাণীশংকৈল উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সোহেল সুলতান জুলকার নাইন কবির বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমি অবগত। তদন্ত চলছে, তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
সারাবাংলা/এনএস