আটলান্টিকে যে কারণে বিশ্বের বৃহত্তম রণতরী মোতায়েন করেছে আমেরিকা
৯ অক্টোবর ২০২২ ২২:১৩
আটলান্টিক মহাসাগরে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত এবং বৃহত্তম রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। উত্তর আটলান্টিকে একটি ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপের নেতৃত্ব দেবে এই রণতরী। স্ট্রাইক গ্রুপে আরও রয়েছে ন্যাটোর ছয়টি যুদ্ধজাহাজ। এছাড়াও রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি রণতরী এবং একটি সাবমেরিন।
কৌশলগত উত্তর আটলান্টিকের জলসীমায় ন্যাটোর ক্রমবর্ধমান সামরিক উপস্থিতির মধ্যে ওয়াশিংটন তার নৌবহরের সবচেয়ে আধুনিক রণতরীটি মোতায়েন করেছে। ওয়াশিংটনের এই সিদ্ধান্ত মস্কোর প্রতি একটি সুস্পষ্ট বার্তা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট ইউক্রেনকে জোর সমর্থন দিচ্ছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য কিয়েভে অস্ত্রশস্ত্র এবং গোয়েন্দা সহযোগিতা পাঠাচ্ছে পশ্চিমা শক্তি। পশ্চিমের সমর্থন কাজে লাগিয়ে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল পাল্টা আক্রমণ চালাচ্ছে ইউক্রেনীয় সেনারা। এর ফলও পাচ্ছে তারা। সম্প্রতি বেশ কিছু দখলকৃত অঞ্চল ছেড়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে রুশ বাহিনী। উত্তর আটলান্টিকে ন্যাটোর স্ট্রাইক গ্রুপে রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড পাঠানোর সিদ্ধান্তটি হচ্ছে মস্কোর বিরুদ্ধে ইউক্রেন এবং অন্যান্য পশ্চিমপন্থী পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির সমর্থনে ন্যাটোর আরেকটি পদক্ষেপ।
প্রতিটি বিমানবাহী রণতরী মূলত এক একটি ভ্রাম্যমান বিমান ঘাঁটি। যেকোনো সামরিক বাহিনীর জন্য সবচেয়ে শক্তির জায়গা হলো তার কৌশলগত বিমান ঘাঁটিগুলোর অবস্থান। এ জন্য ভ্রাম্যমান বিমান ঘাঁটি অর্থাৎ বিমানবাহী রণতরী যেকোনো সামরিক বাহিনীর জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র।
লন্ডনের কিংস কলেজের প্রভাষক এবং প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক আন্দ্রেয়াস ক্রেইগ এ ব্যাপারে বলেন, ‘ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড নিঃসন্দেহে বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক এবং বৃহত্তম বিমানবাহী রণতরী।’
তুরস্কের বার্তাসংস্থা টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে তিনি বলেন, ‘এই রণতরীটি মোতায়েনের মাধ্যমে আসলে রুশদের কাছে একটি স্পষ্ট বার্তা পাঠিয়েছে আমেরিকা। বার্তাটি হলো, উত্তর আটলান্টিক এবং বৃহত্তম আটলান্টিক অঞ্চলের নিরাপত্তা বিধানে আমেরিকা সচেতন।’
ক্রেইগ বলেন, ‘ইউক্রেনে রাশিয়া কোণঠাসা হওয়ার ফলে একটি ভয় তৈরি হয়েছে, সেটি হলো তারা হয়ত অন্য কোনো অঞ্চলে যুদ্ধ শুরুর চেষ্টা করতে পারে। মস্কো থেকে উদ্ভূত সম্ভাব্য হুমকি মোকাবেলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সবচেয়ে শক্তিশালী বিমানবাহী জাহাজটিকে রুশ সীমান্তের কাছাকাছি পাঠানোর মতো সতর্ক পদক্ষেপ নিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কোনো অঞ্চলে বিমানবাহী রণতরী মোতায়েন কখনই কাকতালীয় বিষয় হয় না। এমন পদক্ষেপ উত্তেজনার সময় প্রতিপক্ষকে সরাসরি বার্তা পাঠানোর মাধ্যম। রাশিয়া ও পশ্চিমের উত্তেজনার এই সময়ে মস্কোকে সতর্ক করার জন্য বিমানবাহী রণতরীটি মোতায়েন করা হয়েছে।’
কৃষ্ণ সাগরে কিছু সংঘর্ষ বাদে ইউক্রেন যুদ্ধ এখন পর্যন্ত স্থলভাগে সীমিত। ক্রিয়েগের মতে, বাল্টিক সাগরে সাম্প্রতিক নর্ড স্ট্রিম বিস্ফোরণের ঘটনাটি বুঝিয়েছে, সংঘর্ষ যেকোনো সময় জলভাগেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। উল্লেখ্য যে, গত সপ্তাহে নর্ড স্ট্রিম-১ পাইপলাইনে বিস্ফোরণের জন্য রুশ এবং পশ্চিমারা একে অপরকে দায়ী করেছে।
ক্রেইগ বলেন, ‘সুতরাং মার্কিনি এবং পশ্চিমা জোটের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, আরও ব্যাপকভাবে একটি বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করা। আমেরিকানরা রণতরীটি মোতায়েনের মাধ্যমে এই চেষ্টা করছে।’
ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ডের মতো উন্নত বিমানবাহী রণতরী যেকোনো হামলার প্রতিক্রিয়া খুব দ্রুত দেখাতে সক্ষম। এই রণতরী প্রতিপক্ষের শক্তির জায়গায় গভীর আঘাত হানার জন্য তৈরি। মার্কিন এই রণতরীতে অন্তত দুই ডজন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার হয়েছে যা অন্য কোনো রণতরীতে নেই। এছাড়া এর ফ্লাইট ডেক নতুন নকশায় তৈরি, যার ফলে অন্যান্য আমেরিকান বিমানবাহী রণতরীর চেয়ে অন্তত ৩০ শতাংশ বেশি ফ্লাইট উঠানামা করতে পারে।
মার্কিন নৌবহরে নতুন একটি শ্রেনির রণতরী এই ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড। এই শ্রেনির একটাই রণতরী আছে মার্কিন নৌবহরে। ২০১৭ সালে এটি নৌবাহনীতে কমিশন করা হয়। এই শ্রেনির আরও পাঁচটি রণতরী নির্মাণের কাজ চলছে। প্রায় ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই বিমানবাহী রণতরী আমেরিকার ৩৮তম প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের নামে তৈরি।
এক লক্ষ টন ওজনের রণতরীটির দৈর্ঘ্য ৩৩৭ মিটার এবং ফ্লাইট ডেকের প্রস্থ ৭৮ মিটার। এতে ৭৫টিরও বেশি যুদ্ধবিমান এবং হেলিকপ্টার রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে দুটি রানওয়ে।
এই রণতরীতে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক এয়ারক্রাফট লঞ্চ সিস্টেম (ইএমএএলএস) রয়েছে, ফলে বাষ্প-চালিত ক্যাটাপল্টের পরিবর্তে জাহাজ থেকে ক্যাটাপল্ট পরিচালনা করা সম্ভব হয়। রণতরীটি পরমাণু শক্তিচালিত। আধুনিক ডিজাইনের কারণে এই রণতরী পরিচালনার জন্য অনেক কম নাবিকের প্রয়োজন হয়, এতে বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হয়। ফ্লাইট লঞ্চ সিস্টেম এবং ফ্লাইট ডেকে ফাইটার জেটে ক্ষেপণাস্ত্র এবং বোমা আনার জন্য ব্যবহৃত লিফট জটিলতার কারণে কমিশনের পাঁচ বছর পর সমুদ্রে মোতায়েন করা হলো ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড।
রাশিয়ার সঙ্গে কি সামরিক সংঘাতে জড়াবে এই রণতরী?
কেউ কেউ মনে করেন, উত্তর আটলান্টিকে শক্তিশালী রণতরী মোতায়েন রুশ বনাম পশ্চিমা শক্তির সম্ভাব্য সামরিক সংঘাতের একটি ইঙ্গিত। ক্রেইগ জানান, তিনি বিশ্বাস করেন, উত্তর আটলান্টিকে পশ্চিমা নৌবাহিনী মোতায়েন ইঙ্গিত দেয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাল্টিক এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলে সম্ভাব্য রাশিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘনের যেকোনো প্রচেষ্টা কঠোর হস্তে মোকাবিলা করতে চায়।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, সমুদ্রের এই অংশে যুদ্ধবিমান পরিচালনার অর্থ হলো—আপনি এই অংশে রুশদের যেকোনো ধরণের বিমান উস্কানির প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন। এই অঞ্চলে বিমানবাহী রণতরী মোতায়েনের মাধ্যমে পশ্চিমা জোট আটলান্টিকে রাশিয়ার যে কোনো সম্ভাব্য কৌশলগত পদক্ষেপের সুযোগ হ্রাস করেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, মূলত এই অঞ্চলে রুশ বাহিনীর সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি পাওয়ায় উত্তর আটলান্টিক জলসীমায় ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড মোতায়েন করেছে আমেরিকা।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ইন্টারন্যাশনাল অর্ডার অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি প্রকল্পের পরিচালক ব্রুস জোনস বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধের আগে কূটনৈতিক সংকটের সময় আর্কটিক অঞ্চলে রাশিয়ার নৌ কার্যকলাপ যথেষ্ট বৃদ্ধি পায় । উত্তর আটলান্টিক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল, সেখানে রাশিয়াকে সামরিকভাবে নিবৃত্ত করতে চাচ্ছে আমেরিকা।’
বিশ্বব্যাপী মার্কিন নৌবাহিনীর ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি কেবল ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে উত্তর আটলান্টিকেই সীমাবদ্ধ নয়। ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড যখন উত্তর আটলান্টিকে মোতায়েন করা হয়েছে ঠিক তখন আরেকটি ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ ইউএসএস রোনাল্ড রিগ্যানের নেতৃত্বে কোরিয়ান উপসাগরে টহল দিচ্ছে। সেখানে ন্যাটোপন্থী জাপান এবং উত্তর কোরিয়াকে সহযোগিতার জন্য মোতায়েন করা হয়েছে নিমিটজ শ্রেনীর এই বিমানবাহী রণতরী।
– টিআরটি ওয়ার্ল্ডের প্রতিবেদন অবলম্বনে
সারাবাংলা/আইই