মিতু হত্যা: পিবিআইয়ের অভিযোগপত্র গ্রহণ করেছেন আদালত
১০ অক্টোবর ২০২২ ১৩:১৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো: স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলায় স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারসহ আটজনের বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দাখিল করা অভিযোগপত্র আদালত গ্রহণ করেছেন। এখন বিচার শুরুর জন্য প্রস্তুত করে মামলার নথি পাঠানো হবে মহানগর দায়রা জজ আদালতে।
সোমবার (১০ অক্টোবর) চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আব্দুল হালিমের আদালতে অভিযোগপত্রের গ্রহণযোগ্যতার ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এসময় বাবুল আক্তারসহ কারাগারে থাকা আসামিদের আদালতে হাজির করা হয়। বাবুল আক্তারের পক্ষে তার আইনজীবী পৃথক তিনটি আবেদন আদালতে দাখিল করেন। সেগুলোর ওপরও শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (প্রসিকিউশন) কামরুল ইসলাম সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, অভিযোগপত্রের গ্রহণযোগ্যতার শুনানির সময় আসামিপক্ষের আইনজীবীরা এর বিরোধিতা করে পুনঃতদন্ত দাবি করেন। আদালত সেটা নাকচ করে অভিযোগপত্র গ্রহণ করে বিচার শুরুর জন্য প্রস্তুত করে মহানগর দায়রা জজ আদালতে প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছেন।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর তদন্ত সংস্থা পিবিআই আটজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। এতে প্রধান আসামি করা হয় মিতুর স্বামী বাবুল আক্তারকে। অভিযোগপত্রে আরও যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হলেন- মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, এহতেশামুল হক প্রকাশ হানিফুল হক প্রকাশ ভোলাইয়া, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম কালু এবং শাহজাহান মিয়া।
এদিকে সোমবার বাবুল আক্তারের পক্ষে দাখিল করা তিনটি আবেদনের মধ্যে আছে- জেলকোডের ৯১০ ধারা অনুযায়ী বাবুল আক্তারকে কারাগারে ডিভিশন দেয়া, আইনজীবীর সঙ্গে একান্তে কথা বলার জন্য পর্যাপ্ত সময় প্রদান এবং চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে নিষ্পত্তি করা বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেনের দায়ের করা মামলার তদন্তের কোনো সাক্ষ্য চলতি মামলার নথির সঙ্গে সংযুক্ত না করা।
বাবুল আক্তারের আইনজীবী গোলাম মওলা মুরাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাবুল আক্তারকে ডিভিশন দেয়ার বিষয়টি কারাবিধি অনুসারে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন আদালত। একান্তে কথা বলার জন্য সময়ের আবেদন মঞ্জুর করেছেন। আমরা বাবুল আক্তারের সঙ্গে এডিসি-প্রসিকিউশনের কক্ষে বসে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছি। এরপর উনাকে কারাগারে ফিরিয়ে নেয়া হয়। তৃতীয় আবেদনটি আদালত আদেশের জন্য অপেক্ষমাণ রেখেছেন।’
এদিকে মামলার একজন সাক্ষী তার জবানবন্দি প্রত্যাহারের বিষয়ে আদালতে আবেদন করেছিলেন। আদালত সেটা নাকচ করে দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরীর পাঁচলাইশ থানার ও আর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার অদূরে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। স্ত্রীকে খুনের ঘটনায় পুলিশ সদর দফতরের তৎকালীন এসপি বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদসহ নানা নাটকীয়তার পর ওই বছরের আগস্টে বাবুল আক্তারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তখনই মিতু হত্যায় বাবুল আক্তার জড়িত এমন গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।
হত্যাকাণ্ডের পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন প্রথম এই খুনে বাবুলের জড়িত থাকার সন্দেহ প্রকাশ করেন। নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাত ঘুরে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলার তদন্তভার পড়ে পিবিআইয়ের ওপর। এরপর আস্তে আস্তে জট খুলতে থাকে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টিকারী চাঞ্চল্যকর এই মামলার।
২০২১ সালের ১১ মে বাবুল আক্তারকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। পরদিন বাবুল আক্তারের মামলায় আদালতে ৫৭৫ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়, যাতে উল্লেখ করা হয়- তদন্তে ঘটনার সঙ্গ বাদী বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
একইদিন (১২ মে) দুপুরে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন বাদি হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় বাবুল আক্তারসহ আটজনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। পিবিআই হেফাজতে থাকা বাবুল আক্তারকে মোশাররফের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর আদালতে দেয়া গ্রেফতার ভোলাইয়া, বাবুলের ঘনিষ্ঠ সাইফুল হক, গাজী আল মামুন, মোকলেসুর রহমান ইরাদ এবং আসামি মুসার স্ত্রী পান্না আক্তারের জবানবন্দিতে বাবুলের সম্পৃক্ততার তথ্য আরও জোরালো হয়।
তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এসব জবানবন্দির একপর্যায়ে নিজের মামলায় পিবিআইয়ের দাখিল করা চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ওপর নারাজি আবেদন দাখিল করেন বাবুল আক্তার। ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর শুনানি শেষে আদালত বাবুল আক্তারের নারাজি আবেদন প্রত্যাখান করেন। একইসঙ্গে পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করে পিবিআইয়ের চূড়ান্ত প্রতিবেদনও প্রত্যাখান করে অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন। ফলে মোশাররফ হোসেনের দায়ের করা মামলাটির পাশাপাশি করা বাবুল আক্তারের মামলাটিও সক্রিয় হয়ে যায়। দুই মামলার সমান্তরাল তদন্তভার এসে পড়ে পিবিআইয়ের ওপর।
ওই বছরের ২৩ ডিসেম্বর বাবুল আক্তারকে তার নিজের মামলায় গ্রেফতার দেখানোর জন্য আদালতে আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি আদালত তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদন মঞ্জুর করে বাবুলকে গ্রেফতার দেখানোর আদেশ দেন। ২৫ জানুয়ারি তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতের পর্যবেক্ষণ মেনে মোশাররফের মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। একইসঙ্গে ওই মামলার ডকেট প্রথম মামলার সঙ্গে সংযুক্ত করে তদন্তের জন্য আবেদন করেন। আদালত অনুমতি দিলে শুধুমাত্র বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলাটির তদন্তই চলমান থাকে।
বাবুল আক্তারের দায়ের করা মামলায় তাকেই প্রধান আসামি করে দাখিল করা অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত বিদেশি নাগরিক এক নারীর সঙ্গে বাবুলের পরকীয়ার জড়িয়ে পড়া নিয়ে তাদের সংসারে অশান্তি শুরু হয়। এর জেরে বাবুল আক্তার স্ত্রীকে খুনের সিদ্ধান্ত নেন। তিন লাখ টাকায় ‘খুনি’ ভাড়া করে স্ত্রীকে খুন করায়। নিজেকে আড়ালে রাখতে প্রচার করেন- জঙ্গিরাই মিতুকে খুন করেছে। মিতুকে খুনের মিশনে নেতৃত্ব দিয়েছে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুলের ‘সোর্স’ মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা। সঙ্গে ছিল আরও ছয়জন। হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল মুসাকে ফোনে নির্দেশ দেন- গা ঢাকা দেয়ার জন্য।
অভিযোগপত্র দাখিলের আগে গত ৮ সেপ্টেম্বর সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার তাকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগে পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত আইজি বনজ কুমার মজুমদারসহ ছয় পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলার আবেদন করেছিলেন। ২৫ সেপ্টেম্বর সেটা খারিজ করেন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ ড. জেবুন্নেছা বেগম।
এরপর ডিজিটাল কনটেন্ট বানিয়ে মানহানিকর অপপ্রচারের অভিযোগে বনজ কুমার মজুমদার রাজধানীর একটি থানায় মামলা দায়ের করেন। এতে বাবুল আক্তার ও তার ভাই এবং মার্কিনপ্রবাসী সাংবাদিক ইলিয়াসকে আসামি করা হয়।
সারাবাংলা/আরডি/ইআ