বিশ্বব্যাপী মন্দায় রেমিট্যান্স ও রফতানি কমার আশঙ্কা
১২ অক্টোবর ২০২২ ১৮:০১
ঢাকা: ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী মন্দার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই মন্দার প্রভাব বাংলাদেশও এড়াতে পারবে না। ওই সময় দেশের অর্থনীতির প্রধান দুই সূচক রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সে ভাটা দেখা দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পাশাপাশি দেশকে মোকাবিলা করতে হতে পারে খাদ্য সংকটের মতো বিষয়টিও। এ কারণে নতুন করে কর্মহীন হয়ে পড়তে পারে বহু মানুষ।
অর্থনীতিবিদ ও শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, মন্দা শুরু হলে পোশাক রফতানি আয় আরও কমে যেতে পারে। এর ব্যাপক প্রভাব দেখা দিতে পারে অন্যান্য খাতেও। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখনই প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ তাদের।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘মন্দার প্রভাব নেতিবাচক হবে এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়। বাংলাদেশ এখন রফতানিমুখী হয়ে গেছে। পোশাক রফতানির ওপর দেশের অর্থনীতি অনেকটা নির্ভর করছে। মন্দার ফলে ইউরোপ-আমেরিকায় আয় কমে যাবে। ফলে রফতানি আয় কমবে সেটা সহজেই অনুমেয়।’
তিনি বলেন, ‘ওই সময় রেমিট্যান্সেও প্রভাব পড়তে পারে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে হয়তো আয় কমবে না। তবে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে আসবে। আবার বিভিন্ন দেশেও নতুন করে কর্মী পাঠানো যাবে না। যা নিয়ে এখন কাজ চলছে। সেটি খুবই আশঙ্কার কথা।’
তিনি আরও বলেন, ‘মন্দা হলে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাবে। ফলে দেশের অর্থনীতিতেও স্থবিরতা দেখা দেবে। এ অবস্থা উত্তরণে করণীয় কী? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে সরকারকে নীতিগত সহায়তা দিতে হবে। মন্দার ফলে রফতানি খাত ক্ষতিগ্রস্থ হলে তাদের জন্যও সরকারকে কিছু করতে হবে। সার্বিকভাবে মানুষ কর্মস্থল হারালে সরকারকে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।’
মন্দার আশঙ্কা নিয়ে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আসন্ন মন্দার প্রভাব নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। মন্দার ফলে আমাদের রফতানি খাত ক্ষতিগ্রস্থ হবে। যেহেতু আমাদের রফতানি ইউরোপ ও আমেরিকানির্ভর, সেহেতু সেখানে মন্দার শঙ্কা সবচেয়ে বেশি। তাই আমাদের রফতানি খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। যদি মন্দা মধ্যপাচ্যেও আঘাত হানে তাহলে আমাদের রেমিট্যান্স খাতেও প্রভাব পড়তে পারে।’
বিশ্বব্যাপী মন্দা নিয়ে উদ্বেগের আশঙ্কা রয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া যায়? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। অভিঘাতগুলো কোন কোন খাতে আসবে, তা এখন থেকেই যাচাই-বাছাই করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর জন্য কী করা যায় তা এখন থেকেই ভাবতে হবে।’
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি আগেই বলেছিলাম ২০২৩ সাল কঠিন বছর হবে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক কারণে ২০২২ সালে দেশের অর্থনীতিতে সংকট দৃশ্যমান হয়েছে। আগামী বছর তা আরও স্পষ্ট হবে। জ্বালানি তেলের দাম আর কমবে না। মন্দা দেশের রফতানি আয়ে আঘাত হানবে। তেলের দাম বাড়ার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে আরও বেশি নির্মাণ কাজ হবে। সেখানে হয়তো আরও বেশি কর্মী পাঠানো যাবে। তবে মন্দা রেমিট্যান্সেও প্রভাব ফেলবে।’
পোশাক রফতানিতে মন্দার প্রভাব বিষয়ে দেশের নিটওয়্যার খাতের সংগঠন বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সংকট আরও দীর্ঘমেয়াদী হবে। যুদ্ধ সহজেই থামছে না। ফলে সামনের দিনে আমাদের রফতানি আয় আরও কমবে।’ তিনি বলেন, ‘গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট না থাকলে রফতানি ভালো হতো। আমরা মন্দার কারণে যতটা না ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি বা হবো- তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকেটের কারণে। উৎপাদন ঠিকভাবে চালাতে না পারায় আমরা ক্রেতাদের ক্রয়াদেশের পণ্যই ঠিকসময়ে সরবরাহ করতে পারছি না। আবার কর্মঘণ্টাও কমে গেছে। শ্রমিকরা এখন আর ওভারটাইম করতে পারছে না। এতে শ্রম অসন্তোষ দেখা দেওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।’
এ বিষয়ে বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘মন্দায় পোশাক খাতে অবশ্যই প্রভাব পড়বে। গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে উৎপাদন ইতোমধ্যেই ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে গেছে। নতুন কোন উদ্যোক্তা আসছে না। বর্তমান ও আসন্ন সংকট মোকাবিলায় রফতানিমুখী শিল্পের জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা উচিত।’
অর্থনীতিবিদদের এই আশঙ্কা পুরোপুরি ঠিক হবে এমনটি মনে করেন না পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। সারাবাংলার সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নানা ধরনের আইডিয়া করা হয়। গবেষক ও অর্থনীতিবিদরা নানা ধরনের আশঙ্কা করেন। সবসময় যে তাদের কথা ঠিক হয় তা নয়।’
তিনি বলেন, ‘ভূ-রাজনৈতিক সমস্যাই হলো মূল সমস্যা। অর্থনীতিতে কোনো সমস্যা নেই। সাধারণ মানুষ খেটে খায়, পরিশ্রম করে। তাদের মধ্যে বিবাদ নেই। বিবাদটা রাজনীতিতে। বড়দের (উন্নত দেশ) মধ্যে মতভেদ। প্রাধান্য বিস্তারের জন্য তারা একে অপরের ওপর চাপ দেয়। তারা নানা ধরনের স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) দেয়। আমরা কিন্তু তাদের সমকক্ষ নই। তবু আমরা নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞার শিকার হই।’
এদিকে, সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ২২টি সরকারি ও বেসরকারি খাতের অর্থনীতিবিদের মতামত নেওয়া হয়েছে। ওই প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, প্রতি ১০ জন অর্থনীতিবিদের সাতজনই ২০২৩ সালে বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা করছেন। অর্থাৎ ৭৩ শতাংশ অর্থনীতিবিদিই মন্দার আশঙ্কা করছেন।
বিশ্বব্যাংকও ২০২৩ সালে বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা করছে। ধারাবাহিক মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলায় বেশিরভাগ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়ানোয় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছে প্রতিষ্ঠানটি। ফ্লোরিডাভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নেড ডেভিস রিসার্চ বলছে, আগামী বছর মন্দার ঝুঁকি ৯৮ দশমিক ১ শতাংশ।
এদিকে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বিশ্বপ্রবৃদ্ধি কমার পূর্বাভাস দিয়েছে। আইএমএফ বলছে, ২০২২ সালে ৩ দশমিক ২ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে ২ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। তথ্যমতে, প্রথম বিশ্বমন্দা দেখা যায় ১৯৩০ সালে। এরপর দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম মন্দা দেখা যায় যথাক্রমে ১৯৭৫, ১৯৮২, ১৯৯১ ও ২০০৯ সালে। আর ২০২৩ সালে পুরো বিশ্বে মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। যে মন্দাকে ৬ষ্ঠ মন্দা বলা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা করছেন। সরকার এ বিষয়ে ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের অধিবেশন চলাকালে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে মতবিনিময়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। ওই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, তারা বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছেন। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ শক্তিশালী অবস্থানে থাকায় উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই বলেও মনে করছেন তিনি।
প্রসঙ্গত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশের রফতানি আয় এখন নেতিবাচক ধারায়। গেল সেপ্টেম্বরে রফতানি আয় কমেছে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। রেমিট্যান্সও কমেছে প্রায় ১১ শতাংশ। এছাড়া গেল কয়েক মাস ধরেই পোশাক রফতানির ক্রয়াদেশ কমে আসছে। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের পোশাক রফতানি নেতিবাচক ধারায় থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা।
সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম