ডেটলাইন ১০ ডিসেম্বর: হঠকারী তৎপরতা দেখাবে না বিএনপি
১৪ অক্টোবর ২০২২ ২০:২২
ঢাকা: ঢাকায় ১৬টি স্পটে ‘সফল’ সমাবেশের পর বন্দর নগরী চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড মাঠে বিপুল ‘জনসমাগম’ বিএনপির চলমান আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। দেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন কোণঠাসা হয়ে থাকা দলটির নেতাকর্মীরা এখন উজ্জীবিত।
মাঠের এই চাঙ্গাভাব ধরে রেখে কর্মসূচির পর কর্মসূচি দিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করাই বিএনপির আপাত লক্ষ্য। আর এ লক্ষ্য পূরণে চলমান আন্দোলনে আরও বিপুল সংখ্যক মানুষকে সম্পৃক্ত করতে চায় তারা। সে কারণেই আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠেয় মহাসমাবেশকে ঘিরে কোনো ‘হঠকারী’ তৎপরতা দেখাবে না বিএনপি। এমনকি সমাবেশ থেকে কোনো ‘হঠকারী’ কর্মসূচি দেবে না বলেও জানা গেছে।
বরং দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং জনদুর্ভোগের বিষয়টি মাথায় রেখে সভা-সমাবেশ, গণসংযোগ, গণঅবস্থান, গণস্বাক্ষর, গণঅনশন, পদযাত্রা, রোড মার্চ এবং মানববন্ধনের মতো শান্তিপূর্ণ ও জনবান্ধব কর্মসূচি চালিয়ে নিতে চায় রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি। সুতরাং ঢাকার মহাসমাবেশে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সশরীরে হাজির করা অথবা ১০ ডিসেম্বরের আগেই তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার মতো ‘অবাস্তব’ চিন্তা তাদের মাথায় নেই। এ ব্যাপারে দলের মধ্যম সারির নেতাদের বক্তব্যকে ‘কথার কথা’ হিসেবেই দেখছেন দলটির নীতি নির্ধারকরা।
বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা এবং ঢাকা মহানগর বিএনপির দায়িত্বশীল কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
দলীয় সূত্র মতে, বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন- দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি ও জ্বালানি তেলের সংকট, হঠাৎ বেড়ে যাওয়া লোডশেডিংসহ নানা কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। এ কারণেই বিএনপির কর্মসূচিগুলোতে দিন দিন সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে। বুধবার (১২ অক্টোবর) চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড মাঠে অনুষ্ঠিত সমাবেশে এর প্রতিফলন দেখা গেছে। শনিবার (১৫ অক্টোবর) অনুষ্ঠেয় ময়মনসিংহে জনসভা, আগামী ২২ অক্টোবর খুলনায়, ২৯ অক্টোবর রংপুরে, ৫ নভেম্বর বরিশালে, ১২ নভেম্বর ফরিদপুরে, ১৯ নভেম্বর সিলেটে, ২৬ নভেম্বর কুমিল্লায়, ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে এবং ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশেও এর ব্যতিক্রম হবে না বলে বিশ্বাস বিএনপি নেতাদের।
এসব কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করাই বিএনপির প্রধান লক্ষ্য। কারণ, আগামী দিনের কর্মসূচিগুলোতে তৃতীয় কোনো পক্ষ গোল-মাল লাগিয়ে সব ভণ্ডুল করে দিতে পারে— এমন আশঙ্কা করছেন বিএনপি নেতারা। আবার নিজেদের ‘অতিকথনে’ তীরে এসে তরী ডুবতে পারে- এমন আশঙ্কাও রয়েছে দলটির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে। সেজন্য খুব সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছেন তারা। বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে হিসেব করে পা ফেলতে বলা হয়েছে সবাইকে।
কারণ, এরই মধ্যে গত ৮ অক্টোবর রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমানের দেওয়া ‘আগামী ১০ ডিসেম্বরের পরে বাংলাদেশ চলবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কথায়’, এর এক দিন পর দলের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরীর দেওয়া ‘শিগগির তারেক রহমান দেশে আসবেন’ এবং পরের দিন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুকের দেওয়া ‘১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশ হবে আটলান্টিক মহাসাগরের’ মতো বক্তব্যগুলো নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
সূত্র মতে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে চলমান আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা ছাড়া আপাতত কোনো এজেন্ডা নেই বিএনপির। আর এই দাবি আদায়ে অপেক্ষাকৃত ‘সরল’ কর্মসূচির কথাই চিন্তা করছে বিএনপি। হরতাল-অবরোধ-ঘেরাও কর্মসূচির কথা এখনই ভাবছে না তারা। সুতরাং ১০ ডিসেম্বর নিয়ে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, সেটিকে স্রেফ ‘পলিটিক্যাল গেইম’ হিসেবে দেখছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। তাদের মতে, মূল বিষয় থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরাতে কোনো একটি মহল বিএনপির মধ্যম সারির কয়েকজন নেতার ‘সাধারণ’ বক্তব্যকে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের আপাতত লক্ষ্য জনগণের দাবির সঙ্গে জনগণকে সম্পৃক্ত করা। আর আমরা এ কাজটি যদি করতে পারি, তাহলে সরকার এক তরফা নির্বাচনের দিকে যেতে পারবে না।’
ঢাকার মহাসমাবেশ থেকে হরতাল-অবরোধ-ঘেরাও এর মতো কর্মসূচি আসতে পারে কি না?- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক দুরবস্থা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সংকট এবং লোডশেডিংয়ের কারণে জনগণ সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে আছে। সুতরাং জনগণের দুর্ভোগ আরও বাড়ে, এমন কর্মসূচির কথা আমরা এখনই ভাবছি না। আমরা জনগণের কথা মাথায় রেখেই কর্মসূচি দেব।’
ঢাকা উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘যে ধরনের কর্মসূচি দিলে জনগণের দাবি মানতে সরকার বাধ্য হয়, সে ধরনের কর্মসূচিই আমরা দেব। জনগণের কষ্ট হয় বা জনগদুর্ভোগ বাড়ে- এমন কর্মসূচি আপাতত আমরা দেব না। আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে বিএনপির কর্মসূচিতে জনগণকে সম্পৃক্ত করা।’
লোডশেডিংসহ নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে গত জুলাই থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে ধারাবাহিক কর্মসূচি শুরু করে বিএনপি। গত ৩১ জুলাই ভোলায় দলের কর্মসূচিতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ছাত্রদল নেতা নূরে আলম ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী আব্দুর রহিম নিহত হন। এরপর নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জে আরও দুই কর্মীর মৃত্যুতে বিএনপির আন্দোলন আরও বেগবান হয়। সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে ঢাকার ১৬টি স্থানে সমাবেশ করে বিএনপি।
ঢাকার ১৬টি সমাবেশের ১৩টি সফলভাবে শেষ করে বিএনপি। বাকি তিনটিতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও পুলিশের বাধার মুখে পড়ে দলটি। সমাবেশ ছাড়াও ঢাকায় মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। বনানীর এ কর্মসূচিতে হামলার শিকার হন দলটির নেতারা। ১৭ সেপ্টেম্বর ওই ঘটনার পর ২১ সেপ্টেম্বর মহাখালীর সমাবেশে প্রথমবারের মতো বিএনপি নেতাকর্মীরা লাঠি হাতে সমাবেশে যোগ দেন। এরপর থেকে সব সমাবেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের লাঠি হাতে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ডিএমপির পক্ষ থেকে লাঠি হাতে সমাবেশে না আসার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
এরই মধ্যে গত ৮ অক্টোবর আগামী বিএনপির চেয়ারপারসনে উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান বলেন, ‘১০ ডিসেম্বরের পরে বাংলাদেশ চলবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কথায়’। তার এই বক্তব্যে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। তবে গত কয়েকদিন ধরে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে যে, এই মুহূর্তে কোনো অপরিমাণদর্শী বা হঠকারী তৎপরতা দেখাবে না তারা। কোনো হঠকারী কর্মসূচিও দেবে না বিএনপি। বরং শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায়ের লক্ষ্যে আমার আন্দোলন করছি। আমাদের আপাতত লক্ষ্য এ আন্দোলনে জনগণকে সস্পৃক্ত করা। ইতোমধ্যে আমরা এ কাজে সফলও হয়েছি। জনগণ আমাদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছে। এই আন্দোলনকে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সামনের দিকে নিতে চাই। কারও পাতা ফাঁদে আমরা পা দেব না।’
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম