Monday 21 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিপজ্জনক সাকার মাছ নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া চলছে

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২০ অক্টোবর ২০২২ ১১:০০

ঢাকা: দেশের প্রায় সব জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিপজ্জনক সাকার মাছ। জলজ পরিবেশ বিনষ্টকারী এই মাছ দেশে নিষিদ্ধকরণের প্রক্রিয়া চললেও, এই প্রক্রিয়া খুবই ধীর। দেশে সাকার মাছের আমদানি, প্রজনন, চাষ, বিক্রি ও পরিবহন নিষিদ্ধ করতে গত জুলাইয়ে মৎস্য অধিদফতর প্রস্তাব দিলেও এখনও প্রজ্ঞাপন জারি করেনি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। শুধু তাই নয়, এই মাছটি নিধনে সরকারিভাবে এখনও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। মৎস্য অধিদফতর প্রচারণা চালালেও তা চোখে পড়ার মতো নয়। এমন পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাকার মাছ নিধনে আরও জোর প্রচারণা চালাতে হবে। একইসঙ্গে মাছটি নিধনে জেলেদের প্রণোদনার আওতায় আনা উচিৎ।

বিজ্ঞাপন

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মৎস্য অনুবিভাগ) মো. আব্দুল কাইয়ূম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাকার মাছ নিষিদ্ধকরণের প্রক্রিয়া চলছে। মৎস্য অধিদফতর থেকে যে প্রস্তাব এসেছে, সেই আলোকে প্রজ্ঞাপন জারি করার কাজ চলছে। প্রক্রিয়া শেষে আইন মন্ত্রণালয়ে তা বেটিংয়ের জন্য পাঠানো হবে। এরপর প্রজ্ঞাপন জারি হবে। জেলেদের প্রণোদনা দেওয়া যায় কিনা, বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সে বিষয়েও একটি মিটিং হওয়ার কথা রয়েছে।’

বিজ্ঞাপন

মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক খন্দকার মাহবুবুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাকার মাছটি দেশের অনেক জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। মাছটির বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণার জন্য বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটকে (বিএফআরআই) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দেশের কোথাও মাছটি পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে তা ধ্বংস করতে আমরা পরামর্শ দিচ্ছি।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘জালে এই মাছ উঠলে যাতে ধ্বংস করা হয় সে বিষয়ে জেলেদের সচেতন করতে হবে। তাদের প্রণোদনা দেওয়া যায় কিনা সেটা নিয়ে আমরা ভাবছি।’

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাকার মাছের অস্তিত্ব পাওয়া গেলে সেই পুকুর শুকিয়ে মাছটি ধরে ফেলতে হবে। সারা দেশে যেহেতু সাকার ছড়িয়ে পড়েছে আমরা স্যাম্পলিং করছি। সাকার মাছ পানির ওপর দিকে থাকে এবং পচা-গলা বেশি খায়, সে কারণে মাছটি বিষাক্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে। ফিশ মিল ও পোল্ট্রি ফিড হিসাবে সাকার মাছ ব্যবহার করা যাবে কিনা তা নিয়ে গবেষণা চলছে।’

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারি অনুষদের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মাহফুজুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাকার একটি বিপজ্জনক পরজীবী মাছ। দেশে এটি অ্যাকুরিয়াম ফিশ হিসাবে এসেছে। এই সমস্ত মাছ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অ্যাকুরিয়ামে চাষ হয়। অ্যাকুরিয়ামের ময়লা পরিষ্কারের জন্য এই মাছ ব্যবহার করা হয়। মাছটি ধীরে ধীরে প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়েছে। এর বিস্তার বাংলাদেশে ব্যাপক।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকা ও ময়মনসিংহে এর বিস্তার বেশি। দেশের বিভিন্ন নগীরর আশেপাশের নদীতে তদন্ত (স্যাম্পলিং) চালিয়ে দেখতে কি পরিমাণ সাকার মাছ রয়েছে। জেলেদের প্রণোদনা দিয়ে এই মাছগুলো ধরে ফেলতে হবে। জেলেদের বলতে হবে তোমরা এত কেজি মাছ দাও, আমরা এত টাকা দেবো। অর্থাৎ সাকার নিধনে জেলেদের অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।’

মৎস্য অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশে সাকার মাছের ছড়িয়ে পড়া নিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে গত ৫ জুন এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। মাছটি যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সভায় সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। ওই সভার প্রেক্ষিতে গত ২৮ জুন মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (মৎস্য চাষ) মো. খালেদ কনক একটি নির্দেশনা জারি করেন।

ওই নির্দেশনায় বলা হয়, সাকার মাছ নিষিদ্ধ করার বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারির আগে সাকারসহ কোনো প্রকার বিদেশি মাছ অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়া আমদানি, হ্যাচারিতে প্রজনন, পোনা উৎপাদন, চাষ, বিক্রি ও পরিবহন করা যাবে না। পরে ২৭ জুলাই মন্ত্রণালয়ে সাকার মাছ আমদানি, প্রজনন, চাষ, বিক্রি, পরিবহন প্রভৃতি বিষয়ে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দেয় অধিদফতর। তবে এখনও মাছটি নিষিদ্ধকরণের প্রজ্ঞাপন এখনও জারি হয়নি।

মৎস্য অধিদফতরের (মৎস্য চাষ) উপপরিচালক ড. মো. খালেদ কনক সারাবাংলাকে বলেন, ‘সাকার মাছ নিষিদ্ধ করার জন্য আমরা মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছি। এই মাছ নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই নিষিদ্ধকরণের বিষয়টি মৎস্য আইনে অন্তর্ভূক্ত হবে। সাকারের প্রদর্শন, বিপননসহ বাণিজ্যিকীকরণ ও চাষ বন্ধ করা যাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মাছটি যাতে আর ছড়িয়ে না পরে সারাদেশে সেই কার্যক্রম অব্যাহত আছে। বিভাগ, জেলা, উপজেলায় আমরা লিফলেট বিতরণ করছি। অ্যাকুরিয়ামের মাছ হিসাবে যাতে বিক্রি করা না যায় সেই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কোন পুকুরে পাওয়া গেলে ধ্বংস করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। দেশি প্রজাতির জীবন বিনষ্টকারী দ্রুত নিষিদ্ধকরণের আওতায় না নিয়ে এলে মৎস্য সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। বাহারি বা অ্যাকুরিয়াম ফিশ আমদানির ক্ষেত্রে মৎস্য অধিদফতরের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক করা জরুরি।’

মৎস্য অধিদফতর বলছে, প্রতিষ্ঠানটির অনুমতি ছাড়াও দেশে অ্যাকুরিয়ামে চাষ ও প্রদর্শনযোগ্য মাছ দেশে আসে। অনেক সময় কাস্টমসের অনুমতি নিয়েই এসব মাছ এসেছে। সাকার মাছও মৎস্য অধিদফতরের অনুমতি ছাড়াই দেশে আনা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরণের মাছ আমদানিতে মৎস্য অধিদফতরের অনুমতি বাধ্যতামূলক করা উচিৎ বলে মনে করছে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।

প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীতে সাকার মাছ সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার পুকুরেও এই মাছ পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানটি আরও বলছে, মাছটির প্রসার রোধে জাতীয় মৎস্য সম্পাহে প্রায় ১ লাখ লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। বিভাগীয় শহরের মধ্যে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা ও ময়মনসিংহে লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। কোথাও পাওয়া গেলে উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছটি না ছেড়ে মাটি চাপা দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

তথ্যমতে, সাকার মূলত অ্যাকুরিয়ামের মাছ। অ্যাকুরিয়ামের ময়লা পরিষ্কারে এই মাছটি ব্যবহার করা হয়। অ্যাকুরিয়াম থেকেই দেশের নদী ও পুকুরে এই মাছটি ছড়িয়ে পড়েছে। এই মাছ অন্য মাছে রেণু ও পোনা খেয়ে পেলে। দ্রুত বংশ বিস্তার করে। ফলে পানিতে অন্যান্য মাছ টিকতে পারে না। মাছটি জলজ জীববৈচিত্র্য ধ্বংসকারী। মাছটি কাঁটাযুক্ত হওয়ায় জেলেদের জালও নষ্ট করে ফেলে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট মাছটির ছড়িয়ে পড়া রোধে স্বল্পমেয়াদী কিছু পরামর্শ দিয়েছে। সেগুলো হলো- পুকুর প্রস্তুতির সময় পুকুর ভালোভাবে শুকাতে হবে এবং সাকার মাউথ ফিশ সম্পূর্ণভাবে অপসারণ করতে হবে। পুকুরে জাল টানার সময় উঠে আসা সাকার মাছ মেরে ফেলতে হবে। দেশে ইঁদুর নিধন অভিযানের মতো সাকার ক্যাটফিশ নিধন অভিযান পরিচালনা করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে দ্রুত মাছ নিধন হবে। অ্যাকুরিয়াম ফিশ আমদানির ক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। সরকারের অনুমতি ছাড়া অ্যাকুরিয়াম ফিশ আমদানি এবং প্রজনন ও পোনা উৎপাদন ব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে।

সাকার মাছের দেহ অঞ্চল/ঋতুভেদে হেভী মেটালের উপস্থিতি ও প্রজনন বিষয়ে নিবিড় গবেষণা প্রয়োজন। যেকোনো ভাবে পুকুরে সকার মাছের অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। বর্ষা মৌসুমে বদ্ধ জলাশয় থেকে নদ-নদীতে যাতে এ মাছ না যেতে পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে বলেও পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট।

সারাবাংলা/ইএইচটি/এমও

পরজীবী মাছ মৎস্য অধিদফতর মৎস্য আইন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সাকার মাছ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর