এক বৈঠকেই জমি অধিগ্রহণ ব্যয় কমলো ১১৭৪ কোটি টাকা!
২০ অক্টোবর ২০২২ ২৩:২৮
ঢাকা: ভূমি অধিগ্রহণে আকাশ-পাতাল ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছিল পরিকল্পনা কমিশনে। প্রথম পাঠানো উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপিতে) ১৩ দশমিক ২০ একর ভূমির জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা। কিন্তু পিইসি সভায় বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সংশোধিত ডিপিপিতে একই পরিমাণ ভূমির জন্য ব্যয় প্রস্তাব করা হয় ১৩ কোটি ৫ লাখ টাকা। এতে হঠাৎ করেই ব্যয় প্রস্তাব কমেছে ১ হাজার ১৭৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা। আর প্রস্তাবের এমন ফারাকে রীতিমতো হতবম্ব কমিশন সংশ্লিষ্টরা। এ জন্য পরিবেশবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের কাছে ব্যাখা জানতে চাওয়া হয়েছে।
‘বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবিলিটি অ্যান্ড ট্রান্সমেশন (বিইএসটি)’ শীর্ষক প্রকল্প প্রস্তাবে ঘটেছে এমন বিস্ময়কর ঘটনা। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা পরিবেশ অধিদফতর। এই প্রকল্পের বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাখা চেয়ে সম্প্রতি প্রস্তাবটি ফেরত পাঠানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জাতে চাইলে জানতে চাইলে পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে দর পাওয়ার পর জমির দাম নির্ধারণের কথা। কিন্তু এই প্রকল্প প্রস্তাবে সেটি করা হয়নি। ভূমি অধিগ্রহণের জন্য এমন আকাশ-পাতাল ব্যয় প্রস্তাব দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কাজ। এ রকম কাজে যুক্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের শাস্তি দেওয়া উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সদস্য (সচিব) বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখবেন বলে আশা করছি। তবে এ কথা ঠিক পরিকল্পনা কমিশন আপত্তি দেয় বলেই অনেক প্রকল্প থেকে অতিরিক্ত ব্যয় কমানো যাচ্ছে।’
সূত্র জানায়, প্রকল্প প্রস্তাব ফেরত দেওয়া সময় পরিকল্পনা কমিশন থেকে বলা হয়, সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন নির্দেশিকার ১ দশমিক ৫ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য জমি অধিগ্রহণ কিংবা ড্রয়িং বা ডিজাইন সংক্রান্ত কার্যক্রম থাকলেও এসব কার্যক্রমের জন্য আলাদা প্রকল্প নিতে হয়। এ প্রকল্পে সেটি মানা হয়নি।
আরও বলা হয়েছে, এর আগে পিইসি সভায় উত্থাপিত ডিপিপিতে সংযুক্ত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনে প্রকল্পটি লাল তালিকাভুক্ত ছিল। কিন্তু পুনর্গঠিত ডিপিপি সংযুক্ত সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় প্রকল্পটি কমলা ক্যাটাগরি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শ্রেণি পরিবর্তনের কোনো ব্যাখ্যা ডিপিপিতে সংযুক্ত করা হয়নি। প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের রাজস্ব খাতের ব্যয় বিভাজনে দেখা যায়, তিন ধরনের আইটি এক্সপার্ট নিয়োগের জন্য ৪৮ জনমাস করে ধরা হলেও এর কোনো ব্যয় উল্লেখ করা হয়নি।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক (পরিকল্পনা) মুহাম্মদ সোলায়মান হায়দার সারাবাংলাকে বলেন, ‘নো কমেন্টস। প্রকল্পটি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। আলাপ-আলোচনার পর ব্যয় প্রস্তাবগুলো ঠিক করা হবে। এ পর্যায়ে প্রকল্প প্রস্তাবটি নিয়ে সংবাদ লেখার মতো কিছুই হয়নি।’
সূত্র জানায়, ‘বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবিলিটি অ্যান্ড ট্রান্সমেশন (বিইএসটি)’ শীর্ষক প্রকল্পটি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব আকারে পাঠানো হয়। বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে রয়েছে পরিবেশ অধিদফতর। এছড়া প্রকল্পের সহযোগী বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে আছে- বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৮৭৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা।
প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে দেশের পরিবেশের গুণগতমানের অবনতি ঘটেছে। ফলে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। গত এক দশকে বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশের পরিবেশগত কর্মক্ষমতার সূচকের অবস্থানের অবনতি হয়েছে। বাংলাদেশে সবচেয়ে দৃশ্যমান দূষণগুলো হলো- বায়ু এবং পানি দূষণ। এছাড়া রয়েছে শহর ও শিল্প কেন্দ্রগেুলো বর্জ্য সমস্যা। পানি দূষণের মূল উৎসগুলো হলো- অপরিশোধিত পয়ঃবর্জ্য এবং শিল্পবর্জ্য।
প্রস্তাবে আরও বলা হয়, গবেষণা থেকে জানা যায়, অভ্যন্তরীণ এবং পরিবেষ্টক বায়ু দূষণের কারণে মানুষের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালের পরিবেশগত এবং অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ এবং সীসার এক্সপোজারে বাংলাদেশের মৃত্যু প্রায় ২২ শতাংশ। সেইসঙ্গে দেশের জিডিপির প্রায় ১২ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে। সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীরা বায়ু দূষণের কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। পরিবেশ দূষণ রোধে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনায় সরকারের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রকল্পটি নেওয়া হচ্ছে।
তবে পরিকল্পনা কমিশন বলছে, প্রকল্পের বিভিন্ন অঙ্গের ব্যয় অত্যধিক বলে কমিশনের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। ফলে সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন নির্দেশিকা অনুযায়ী বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ বিভাগ প্রকল্পটির ব্যয় যুক্তিযুক্তকরণের পক্ষে মত দিয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের আয়-ব্যয় বিশ্লেষণে প্রকল্পটিকে অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক হিসাবে দেখানো হয়েছিল। অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক প্রকল্পটি নেওয়ার যৌক্তিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে এর ব্যাখা চেয়েছে কমিশন।
এছাড়া প্রকল্পের কাজ সমন্বয়ের জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিবেশ অধিদফতরের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক, বিআরটিএ এবং হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের মধ্যে মেমোরান্ডাম অব আন্ডারস্টাডিং (এমওইউ) সই করতে বলা হয়েছে।
প্রকল্পের মূল কার্যক্রম হলো- ১৩ দশমিক ৮০ একর ভূমি অধিগ্রহণ। পরিবেশ অধিদফতরের দুটি বিভাগীয় অফিস উন্নয়ন (খুলনা ও রাজশাহী), রংপুর ও সিলেটে দুটি নতুন বিভাগীয় অফিস, পরিবেশ অধিদফতরের ৩০টি জেলায় অফিস, ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার এবং এনভায়রনমেন্টাল সেন্টার অব এক্সিলেন্স স্থাপন করা হবে।
এছাড়া ৬৩টি মনিটরিং ভেহিকেল, ১৫টি মনিটরিং ভেসেল এবং চারটি ট্রান্সবাউন্ডারি ভেহিকেল ক্রয়, একটি কেন্দ্রীয় এবং পাঁচটি বিভাগীয় পরীক্ষাগার স্থাপন করা হবে। আরও আছে ৩০টি জেলা অফিসের জন্য যন্ত্রপাতি কেনা, ৪০০ জন কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ এবং বিদ্যমান ১৬টি সিএএমএস’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে। পাশাপাশি এয়ার কোয়ালিটি ফরকেস্টটিং সিস্টেম প্রতিষ্ঠা, ৭৫টি প্রফেশনাল ইন্ডোমেন্ট ফান্ড প্রতিষ্ঠা, পরিবেশের জন্য নতুন পলিসি প্লান স্ট্রাজি অ্যান্ড গাইডলাইন্স প্রণয়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-কে হালনাগাদ করা।
সারাবাংলা/জেজে/পিটিএম