‘হ য ব র ল’ জাতীয় পার্টি, কমছে জনসমর্থন ও ভোট
২১ অক্টোবর ২০২২ ১৪:০৪
ঢাকা: আন্তঃকোন্দলে ‘হ য ব র ল’ জাতীয় পার্টি। যোগ্য নেতৃত্বের অভাব, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, পদ ও মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে দলটির এই অবস্থা বলে মনে করছেন জাতীয় পার্টির নেতা কর্মীরা। সঠিক নেতৃত্ব নেই। কার হাতে নেতৃত্ব যাবে— রওশন, জি এম কাদের নাকি দলে আসবে অন্য কেউ? তা নিয়ে প্রশ্ন ঘুরপাক পাচ্ছে দলের মধ্যে। এই পরিস্থিতি দলের জনসমর্থন ও ভোট কমছে বলে আশঙ্কা করছেন দলীয় নেতাকর্মীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, নির্বাচনে লড়াই করার মতো একক ক্ষমতা নেই। জোটগত ভাবে নির্বাচন করতে হলে দরকাষাকষি করে আসন বেশি ভাগিয়ে নেয়ারও অবস্থা নেই দলটির। আর এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বেগম রওশন এরশাদের পৃথকভাবে কাউন্সিলের ডাক। এতে আসন্ন আগামী দ্বাদশ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভোট ও আসনের সংখ্যা কমে যাবে।
দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, এরশাদের জীবদ্দশায় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে জাতীয় পার্টিকে ‘ট্রাম কার্ড’ বলা হত। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টি ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে আসছে। কূটনৈতিক মহলে ও রাজনৈতিক অঙ্গনে দলটির গুরুত্বও কমে গেছে। এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির আমলে কূটনৈতিক মহলে জাপা আলোচনায় থাকতো। এখন আর তা নেই। এখন জাতীয় পার্টিকে বলা হয় ‘আমাকে ব্যবহার করুন’ (ডাস্টবিন)। তবে রুটিন ওয়ার্ক এবং জাতীয় সংসদের বিরোধী দল হিসেবে ঢাকার বিদেশি হাইকমিশনে এখনও ডাক পান জাতীয় পার্টির নেতারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাপার সার্বিক কর্মকাণ্ডে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা এবং সম্ভাব্য প্রার্থীরা হতাশ।
সূত্র জানায়, ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টি একক ভাবে নির্বাচন করেনি। জোটগত ভাবে নির্বাচনের দিকে এগিয়েছে। ফলে ২৪৮টি আসনে জাতীয় পার্টির নির্বাচনী প্রতীক কি তাও হয়তো জানে না সাধারণ মানুষ। ওইসব আসনে সংগঠনের কার্যক্রমও তেমন নেই। এরপর দলের মধ্যে ৫২ জন সম্ভাব্য প্রার্থীর একটি তালিকা তৈরি করেছেন জি এম কাদের।
বিশ্লেষকদের মতে, ১৯৯০ সালে গণ আন্দোলনের মুখে হুসইেন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের পতনের পর, রাজনীতিতে জাতীয় পার্টি শক্তিশালী হতে পারেনি। দলীয় নেতাকর্মীরা ভেবেছিলেন দলটি রাজনৈতিক অঙ্গনে টিকে থাকবে কিনা। এ সংশয় ছিল সবার মাঝে। তবে ১৯৯১ সালে নির্বাচনে এককভাবে জাপা অংশ নিয়ে ৩৫টি আসনে জয়লাভ করে। এরপর দলটির নেতাকর্মীরা চাঙ্গা হতে থাকেন। ওই সময় দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত মিজানুর রহমান চৌধুরী।
১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করলেও বড় রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের কাছে জাতীয় পার্টির গুরুত্ব ছিল। গত ১৫ বছর ধরে নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির গুরুত্ব বেড়েছে ঠিকই। তবে পাশাপাশি দলটির ওপর থেকে বিশ্বাসও হারিয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে, জাতীয় পার্টি যত ভোট পেয়েছিল সেটি পরবর্তীতে ক্রমাগত কমেছে। জাতীয় পার্টির ভোট বা সমর্থনগুলো আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দিকে চলে গেছে। তাদের মতে আগামী নির্বাচনের পর জাপার জনসমর্থন আরও কমবে। এক্ষত্রে জাপা নেতারা মনে করেন, বিএনপি যদি সমর্থনের দিক থেকে নিচের দিকে চলে যায় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় পার্টির সমর্থক সংখ্যা বা ভোটার সংখ্যা বাড়বে।
গত নির্বাচনে মহাজোটে থেকে জাতীয় পার্টি (লাঙ্গল) প্রর্তীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আসন পেয়েছে ২২টি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি অংশ নিয়ে আসন পেয়েছিল ২০টি। এই নির্বাচনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচন বর্জন করার সিন্ধান্ত নিলে বেগম রওশন এরশাদের নেতৃত্বে একটি অংশ নির্বাচনে অংশগ্রহন করেন। যদিও এই নির্বাচনে এরশাদ নিজে অংশগ্রহন করেছিলেন।
নবম নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আসন পায় ২৭টি। বর্তমান ‘হ য ব র ল’ অবস্থায় থেকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে কয়টি আসন পাবে তা নিয়ে প্রশ্ন দলীয় জাপা নেতাকর্মীদের মাঝে।
এসব নিয়ে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘জাতীয় পার্টির আসন কমছে না বাড়ছে তা এখন বলা যাচ্ছে না। আমরা জনগণের কাছে যাচ্ছি, নির্বাচনের জন্য প্রার্থী সেটআপ করছি। নির্বাচনের ৩ মাস আগে বলা যাবে আমাদের আসন বাড়বে না কমবে। জাতীয় পার্টিও আসন কমবে না বাড়বে সে বিষয়টি সাংবাদিকরা ভালো বলতে পারবে। তবে কোনো সাংবাদিক বলবে কমবে, আবার কোনো সাংবাদিক হয়তো বলবে কমবে না। কারণ সাংবাদিকরা মাঠে থাকছেন।’
জাপার আরেকজন অতিরিক্ত মহাসচিব নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘জাতীয় পার্টি এখন রাজনৈতিক দল নয়, এটি একটি লিমিটেড কোম্পানি। জি এম কাদের সাহেব এটির সিইও। আমরা যারা আছি সবাই এখানে এমপ্লয়ি। যে কোনো সময় আমাদের চাকরি চলে যেতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জি এম কাদের নিজের আত্মীয়-স্বজনকে দলে ঢোকাচ্ছেন এমপি বানানোর জন্য। যেমন আদেলুর রহমান আদেল এমপি, সে কোনদিন রাজনীতি করেনি। অথচ দলীয় এমপি। আমরা কিন্তু দলের জন্য অনেক কিছু করেছি কিন্তু কিছই হইনি। সেহেতু জাপার অবস্থা আগামীতে খুবই শোচনীয় হবে।’
জাতীয় পার্টির অতিরিক্ত মহাসচিব ও প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য সাইদুর রহমান টেপা ১৯৯০ সালের পর থেকে জাতীয় পার্টির সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখা দিয়ে বলেন, “জাতীয় পার্টি ‘হ য ব র ল’ অবস্থায় নেই। জাপা আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী হয়েছে। একসময় খুলনা বিভাগে জাপার দলীয় প্রার্থী দেওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। সেখানে দলয় প্রার্থী দেওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এরকম প্রত্যেকটি বিভিাগে জাপার অবস্থা আগের তুলনায় অনেক ভালো হয়েছে। সে হিসেবে জাতীয় পার্টি এককভাবে নির্বাচন করলে আসন সংখ্যা আগের তুলনায় বাড়বে। আর জোটগত নির্বাচনে অংশ নিলে সে ক্ষেত্রে দর কষাকষিতে যত আসন পাওয়া যায়।”
তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ভালো ফলাফল করবে। তবে অগ্রিম বলা যাচ্ছে না কত আসন পাবে।’
সারাবাংলা/এএইচএইচ/এমও