সহকর্মীকে যৌন হয়রানি, তিরস্কারেই শেষ ইউএনও’র শাস্তি!
২৩ অক্টোবর ২০২২ ২২:৩৩
ঢাকা: কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অমিত চক্রবর্তী (ইউএনও)। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে একজন নারী সহকারী কমিশনারকে (এসিল্যান্ড) যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি প্রশাসনিক তদন্তে গুরুতর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও ‘তিরস্কার’ সূচক লঘুদণ্ড দেওয়া হয়েছে তাকে।
তবে এটাকে শাস্তি হিসেবে মানতে নারাজ অধিকারকর্মীরা। তাদের মতে, একজন নারী সহকর্মীকে ইউএনও‘র মতো দায়িত্বশীল পদে থেকে যৌন হয়রানির মতো অপরাধ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরও তাকে কোনো শাস্তি না দিয়ে কেবল তিরস্কার করা গ্রহণযোগ্য নয়। অবিলম্বে ওই ইউএনও‘কে বরখাস্তের দাবি জানিয়েছেন তারা।
ইউএনও অমিত চক্রবর্তী‘র বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তার দাখিল করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ত(খ) বিধি অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’ সংঘটনের অভিযোগে রুজুকৃত বিভাগীয় মামলার অভিযোগনামায় বর্ণিত ‘অসদাচরণ’র পর্যায়ভুক্ত অভিযোগগুলোর মধ্যে ভুক্তভোগী সহকারী কমিশনারের সাথে ফেসবুক মেসেঞ্জারে অশোভনীয় কথোপকথন/চ্যাটিং করা এবং তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে বডি স্প্রে কিনে দেয়ার মাধ্যমে অভিযুক্ত কর্মকর্তা কর্তৃক অসদাচরণ সংঘটনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘তদন্ত কর্মকর্তা কর্তৃক উল্লিখিত প্রমাণিত কার্যকলাপ সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর বিধি ৩(খ) অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’র পর্যায়ভুক্ত শাস্তিযোগ্য অপরাধ; সেহেতু অভিযুক্ত কর্মকর্তা অমিত চক্রবর্তী (পরিচিতি নম্বর ১৭৪৯৪), প্রাক্তন উপজেলা নির্বাহী অফিসার, কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী বর্তমানে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, চররাজিবপুর, কুড়িগ্রাম’র বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮-এর ৩(খ) বিধি অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’র অভিযোগে উপর্যুক্ত তথ্যাদি পর্যালোচনায় অভিযোগসমূহ প্রমাণিত হওয়ায় আনীত অভিযোগের মাত্রা ও প্রাসঙ্গিক সকল বিষয় বিবেচনায় তাকে একই বিধিমালার ৪(২) (ক) বিধি অনুযায়ী ‘তিরস্কার’ সূচক লঘুদণ্ড প্রদান করা হলো।’
এ ব্যাপারে রোববার (২৩ অক্টোবর) বিকেলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কেএম আলী আজম সারাবাংলাকে বলেন, ‘লঘু শাস্তি হয়েছে কি না আমি এই মুহূর্তে বলতে পারব না। নথিপত্র না দেখে কিছু বলতে পারছি না।’
অন্যদিকে, বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী প্রফেসর সাদেকা হালিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘একজন ইউএনও’র মাধ্যমে তার অধীনে কর্মরত নারী সহকর্মীকে যৌন হয়রানির মতো গুরুতর অভিযোগ সরকারি তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। এর পরেও শাস্তি না দিয়ে তিরস্কার করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
তিনি বলেন, ‘যৌন হয়রানির নীতিমালা অনুযায়ী, একজন নারীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে উত্যক্ত করা, কিংবা অশোভন আচরণ কিংবা ইঙ্গিত করা- হালকা করে দেখার কোনো বিষয় নয়। অশোভন ও অশালীন আচরণের বিষয়টি তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার পরও ইউএনকে বরখাস্ত না করে তিরস্কার করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই এই মুহূর্তে ইউএনও‘কে বরখাস্ত করে বিষয়টি অধিক তদন্ত করে তাকে যথাযথ শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি। তা না হলে মাঠ পর্যায়ের নারীরা আরও বেশি যৌনহয়রানির শিকার হবেন।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফৌজিয়া মোসলেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে একজন বিসিএস কর্মকর্তা কর্তৃক আরেকজন বিসিএস নারী কর্মকর্তাকে যৌন হয়রানি খুবই দুঃখজনক। তার চেয়ে বড় কথা- একজন নারীকে যৌনহয়রানির ঘটনা তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার পরেও শাস্তি না দেওয়া অপরাধীদের প্রশ্রয় দেওয়ার সামিল।’ তিনি বলেন, ‘অপরাধের জন্য কাউকে তিরস্কার করা শাস্তি নয়, আমরা এই ঘটনার যথাযথ বিচার দাবি জানাচ্ছি।’
যৌন হয়রানির শিকার ৩৬ ব্যাচের ওই কর্মকর্তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে উল্লিখিত বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। অন্যদিকে, চররাজিবপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা অমিত চক্রবর্তী‘র মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।পরে তার মোবাইলে খুদেবার্তা পাঠালেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।
যা রয়েছে সরকারি প্রজ্ঞাপনে
গত ১৩ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে উপসচিব নাসরিন সুলতানার সই করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘অমিত চক্রবর্তী (পরিচিতি নম্বর ১৭৪৯৪), সাবেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার, কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী বর্তমানে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, চররাজিবপুর, কুড়িগ্রাম গত ২৫ জুলাই ২১ হতে ৪ সেপ্টেম্বর ২১ পর্যন্ত উপজেলা নির্বাহী অফিসার, কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী হিসাবে কর্মরত থাকাকালে তার অধীনে কর্মরত সহকারী কমিশনারের (ভূমি) সাথে অশোভন আচরণ, তার সাথে ফেসবুক মেসেঞ্জারে অশোভন কথোপকথন, তার স্বামী যেন বদলি হয়ে নীলফামারী জেলায় না আসেন সে বিষয়ে চাপ প্রয়োগসহ তার বাচ্চা যেন রংপুরে থাকে, তিনি যেন স্টেশনে থেকে চাকুরি করেন সে বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করেন।’
‘পাশাপাশি তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও বডি স্প্রে কিনে দেয়া, রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে কুরুচিপূর্ণ ও অশালীন কথাবার্তা বলা, ফোন দিয়ে ভারসাম্যহীন ও অসঙ্গতিপূর্ণ কথা বলা, রাত ৮টা থেকে ৯টার সময় কোনো কাজ না থাকলেও অফিসে বসিয়ে রাখা। এছাড়াও সহকারী কমিশনারকে মাস্ক পরে তার সামনে বসতে নিষেধ করা, বন্ধের দিনে ফোন ওয়েটিংয়ে থাকা নিয়ে চাপ প্রয়োগ করার মতো শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ এবং একজন মহিলা সহকর্মীর সাথে খুবই অশোভন আচরণ করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ের গত ১৫ নভেম্বর ০৫.০০.০০০০.১৮৪.২৭.০২১.২১(বি.যা)-৪৭৭ নম্বর স্মারকে বিভাগীয় মামলা রুজু করে কৈফিয়ত তলব করা হয়।’
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, ‘অভিযুক্ত কর্মকর্তা অভিযোগনামা ও অভিযোগ বিবরণীর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩ নভেম্বর লিখিত জবাব দাখিলপূর্বক ব্যক্তিগত শুনানির জন্য আবেদন করলে গত ২০ জানুয়ারি তার ব্যক্তিগত শুনানি গ্রহণ করা হয়। ব্যক্তিগত শুনানিকালে সরকার পক্ষের নথি উপস্থাপনকারী কর্মকর্তা মো. আব্দুর রহমান (পরিচিতি নম্বর- ১৫৮৯০), উপ-পরিচালক (স্থানীয় সরকার) ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), নীলফামারী অভিযোগনামা ও অভিযোগ বিবরণীর বক্তব্য সমর্থন করে বলেন, একজন নারী জুনিয়র সহকর্মীর সাথে এমন অশালীন ও দৃষ্টিকটূ আচরণ কাঙ্খিত নয়। অপরপক্ষে, অভিযুক্ত কর্মকর্তা অমিত চক্রবর্তী (পরিচিতি নম্বর ১৭৪৯৪) তার নিজের দাখিলকৃত লিখিত জবাব সমর্থন করে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বিভাগীয় মামলার দায় হতে অব্যাহতি প্রদানের জন্য অনুরোধ করেন। তবে সরকার পক্ষ অভিযুক্তের বক্তব্য এবং নথি পর্যালোচনায় ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ গুরুতর হওয়ায় ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা ও প্রকৃত তথ্য উদঘাটনের নিমিত্তে অভিযোগটি তদন্ত করা প্রয়োজন মর্মে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করে। গত ২৭.০৯.২০২২ তারিখ তদন্ত কর্মকর্তা মামলাটি তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিল করেন।’
সারাবাংলা/জিএস/পিটিএম