Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দুবলার চরে শুরু হচ্ছে শুঁটকির মৌসুম, সাগরমুখী জেলেরা

মনিরুল ইসলাম দুলু, লোকাল করেসপন্ডেন্ট
২৯ অক্টোবর ২০২২ ১৪:২২

মোংলা: শুঁটকির মৌসুম শুরু, তাই শনিবার থেকে বঙ্গোপসাগরে যাত্রা শুরু করেছেন জেলেরা। একে একে ট্রলার এসে ভিড়ছে দুবলার চরের আলোর কোলে। ব্যস্ত হয়ে উঠছে দুবলার চর। আগামী ১ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই মৌসুম চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। টানা ৫ মাস সেখানে থাকতে হবে জেলেদের। তাই সাগর পাড়ে গড়তে হবে তাদের অস্থায়ী থাকার ঘর, মাছ শুকানোর চাতাল ও মাঁচা।

গতকাল শুক্রবার (২৮ অক্টোবর) রাত ৯টায় বন বিভাগ অনুমতি দেওয়ার পর আজ শনিবার (২৯ অক্টোবর) জেলেরা সাগরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছেন।

বিজ্ঞাপন

বৃটিশ আমল থেকে চলে আসা শুঁটকি পল্লীর কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে সন্দীপ ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় জেলেরা বঙ্গোপসাগর পাড় আলোর কোল ও দুবলার চরে অস্থায়ী বাসা তৈরী করে মৎস্য আহরণ করত। আশির দশক থেকে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা ও পটুয়াখালীর জেলেরা সুন্দরবন এলাকায় শুঁটকির জন্য বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকায় মৎস্য আহরণ শুরু করেন। সেই থেকে নানা প্রতিকূলতার মধ্য থেকে জেলেরা মৎস্য আহরণ করে আসছেন। জেলেরা ডাঙায় বাঘ, জলে কুমির-হাঙ্গর, বনদস্যু-জলদস্যুর উৎপাত ও বনরক্ষীদের হয়রানির মধ্যেও তাদের পেশা টিকিয়ে রেখেছেন।

বনবিভাগের হিসেব অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ কোটি ৪৬ লাখ ৬৭ হাজার ৮১৯ টাকা ও ২০১৯-২০ সালের অর্থবছরে ২ কোটি ৭৩ লাখ ৯৮ হাজার ৪৮ টাকা এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে আদায় হয়েছে সরকারিভাবে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৪ কোটি ১৮ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। সুন্দরবন দস্যুমুক্ত করায় উপকূলীয় শুঁটকি পল্লী থেকে রাজস্ব আদায় প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাগেরহাট জেলার রামপাল, মোংলা, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ এলাকার প্রায় ৫ শতাধিক জেলে-বহরদারসহ সাতক্ষীরা, খুলনা ও পিরোজপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে ও কয়েকশ’ জেলে সাধারণত সুন্দরবন থেকে মৎস্য আহরণ করে থাকেন।

বিজ্ঞাপন

তবে মৌসুমের শুরুতে জেলেদের সবচে বড় সমস্যা হয় অর্থের যোগানে। জেলে-বহরদাররা সুদে মহাজনদের কাছ থেকে সর্বনিম্ন ৫ লাখ টাকা থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিয়ে থাকেন। এই ঋণের বিপরীতে জেলেদের লাখে সুদ গুণতে হয় ২৫-৩৫ হাজার টাকা। অথচ তফসিলী ব্যাংকগুলো থেকে জেলেদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া হলে তাদের অনেক সাশ্রয় হতো বলে জানান তারা।

জেলেরা জানান, দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় মৎস্য আহরণ করে সরকারকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব দিলেও তারা ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে পারেনি। মৎস্য সমিতির মাধ্যমে সহজ শর্তে ঋণ না পাওয়া, চিকিৎসার জন্য অস্থায়ী বা ভাসমান হাসপাতাল না থাকা, ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য সাইক্লোন শেল্টার ও সুপেয় পানি এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকায় সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

তারা আরও জানান, সরকার আসে-যায়, কিন্তু কোনো সরকারই তাদের কথা রাখেনি। বিগত ও বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এমপিরা এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা আশ্বাসের পর আশ্বাস দিলেও বাস্তবে কেউ তা কখনও পূরণ করেননি।

খুলনার পাইকগাছার শুকুর আলী বলেন, ‘আজ থেকে আমরা যেতে শুরু করেছি। ৫ মাস সেখানে থাকব। অসুস্থ হলে সেখানে চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। নেই কোন সাইক্লোন সেন্টার।’

দাকোপের পরিমল বিশ্বাস বলেন, ‘মাছ ধরি ও শুকিয়ে শুঁটকি করে দেশে-বিদেশে পাঠাই। এটাই আমাদের আয়ের উৎস্য। শুধু দুবলার চরেই ৫ লক্ষাধিক লোক থাকি, অন্যান্য চরেও লোক আছে। সব মিলে প্রায় ৮/৯ লাখ লোক সেখানে সমাগত হই। আমাদের দিকে সরকারের নজর দেওয়া উচিত।’

উপজেলার গিলাতলা গ্রামের সমুদ্রগামী মৎস্যজীবী সমিতির সদস্য সৈয়দ শুকুর আলী জানান, দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে তিনি এ পেশার সাথে যুক্ত রয়েছেন। ৬টি জাল, ৩টি ট্রলার ও ২৮ জন কর্মচারী নিয়ে চলতি শুঁটকি মৌসুমে সুন্দরবনের দুবলার চরে যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, ‘মৌসুমে সাবাড় (বহার) নিয়ে সমুদ্রে যেতে হলে ২০ লাখ টাকার প্রয়োজন। এ টাকার চাহিদা পূরণ করতে আমাকে ব্র্যাক এনজিও থেকে ১০ লাখ টাকা, আশা এনজিও থেকে ৪ লাখ টাকা ও বাকি টাকা ৬ লাখ টাকা এলাকার সুদে মহাজনদের কাছ থেকে মাত্র সাড়ে ৫ মাস মেয়াদে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়েছে।’

একই কথা বলেন রামপাল সদরের ফরহাদ শেখ। তিনি জানান, প্রায় ২৮ লাখ টাকা ব্যয়ে তাকে সাগরে যেতে হচ্ছে। এর মধ্যে নিজস্ব তহবিল থেকে সাড়ে ৯ লাখ টাকা ও বাকি টাকা চড়া সুদে এলাকার মহাজনদের কাছ থেকে নিতে হয়েছে। যা মাছ ধরার পরপরই পরিশোধ করা শুরু করতে হবে।

সমুদ্রগামী জেলে পল্লীর সভাপতি শহিদ মল্লিক বলেন, ‘প্রতি বছরই আমরা বিভিন্নভাবে ঋণ করে সমুদ্রে যাই। সরকারিভাবে আমরা কোনো সহযোগিতা পাই না। প্রতি বছর মন্ত্রী-মিনিস্টার ও বনবিভাগের কর্মকর্তারা গিয়ে আমাদের সমস্যার কথা শোনেন এবং সমাধানের জন্য আশ্বাস দেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত আশ্বাসের কোন সুফল আমরা পাইনি।’

সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শেখ ফরিদুল ইসলাম জানান, সুন্দরবন আমাদের প্রাকৃতিক রক্ষা কবজ। জেলেরা যাতে বাস্ততন্ত্র রক্ষা করে শুঁটকির জন্য মৎস্য আহরণ করতে পারে সেজন্য বন বিভাগের ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য তিনি সরকারিভাবে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের দাবি জানান।

কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন সদর দফতরের সিনিয়র স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম আশিক আহমেদ সিদ্দিক জানান, শুঁটকি মৌসুমে জেলেরা নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে মাছ ধরতে পারবেন এবং তারা তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন। এজন্য কোস্ট গার্ড প্রস্তুত আছে ‘

সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের ডিএফও মুহম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘সুন্দরবন একটি ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। এ বনকে আমাদের বনবিভাগের চৌকস বাহিনী দিয়ে নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। এরই অংশ হিসাবে গোটা সুন্দরবনে আধুনিক স্মার্ট প্যাট্রোলিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জেলে, বাওয়ালী, মৌয়ালসহ অন্যান্য পেশাজীবীরা যাতে নির্বিঘ্নে বনজ সম্পদ আহরণ করতে পারে সেজন্য বনবিভাগের পক্ষ থেকে সব প্রকার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’ বনের সুরক্ষা নিশ্চিতে তিনি সবার সহযোগিতা কামনা করেন।

সারাবাংলা/এমও

জেলে দুবলার চর বঙ্গোপসাগর শুঁটকির মৌসুম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর