সব বিশ্ববিদ্যালয়ে মান নিয়ন্ত্রণ সেল থাকতে হবে: শিক্ষা উপমন্ত্রী
৩০ অক্টোবর ২০২২ ১৯:১২
চট্টগ্রাম ব্যুরো: শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেছেন, ‘প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেটা সরকারি হোক আর বেসরকারি হোক, একটা মান নিয়ন্ত্রণ সেল থাকতে হবে। আমরা (সরকার) এটা করবোই। আমাদের নির্বাচনী ওয়াদা ছিল এটা। পরবর্তীতে যেসব কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের বাইরে উচ্চশিক্ষা দেয়া হয়, সেগুলোতেও একটা মান নিয়ন্ত্রণের সেল থাকতে হবে। কারণ উচ্চশিক্ষা মানে ফলাফল ভিত্তিক পাঠ্যক্রম নয়, এর সঙ্গে অভিন্ন মেধাভিত্তিক দক্ষতাও দিতে হবে।’
রোববার (৩০ অক্টোবর) দুপুরে চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উপমন্ত্রী এসব কথা বলেন। নগরীর আমবাগানে নেভি কনভেনশন সেন্টারে এ অনুষ্ঠান হয়েছে। তৃতীয় সমাবর্তনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা বসেছিল। প্রাণের উচ্ছ্বাসে দিনটিকে উপভোগ করেছেন তারা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি হিসেবে সমাবর্তনে উপস্থিত হওয়ার কথা জানিয়ে শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেন, ‘উচ্চশিক্ষায় একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের একটা চেষ্টা আমরা করে যাচ্ছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী আমরা একটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োগ করবো। অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন মিলে এই নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন হবে। একটা বিষয় বারবার প্রধানমন্ত্রী বলেন যে- জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতি, সেটা প্রতিষ্ঠা করতে হলে শিক্ষার মৌলিক বিয়ষগুলোর মান উন্নয়ন করতে হবে। এজন্য ডেল্টা রূপরেখা তিনি দিয়েছেন, সেটা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। যারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে গ্র্যাজুয়েট হয়ে বের হচ্ছেন, তাদের এই রূপরেখা বাস্তবায়নে অংশ নিতে হবে।’
শিক্ষা শুধুমাত্র সনদ নেওয়ার প্রতিযোগিতা নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানে শুধু কিছু বিষয়ের ওপর সুনির্দিষ্ট কিছু জ্ঞান অর্জন। এটাই কিন্তু শেষ কথা নয়। শিক্ষার মধ্য দিয়ে যদি মনোজগতের পরিবর্তন না হয়, নৈতিকতার পরিবর্তন ও দৃষ্টিভঙ্গির উন্নয়ন না হয়, তাহলে সেই শিক্ষা তো কোনো কাজে আসবে না। আমি উচ্চশিক্ষা নিলাম, একটা সার্টিফিকেট নিলাম সেটা কিন্তু পরিপূর্ণ শিক্ষা নয়। মানুষের প্রকৃত শিক্ষাটা আসে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে। শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ দর্শন হচ্ছে- লাইফ লং লার্নিং এবং লার্নিং হাউ টু লার্ন।’
কর্মমুখী দক্ষতা অর্জনের তাগিদ দিয়ে উপমন্ত্রী নওফেল বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে যদি নিজস্ব দক্ষতা অর্জন করা না হয়, সেটা হোক যে কোনো কর্মমুখী দক্ষতা, তাহলে কিন্তু আমরা পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে এগোতে পারবো না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকতে হবে, সাথে মনোজগতের উন্নয়ন হতে হবে এবং কর্মমুখী দক্ষতায় নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। তাহলে একেকজন বিশ্ব নাগরিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারব। বিশ্ব নাগরিক মানে বিদেশে গিয়ে নাগরিকত্ব নেয়া নয়। বৈশ্বিক জ্ঞান, মূল্যবোধ, বিভিন্ন ভাষার দখল থাকা এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও দক্ষতার মাধ্যমে নিজের মেধাকে বিশ্বমানে নিয়ে গিয়ে দেশের জন্য কিছু করাই হোক লক্ষ্য।’
সমাবর্তন বক্তা ছিলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. পবিত্র সরকার বলেন, ‘আমরা কি কেবল স্কুল-কলেজেই শিখি ? আমাদের শিক্ষা শুরু হয় কী একটা নির্দিষ্ট বয়সে, রাষ্ট্র বা সমাজের নির্দিষ্ট করে দেওয়া ঘরে, নির্দিষ্ট জীবিকার মানুষদের কাছে? সবাই জানি, তা হয় না। আমি ভাষাবিজ্ঞানে সামান্য পড়াশোনা করেছি, আমি জানি যে শিশু যখন তার সাত মাসের শরীরে মায়ের পেটে অবস্থান করছে, সে তখনই মায়ের গলার স্বর অন্যদের গলার স্বর থেকে আলাদা করতে পারছে। সেটা হয়তো তার প্রথম শিক্ষা।’
‘জন্মের পর থেকে তার তুমুল শিক্ষা শুরু হয়ে যায়। এক হল সামাজিক শারীরিক শিক্ষা, মাকে সে সকলের থেকে আলাদা করে চেনে, সেই সঙ্গে অন্যেদেরও আলাদা করে। তারপর আঠারো সপ্তাহ থেকে শুরু হয় তার ভাষা শিক্ষা, সে আর এক কঠিন সাধনা। কিন্তু কী আশ্চর্য ঘটনা, তিন সাড়ে-তিন বছরের মধ্যে সে অনর্গল বলতে শুরু করে সেই ভাষা, দশ বছরে তার ব্যাকরণ পুরো আয়ত্ত করে ফেলে। অথচ পরে আমরা তো দেখি, একটা নতুন ভাষা শিখতে আমাদের কী গলদ্ঘর্ম হতে হয় !’
পবিত্র সরকার আরও বলেন, ‘মা আমাদের প্রথম শিক্ষক। এরপর তো চারপাশে প্রচুর শিক্ষক এসে যান, তাঁরা আমাদের স্কুলে-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার সমুদ্র পার করে দেন। তারপর সমাবর্তন আসে। সমাবর্তনের পর আবার আমরা পৃথিবীর খোলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে যাই। এখানে পাঠ্যবই নেই, রেফারেন্স বই নেই, আছে এক বিশাল ক্লাসঘর আর অজস্র পরীক্ষা। আমি আশা করব, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার মতো জীবনের সব পরীক্ষায় তোমরা সহজে পাশ করে যাও।’
প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. অনুপম সেন শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে তোমরা সমাবর্তনে উপনীত হয়েছ। এই দিনটি শিক্ষার্থীদের জন্য গর্বের দিন, আনন্দের দিন, আমরা যারা শিক্ষক, আমাদের জন্যও। শিক্ষার ক্ষেত্রে যে দেশ যত বেশি এগোচ্ছে, সেই দেশই বিশ্বে নেতৃত্বের ভূমিকায় এগিয়ে আসছে। ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপে সই করতে পারতেন এমন লোকের সংখ্যা ছিল মাত্র ৫ শতাংশ। ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে এই সংখ্যা হল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানিতে বিপুল পরিমাণে বেড়ে যায়। এইসব দেশে তা ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশে উন্নীত হয়। ইউরোপে যে দেশে যত বেশি শিক্ষিত মানুষ তৈরি হয়েছে, দেখা গেছে সিই দেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ততই বিপুলভাবে এগিয়ে গেছে। এইসব দেশে নব প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্তার ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির মুখ্য মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে।’
সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন- বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মেসবাহউদ্দিন আহমেদ, ইউজিসির সদস্য সাজ্জাদ হোসেন, বিশ্বজিৎ চন্দ ও আবু তাহের।
সমাবর্তনে ৫৬৯৭ জন গ্র্যাজুয়েট তাদের শিক্ষা সমাপণী ৬ জনকে চ্যান্সেলরস ও আরও ৬ জনকে ভাইস চ্যান্সেলরস স্বর্ণপদক দেয়া হয়। ৬ জনকে প্রতিষ্ঠাতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী স্বর্ণপদক দেয়া হয়েছে।
অনুষ্ঠানে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির সাংস্কৃতিক দল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে তাদের পরিবেশনা তুলে ধরে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ২০০২ সালের জানুয়ারি মাসে এর শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। মহিউদ্দিনের ছেলে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতি।
সারাবাংলা/আরডি/ এনইউ